প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলহানি ও বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় সুন্দরবনের ওপর বনজীবীদের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। খুলনার কয়রার উত্তর বেদকাশি, দক্ষিণ বেদকাশি, মহারাজপুর, মহেশ্বরীপুর, কয়রা সদর, বাগালী ও আমাদী ইউনিয়নের ৩০-৩৫ হাজার মানুষ পুরোপুরি বনের ওপর নির্ভরশীল। তারা বনের নদী-খাল থেকে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও বন থেকে মধু, মোম, গোলপাতা ও জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। জানা যায়, পশ্চিম বন বিভাগ কয়রা কাশিয়াবাদ ক্যাম্প থেকে গত মৌসুমে বনজীবীরা বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) সংগ্রহ করেন ৪৫০টি। এবার সেখানে এ পর্যন্ত বিএলসি দেওয়া হয় ৫৯০টি। এর বাইরেও অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত নানাভাবে বনে যাচ্ছেন। পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘তিন মাস বন্ধ থাকার পর ১ সেপ্টেম্বর উন্মুক্ত হয়েছে সুন্দরবন। এবার বনে জেলের নৌকা প্রবেশে ১২ হাজার বিএলসি দেওয়া হবে। এর মধ্যে পূর্ব সুন্দরবনে ৬ হাজার ও পশ্চিম সুন্দরবনে ৬ হাজার। আগ্রহী জেলের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।’
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। জুন থেকে আগস্ট-এ তিন মাস প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী-খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে এ তিন মাসের জন্য জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বনবিভাগ।
তবে বনের ওপর নির্ভরশীল বনজীবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানকার জীবনজীবিকাও চ্যালেঞ্জে পড়েছে। কয়রা সুতিরঘাট গ্রামের সাঈদুর গাজী জানান, সুন্দরবনে বনজীবীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো মাছ-কাঁকড়া পাওয়া যায় না। বনবিভাগ থেকে পাস নিয়ে নৌকায় তিনজনের দলে সাত দিনের মতো মাছ ধরলে ৫-৬ হাজার টাকার মাছ পাওয়া যায়। এতে সংসার চলে না। বনের নদী-খালে মাছ কমে গেছে, বনে আগের মতো মধু পাওয়া যায় না।
মহারাজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জানান, তিন মাস নিষিদ্ধ সময় বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় নদী-খালে মাছের উৎপাদন কমে গেছে। অনেকে মধু, গোলপাতা সংগ্রহের পাশাপাশি হরিণের মাংস পাচার ও বাঘ শিকার করে। এ কারণে বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির কথা বলা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। উপরন্তু গভীর সমুদ্রে যখন মাছ ধরা বন্ধ থাকে তখন জেলেদের যে চাল দেওয়া হয় তা এতই কম যে জীবিকা নির্বাহে তারা ওই সময় বনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ ছাড়া সুন্দরবনের নদী-খালে রেণু শিকারিরা মাছের পোনা সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। এর ফলেও প্রাকৃতিক নদী-খালে মাছের উৎপাদন কমেছে। বন কর্মকর্তারা বলছেন, সুন্দরবনসংলগ্ন পাঁচ জেলা বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরগুনা ও পিরোজপুরে ৫০ হাজার পরিবার বনের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জানান, বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এসব বনজীবীর বিকল্প কর্মসংস্থানে গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি পালন, মাছ-সবজি চাষ, সেলাই মেশিন, ইঞ্জিনচালিত যান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।