পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের মধ্য দিয়ে ঢাকার বয়স নিয়ে নতুন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। এতে বলা হচ্ছে, প্রাণের শহর ঢাকার বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছরের কাছাকাছি। খননে এমন কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মিলেছে যাতে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, ঢাকায় যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আগে মানববসতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা আরও বলেন, ঢাকার পুরনো এই কারাগার এবং এর আশপাশে যে দুর্গ, প্রাসাদ থাকার প্রমাণ মিলেছে সেটি অনেক বড় ছিল। এ জন্য পুরনো এই কারাগার এবং এর আশপাশের এলাকায় আরও খননের প্রয়োজন আছে। এতে ঢাকা এবং এর উৎপত্তি নিয়ে আরও অনেক তথ্য উঠে আসার সম্ভাবনা আছে।
‘পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন : ঢাকার গোড়াপত্তনের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক গবেষণা গত ২৯ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এতদিন বলা হয়েছিল, ঢাকার বয়স ৪০০ বছরের। কিন্তু এই গবেষণা জানান দিচ্ছে নতুন তথ্যের।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ও শিক্ষার্থীদের একটি দল ২০১৭-১৮ সালে এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করেন। দলটি কারাগারের প্রধান ফটকের সামনের অংশ, রজনীগন্ধা ভবনের আঙিনা, কারা হাসপাতালের সামনের অংশ, দশ সেল ও যমুনা ভবনের পশ্চিম এলাকা এই পাঁচ স্থানে ১১টি খননকাজ পরিচালনা করেন। এতে তারা একটি প্রাচীন দুর্গের দেয়াল, কক্ষ, নর্দমা, কূপের সন্ধান পান। এ ছাড়া এখানে কড়ি, মোগল আমলের ধাতব মুদ্রা, রোলেটেড ও গ্লেজড মৃৎপাত্রসহ বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন ধরনের প্রত্ননিদর্শন পেয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে মোগল সুবাদার ইসলাম খান ঢাকা নগরের গোড়াপত্তন করেন। তবে ইসলাম খান বাংলার সুবাদার হিসেবে ঢাকায় আসার অনেক আগে থেকেই এখানে মানুষের বসতি ছিল। অর্থাৎ ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের আগে থেকেই এখানে জনপদ ছিল। ১৬০০ সাল থেকে ঢাকার ইতিহাস শুরু হয় বলা হলেও এখানে আরও আগে থেকেই নগর ছিল বলা যায়। গবেষণায় উল্লেখ আছে, খননে কারাগারের ভিতর একটি প্রাসাদ থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রাসাদ বা দুর্গটি ১৪৩০ সালের। এর মাধ্যমে এটি বলা যেতেই পারে যে পঞ্চাদশ শতাব্দীতে এ জায়গায় হয়তো কোনো জনপদের কেন্দ্র ছিল। সে হিসেবে এ জায়গাকে কেন্দ্র করে একসময় রাজধানীও গড়ে উঠেছিল। এ খননের মধ্য দিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকরা ধারণা করছেন, খ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে থেকে ঢাকায় জনবসতি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় শতকে ঢাকা অঞ্চলে জনবসতি ছিল বলে তাদের ধারণা। সে হিসেবে ঢাকার বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছরের কাছাকাছি। ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় মোগল আমলের নথিপত্র থেকে। বিশেষত আকবরের শাসনামলে বাংলায় অভিযান করতে আসা সুবাদার ইসলাম খানের সেনাপতি ও লেখক মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বী’ বইয়ে নাথান বাংলা অভিযানের বয়ান তুলে ধরেন। ইসলাম খানের আগেই যে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় জনবসতি ছিল তা বারো ভূঁইয়ার ইতিহাসেও স্পষ্ট। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় লেখক ও গবেষকরা তাদের লেখাতেও এর উল্লেখ করেছেন। তাদের লেখায় এটি স্পষ্ট যে, ইসলাম খানের অন্তত ১০০ বছর আগেও ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্র্তী অঞ্চলে জনবসতি ছিল। এখানে চাষাবাদ ও ব্যবসাও হতো, যার মাধ্যম ছিল নদী।
প্রাক্তন এই কারাগারে খননে প্রাপ্ত বিভিন্ন নমুনা আমেরিকার বেটা ল্যাবরেটরিতে কার্বন-১৪ পরীক্ষা করা হয়। প্রত্নস্থানের সুনির্দিষ্ট বয়স/কাল নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হলো কার্বন-১৪ পরীক্ষার মাধ্যমে তারিখ নির্ণয়। পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারণ করছে যে, এই প্রাসাদ দুর্গটি সুলতানি আমলে নির্মিত হয়েছিল অর্থাৎ এগুলো ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দের এবং মোগল যুগ পর্যন্ত দুর্গটি ব্যবহৃত হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমরা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কারাগারে খননে প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষা করে ধারণা করছি, ঢাকা ২২০০ থেকে ২৩০০ বছরের পুরনো শহর। ১৬১০ সালে ইসলাম খান এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। সুবাদার যেখানে বসবাস শুরু করেন তা রাজধানী হয়ে যায়। এ হিসেবে ঢাকার রাজধানীর ইতিহাস শুরু হয় ১৬১০ সাল থেকে। কিন্তু যে দুর্গে তিনি বসবাস শুরু করেন তা আগেই ছিল। এটি তিনি সংস্কার করে বসবাস শুরু করেন। এর রেফান্সেস মির্জা নাথানের। এরপর আরও দুই-একজন সুবাদার সেখানে থাকলেন। এরপর ১৭ বা ১৮ শতকে এ বিষয়ে কেউ লেখেননি। ১৯ শতকে এসে যারা বই ও ইতিহাস লেখা শুরু করলেন সেই এলাকায় দুর্গ থাকার কথা বললেও কেউ তা দেখেনি। এই প্রত্নতাত্ত্বিক আরও বলেন, ২০০৮ সালে দেশে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল তখন মেজর হায়দার আমাকে নিমন্ত্রণ করেন কেন্দ্রীয় কারাগারটি ঘুরে দেখার জন্য। সেখানে সে সময় একটি জাদুঘর করার কথা বলেছিলেন। তখন জেলখানার ভিতর কয়েদি ছিল। আমি পুরনো ইট দেখতে পাই। যখন এ কারাগারটি পরিত্যক্ত হয়ে গেল তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে যার আওতায় সেই জায়গাটি ডেভেলপ করার কথা বলা হয়। আমাকে সেখানে প্রাচীন দুর্গটি খুঁজে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এরপর আমরা খনন করে দুর্গটি পাই। আমরা মাত্র এক বছর খনন করেছি কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব খনন কাজ করতে হলে একটি সাইট পাঁচ থেকে সাত বছর খনন করতে হয়। এটি শীতকালে করার কথা থাকলেও তহবিল বর্ষাকালে আসায় বর্ষার সময় কাজটি করি। আমরা আরও খনন করতে চাইলেও তৎকালীন একজন প্রভাবশালী অধ্যাপক তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমাদের খনন করতে দেননি।