ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে কক্সবাজার উপকূলের মানব পাচারকারী চক্র। স্থানীয় মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে অপহরণ, মুক্তিপণ ও মানব পাচারের সংঘবদ্ধ নেটওয়ার্ক রয়েছে উখিয়া টেকনাফে। স্থানীয়দের পাশাপাশি তারা বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শিশু, নারী ও পুরুষ পাচারের জন্য সংগ্রহ করে। নানা কৌশলে প্রলোভন দেখিয়ে সুযোগ বুঝে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয় তাদের। এর মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, দালালরা তাদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ডসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নানামুখী অভিযানের পরও বন্ধ করা যাচ্ছে না মানব পাচার। ঘাট পরিবর্তনসহ নানা কৌশলে চলছে এসব অপরাধ।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে মানব পাচার আইনে ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৭৪১টি মামলা হলেও বিচার শেষ হয়নি একটিরও। বিচারকসংকট ও সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে আটকে আছে মানব পাচারের এসব মামলা। মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে মানব পাচারের শিকার লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত ও বিচার বঞ্চিত হচ্ছেন। পাশাপাশি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় একই অপরাধ করে যাচ্ছেন একাধিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা।
বেসরকারি সংস্থা নোঙরের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত আট বছরে কক্সবাজারের আট থানায় মানব পাচার মামলা হয়েছে ৬৩৭টি। এর মধ্যে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ৯৭টি, রামু থানায় ২৪টি, উখিয়া থানায় ৬৮টি, টেকনাফ মডেল থানায় ২১৮টি, চকরিয়া থানায় ১৯টি, কুতুবদিয়া থানায় একটি, মহেশখালী থানায় ৩৬টি এবং পেকুয়া থানায় ৮টি মামলা। থানার এসব মামলা ছাড়া ট্রাইব্যুনালেও অনেক মামলা রয়েছে।
পুলিশ সূত্র বলছে, ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত কক্সবাজারে মানব পাচার আইনে মামলা হয়েছে ১০৪টি। যার মধ্যে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় ৩৬, চকরিয়া থানায় ২, মহেশখালী থানায় ৮, রামু থানায় ৬, উখিয়া থানায় ১৮, টেকনাফ মডেল থানায় ৩১, পেকুয়া থানায় ১ ও ঈদগাঁও থানায় মামলা হয়েছে ২টি।
মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ৭৪১ মানব পাচার মামলার একটিও নিষ্পত্তি হয়নি। সাক্ষীর অভাবে মামলায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এক প্রকার থমকে আছে মামলাগুলো। এ ছাড়াও অধিকাংশ মামলায় আসামিদের সম্পদ ক্রোকের জন্য আদালত আদেশ দিলেও একটিও কার্যকর এ পর্যন্ত হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মানব পাচারের জন্য ব্যবহার হচ্ছে কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডির ঘাট, উখিয়া ও টেকনাফের ছয়টি নৌঘাট। এসব নৌঘাট দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় লোক পাচার করা হচ্ছে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন পল্লানপাড়ার মৃত সিরাজুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম প্রকাশ আরিফ ও পালংখালী ইউনিয়নের নাজির হোসেনের ছেলে জিয়াবুল হক পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত। তাদের গত বছর র্যাব-১৫ আটক করেছিল। পরে জামিনে বের হয়ে আবার এ কাজে জড়িয়ে পড়ে। আরিফের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দুটিসহ চারটি মামলা রয়েছে।
এ ছাড়া চক্রের সঙ্গে জড়িত মো. হোছন প্রকাশ মাছন মাঝি, মো. হাছন প্রকাশ আতুরী, সুলতান মাহমুদ উল্লাহ, রশিদ মিয়া মেম্বার, আবদুল আমিনসহ অনেকে। এ সিন্ডিকেট সদস্যরা পাহাড়ের ভিতর অবস্থান নিয়ে মানব পাচার ও অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি করে। অনেক জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় উপকূল পাচার রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চক্রটি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের দেওয়া তথ্যমতে, উখিয়া ও টেকনাফের সাগর তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার পাশাপাশি কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পাচারকারীরা। এর মধ্যে কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরার টেক, সমিতিপাড়া; মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা; উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুর খাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী; টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, নোয়াখালীপাড়া, মহেশখালীয়া পাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও ও খুরুশকুল।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপকূলেও রয়েছে মানব পাচারকারী চক্রের তৎপরতা। উপকূলের এসব ঘাটকে পাচারকারীরা ব্যবহার করে থাকেন।
এদিকে গেল আড়াই মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নারী-শিশুসহ ৯৯ জনকে পাচারকালে উদ্ধার করেছে। এ সময় আটক হয়েছেন দুই পাচারকারী। ১৭ নভেম্বর রাতে র্যাব পাচারকারী চক্রের আস্তানা থেকে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য আটকে রাখা রোহিঙ্গাসহ ৩১ জনকে উদ্ধার করে। এ সময় পাচারকারী চক্রের টেকনাফের হ্নীলার পানখালী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত অছিউর রহমানের ছেলে মো. আনোয়ার (৪৪) ও সদর ইউনিয়ন উত্তর লম্বরী ২ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত রফিকের ছেলে আতিকুর রহমানকে (৩২) আটক করা হয়।
১৪ ডিসেম্বর শনিবার রাতে টেকনাফ সদর ইউপির দক্ষিণ লম্বরীর এক বসতবাড়ি থেকে মালয়েশিয়া যেতে জড়ো করা ৩০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেতে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছিল।
৪ নভেম্বর ভোরে টেকনাফের সদর ইউনিয়নের লম্বরী এলাকার পর্যটন বাজার থেকে মালয়েশিয়া পাচারকালে ১২ রোহিঙ্গা উদ্ধার ও চার দালালকে আটক করা হয়। ১৪ অক্টোবর সকালে উখিয়ার ইনানী সৈকত থেকে ২৬ রোহিঙ্গাকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, মানব পাচারের কিছু মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়েছে। তবে মামলাগুলোর সাক্ষী পাওয়া কঠিন। রাষ্ট্রপক্ষ চেষ্টা চালাচ্ছে এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে।
কক্সবাজারের জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আগে-পরে মানব পাচারে জড়িতদের মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করে অভিযান চালানো হবে। বিভিন্ন সময় মানব পাচারের শিকার নারী-পুরুষ উদ্ধার হয়েছে। একই সঙ্গে একাধিক দালাল ও পাচারকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ চিহ্নিত ঘাটগুলোতে ইতোমধ্যে তৎপরতা বাড়িয়েছে।