প্রবাসীদের ভোটদানের তিনটি পদ্ধতি নিয়ে গতকাল সেমিনার করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পদ্ধতি তিনটি হলো পোস্টাল ব্যালট, অনলাইন ভোটিং এবং প্রক্সি ভোটিং।
সেমিনারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দানের পক্ষে মতামত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে তিন পদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামতও এসেছে। এ ছাড়া ইমেইলে ভোট দেওয়ার পদ্ধতির কথাও বলেছে একটি দল।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘ভোটিং সিস্টেম উন্নয়ন’ শিরোনামে সেমিনারটি হয় আগারগাঁও নির্বাচন ভবন মিলনায়তনে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ছোট পরিসরে’ হলেও পোস্টাল ব্যালট, অনলাইন ভোটিং ও প্রক্সি ভোটিংয়ের মধ্য থেকে যে কোনো একটি পদ্ধতি চালু করতে চায় ইসি। সেমিনারে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ অন্তত ২১টি দলের প্রতিনিধি সেমিনারে অংশ নেন। এ ছাড়া সিনিয়র সাংবাদিক, নির্বাচন বিশ্লেষক ও আইটি বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতি চালুর বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বেশি আগ্রহী থাকলেও এ পদ্ধতির ঝুঁকির কথা বলেছে বেশ কয়েকটি দল। তবে তিন পদ্ধতির কোনটা আগামী নির্বাচনে চালু হবে সেই বিষয়ে সেমিনারে বিভিন্ন পরামর্শ এলেও আগামী ১৫ মে’র মধ্যে স্টেকহোল্ডারদের কাছে মতামত চেয়েছে ইসি। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে লিখিত মতামত দেবে তারা।
বিএনপি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে শিগগিরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানোর কথা বলেছে সেমিনারে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি), এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল প্রক্সি ভোটিং পদ্ধতির ‘প্রক্সি বাছাই, পছন্দের প্রতীকে ভোট, ভোটারের গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা’র বিষয়গুলো আলোচনায় এনেছে।
বিকালে সেমিনার শেষে সমাপনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আপনারা সকাল থেকে আলোচনা করেছেন, অত্যন্ত মূল্যবান মতামত দিয়েছেন। আমরা কার্যকর পদ্ধতি চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। আপনাদের মতামতকে গুরুত্ব দেব। আমরা শুরুটা করতে চাই। আপনাদের সহযোগিতা, বিশেষ করে দলগুলোর সমর্থন চাই।’ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবার দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানান তিনি।
সকালে এ সেমিনারের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে আগামী নির্বাচনে ছোট পরিসরে হলেও প্রবাসীদের ভোটিং চালু করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন সিইসি। প্রবাসীদের ভোটপদ্ধতি নির্ধারণে রাজনৈতিক দলের সমর্থন না পেলে ইসির সব উদ্যোগ ‘বৃথা’ যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সেমিনারের শুরুতে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ ভোটপদ্ধতি তুলে ধরেন। প্রবাসীদের ভোটপদ্ধতি নিয়ে ১৫ মে’র মধ্যে দল ও অংশীজনের মতামত লিখিত আকারে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়া প্রবাসীদের ভোটদানপদ্ধতি নিয়ে একটি আইনের খসড়া তুলে ধরেন নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ।
সেমিনারে বিএনপির পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। দলটি প্রবাসীদের ভোটের ব্যবস্থা করার পক্ষে মত দিয়েছে। তবে তিনটি পদ্ধতির বিষয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে ১৫ মে’র মধ্যে মতামত দেবে। নজরুল ইসলাম খান বলেন, প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কেবল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বিবেচনায় নিলে হবে না, এনআইডির পাশাপাশি পাসপোর্টও বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা অনেকের এনআইডি নেই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য জসিম উদ্দিন সরকার বলেন, উদ্যোগ নিলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। এটি ভালো উদ্যোগ। ‘ট্রায়াল অ্যান্ড ইররের’ মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে। কোনো অবস্থাতেই সিস্টেমকে ডেসট্রয় করা যাবে না।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘গণ অভ্যুত্থানের পর প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ বেশ দেখছি। ইসির কাছে আমাদের প্রত্যাশা, পরিপূর্ণ এফোর্ট দিয়ে যেন তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারে।’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত জানাব। প্রক্সি ভোটে দেখেছি যেটা, আমার মা একটি দলকে ভোট দেয়; আমার বাবা আরেকটি দলকে ভোট দেয়। এ ক্ষেত্রে প্রক্সির মাধ্যমে কী করে সিকিউরিটি নিশ্চিত করা যায়, সেটা ভেবে দেখতে হবে।’
এবি পার্টির শ্যাডো অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি আব্বাস ইসলাম খান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের এনআইডি আছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশে কিন্তু বেশির ভাগেরই পাসপোর্ট আছে। তারা মিশনে গিয়ে কেন এনআইডি নেবে। কাজেই পাসপোর্টও যেন অপশন রাখা হয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম মেম্বার কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, অনলাইন, প্রক্সি ও পোস্টাল- তিনটি পদ্ধতিরই সুবিধা-অসুবিধা আছে। তবে দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
অন্যান্য দল যা বলল : নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার বলেন, তাড়াহুড়া করতে গিয়ে যেন ভুল না হয়। আস্থা ফিরিয়ে আনা খুবই জরুরি। বাংলাদেশ লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, তাঁর দল প্রক্সি ভোটের পক্ষে। অনলাইন ভোটিং নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, আর পোস্টাল ব্যালট নিয়ে আগ্রহ নেই। ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস বলেছে, তারা দলীয় ফোরামে আলোচনা করে মতামত দেবে। জালিয়াতির সুযোগ থাকায় প্রক্সি ভোটের বিপক্ষে মত দেয় বাংলাদেশ কংগ্রেস। সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রধান আবু লায়েন্স মুন্না বলেন, তাঁর দল প্রক্সি ভোটিংয়ের পক্ষে নয়।
বাংলাদেশ জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহজাহান আলী সাজু বলেন, তারা দলের ফোরামে আলোচনা করে মতামত জানাবেন। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি কাজী আবুল খায়ের বলেন, প্রবাসীদের ভোটিং ব্যবস্থা নির্ধারণের আগে দলগুলোর একমত হতে হবে যে ভুল হলেও মেনে নেব।