সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী ঢাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতে সরকারি একটি বাসার জন্য এক বছর ধরে ঘুরছেন। সরকারি আবাসন পরিদপ্তরে আবেদনও করেছেন তিনি। আবেদনপত্রটি যত্নের সঙ্গে গ্রহণ করা হলেও বসবাসের জন্য বাসাটি মেলেনি। ওই কর্মজীবী নারী জানান, সরকারি বাসা খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপর মহলের সুপারিশে বরাদ্দ হয়ে যায়। ফলে যারা আবেদনের ওপর ভরসা করে বাসা নিতে চান, তাদের ঘুরতে হয় বছরের পর বছর।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিপ্তরের গত বছরের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। তাঁদের বসবাসের জন্য ফ্ল্যাট রয়েছে ১৩ হাজারের কিছু বেশি; যা মোট চাহিদার মাত্র ৮ ভাগ এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি বাসা না পেয়ে অধিক ভাড়া দিয়ে বেসরকারি বাসায় থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি আবাসন পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সরকারি কর্মচারীর তুলনায় সরকারি বাসার সংখ্যা কম থাকায় আবাসনসংকট রয়েছে। এ-সংকট কাটাতে তাঁরা পুরোনো ফ্ল্যাট ভেঙে অনেক জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেক স্থানে সংস্কার করে নতুন ভবন নির্মাণ করেছেন। তবে চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল।
১৩ বছরেও দখলমুক্ত হয়নি পরিত্যক্ত জিগাতলা সরকারি কলোনি : জিগাতলার ছয় তলা সরকারি কলোনির মতো কিছু পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দখলমুক্ত করতে না পারায় আবাসনসুবিধা বাড়ানো যাচ্ছে না বলে জানান আবাসন পরিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাঁরা জানান, বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ২০১২ সালে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে জিগাতলার ছয় তলা সরকারি কলোনি। বাসা খালি করার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরে একের পর এক চিঠিও পাঠানো হয়েছে। তবে ১৩ বছরেও খালি করা যায়নি ঝুঁকিপূর্ণ কলোনিটি। গণপূর্ত অধিদপ্তর বাসা খালি করতে পারছে না।
সরেজমিনে মঙ্গলবার ধানমন্ডির জিগাতলা ছয় তলা সরকারি কলোনিতে গিয়ে দেখা যায়, ভবনগুলোর বেশির ভাগেরই সিঁড়ি ভাঙা, স্থানে স্থানে উঠে গেছে পলেস্তারা। অনেক জায়গায় পলেস্তারা খসে ভিতরের রড বেরিয়ে গেছে। ৩ নম্বর ভবনে বসবাসরত একটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কক্ষের ভিতর থেকে জানানো হয়, দখলপ্রাপ্ত কর্মচারী অফিসে আছেন। কথা বলার মতো কেউ নেই। আরও দু-একটি বাসায় গিয়েও বসবাসরত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। ছয় তলা কলোনির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দারোয়ান জানান, চারটি ভবনে প্রায় ২০০ কর্মচারীর বসাবাস ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেকে চলে গেছেন। তবে এখনো ৫০টির বেশি পরিবার রয়ে গেছে সেখানে।
সূত্র জানান, আবাসন পরিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত পরিচালকের নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল কয়েকজন পরিদর্শক জিগাতলার ছয় তলা কলোনির ভবনগুলো পরিদর্শন করেন। ওই পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবনগুলোর বিভিন্ন পিলার এবং ছাদের বিশেষ অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন অংশের আস্তর খসে পড়েছে। ভবনগুলো বসবাস অনুপযোগী, ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে প্রাণনাশের আশঙ্কা রয়েছে বলেও পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। পরিদর্শনের পর ঝুঁকিপূর্ণ কলোনি খালি করার জন্য সর্বশেষ ২৪ মে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় সরকারি আবাসন পরিদপ্তর। ওই চিঠিতে ভবনগুলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় অনতিবিলম্বে বসবাস বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে অনুরোধ জানানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আহমাদ ফাহিম বলেন, ‘পরিত্যক্ত ঘোষণার বিষয়টি আমরা জেনেছি। তবে যাঁরা বাসা বরাদ্দ পেয়েছেন তাঁরা থাকছেন, যে কারণে বাসা খালি করা যাচ্ছে না।’ পরিত্যক্ত বাসার গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থার দায়িত্ব। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তর যেহেতু ভবনগুলোর মেইনটেন করে সে কারণে এসব সেবা বন্ধের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
সরকারি কলোনিতে থাকছেন কারা : শুধু যে সরকারি কর্মকর্তারা আবাসনসংকটে ভুগছেন তা-ই নয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কর্মরত অনেক কর্মচারীও ভুগছেন আবাসন সমস্যায়। অনেকে আবার বাসা বরাদ্দ নিয়ে বাণিজ্য করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য ঢাকায় ১৬টি কলোনি রয়েছে। এসব কলোনিতে সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করা মেসিয়ার থেকে শুরু করে ভ্যানে সবজি বিক্রি করেন এমন মানুষও থাকেন। কর্মচারীদের দখলে থাকা এক রুম ভাড়া নিয়ে এসব বেসরকারি লোক বসবাস করেন। জিগাতলা স্কুল কলোনি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ওই কলোনিতে ঢাকায় কাজ করতে আসা এক কিশোর একটি রুমে শেয়ার করে ৩ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে বসবাস করছে। একজন হোটেল মেসিয়ারও ভাড়া থাকার কথা জানান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মেসিয়ারের ভাষ্য, কলোনিতে মান্নান নামে এক লোকের মাধ্যমে তাঁরা বসবাসের সুযোগ পেয়েছেন। মান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, অনেক কর্মচারীর একটি রুম খালি থাকে, তাঁরাই সেটি সাবলেট হিসেবে ভাড়া দেন। কলোনির দেয়ালে এ ধরনের বেশ কিছু সাবলেট দেওয়ার পোস্টারও দেখা গেছে। মগবাজার টিঅ্যান্ডটি (বর্তমান বিটিসিএল) কলোনিতেও চলছে সরকারি বাসা নিয়ে চরম নৈরাজ্য। ওই কলোনিতে ২ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে টিনশেড প্রতিটি ঘর। কলোনিতে বসবাসরত রুবেল হাসান জানান, এখানে প্রতিটি টিনের ঘরে উঠতে ২ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। আবার এখানে সাবলেটেও থাকা যায়।