ভারতের কলকাতায় পিয়ারলেস হাসপাতালের বহির্বিভাগে এক বছর আগেও যেখানে গড়ে প্রায় ১৫০ জন বাংলাদেশি রোগী চিকিৎসার জন্য আসতেন, বর্তমানে সেখানে আসছেন মাত্র ১৫-২০ জন রোগী। আর এ হাসপাতালে বাংলাদেশি ভর্তি রোগীর সংখ্যা একেবারেই কম। হাসপাতালটির সিইও সুদীপ্ত মিত্র জানান, ‘বাংলাদেশি রোগীদের জন্য এখন তুলনামূলক কমসংখ্যক মেডিকেল ভিসা ইস্যু হওয়ায় তাদের জন্য ভারতে এসে চিকিৎসা নেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এতে ভারতে চিকিৎসা নিতে আসা বাংলাদেশি রোগীর সংখ্যাও আশঙ্কাজনক কমেছে।’ একই অবস্থা কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালের। গত এক বছরে হাসপাতালটিতে বাংলাদেশ থেকে আগত রোগীর সংখ্যা ৭৫ শতাংশ কমেছে। ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়ার ৫ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটি জানানো হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত এক বছরে প্রতিবেশী ভারতে গুরুতর ছাড়া বাংলাদেশি রোগীদের ভিসা পাওয়ার রেকর্ড কম। এতে চিকিৎসার জন্য উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশি এ সময়ে ভারতে যেতে পারেননি। কিন্তু জীবন বাঁচাতে অনেকেই এখন বিকল্প হিসেবে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে যাচ্ছেন চিকিৎসা করাতে। তালিকায় আরও আছে নেপাল, দুবাই ও সৌদি আরবের নামও।
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যে, ২০২৩ সালেও দেশটিতে মোট চিকিৎসা নিতে গিয়েছিল ৬ লাখ ৩৫ হাজার পর্যটক। এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০; যা দেশটির চিকিৎসা পর্যটকের ৭০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশি রোগী দেশটিতে কম যাওয়ায় চিকিৎসার পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভারতের হোটেল, রেস্তোরাঁ, ওষুধ ও বিনোদন খাতে। ভারতীয় গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্রিসিল র্যাটিং লিমিটেডের দেওয়া তথ্যে, ভারতের মোট মেডিকেল ভিসার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশই বাংলাদেশিদের দেওয়া হতো। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশি রোগী আসা কমে যাওয়ায় ভারতের মোট মেডিকেল পর্যটনের আয় ৩০-৩৫ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অভাব। রোগ শনাক্তকরণব্যবস্থা সঠিক না হওয়া, চিকিৎসকদের অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাব, সার্জিক্যাল রোগীদের ক্ষেত্রে পোস্ট অপারেটিভ চিকিৎসাসেবা ভালো না হওয়ার জন্য রোগীরা দেশের বাইরে চিকিৎসায় আগ্রহী। মূলত বাংলাদেশি রোগীরা ট্রান্সপ্ল্যান্ট, কার্ডিওলজি, নিউরোলজি, অর্থোপেডিকস, গাইনোকোলজি ও অনকোলজির মতো চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যান। মো. ওমর ফারুক নামে এক ব্যক্তি জানান, সন্তানের চিকিৎসার জন্য তিনি দুই মাস ভারতের মেডিকেল ভিসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছেন। তিনবার আবেদন করার পরও কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই তাঁর ভিসা আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়। হতাশ হয়ে ফারুক এখন সন্তানকে চীনে নিয়ে চিকিৎসা করানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের চিকিৎসা পর্যটনের বাজার ধরতে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে চীন। দেশটির ইউনান প্রদেশের চারটি শীর্ষ পর্যায়ের হাসপাতাল বিশেষভাবে বাংলাদেশি রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে চীন সরকার দেশটির কুনমিং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হাসপাতাল এবং ইউনান ফার্স্ট পিপলস হাসপাতালটিতে বাংলাদেশিদের সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে। চীনের পাশাপাশি বাংলাদেশিদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে আগ্রহী থাইল্যান্ডও। ব্যাংককভিত্তিক মেডিকেল ও ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান সুয়া নোই ফিট অ্যান্ড ফ্লাইয়ের ম্যানেজার মাজেদুল নয়ন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভারতের ভিসা বন্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশিরা চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে প্রচুর যোগাযোগ করছেন। উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি উচ্চমধ্যবিত্ত যে রোগীরা আগে ভারতে যেতেন তাঁরা এখন ব্যাংককে চিকিৎসাসেবার জন্য আসছেন।’
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনস অব বাংলাদেশের (টোয়াব) পরিচালক (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স) মো. মানসুর আলম পারভেজ বলেন, ‘চীন, থাইল্যান্ড, নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই ও সৌদি আরবেও বাংলাদেশিদের কেউ কেউ চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে এখন রোগীরা নেপালের কাঠমান্ডুতেও চিকিৎসা নিতে শুরু করেছেন।’