নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা-সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও এ-সংক্রান্ত আবেদনের ওপর শুনানি শেষ হয়েছে। ২০ নভেম্বর রায় ঘোষণার তারিখ রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত। গতকাল চূড়ান্ত শুনানির শেষে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রায়ের জন্য এদিন ধার্য করেন। সেদিন জানা যাবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান সংবিধানে ফিরছে কি না, ফিরলে কীভাবে ফিরবে এবং তা কবে থেকে কার্যকর হবে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের প্রত্যাশা, চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সম্ভাব্য কার্যকারিতা রেখে আপিল মঞ্জুর করেই রায় দেবেন সর্বোচ্চ আদালত। শেষ দিনের শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল তেমনটাই বললেন সাংবাদিকদের। তিনি বলেন, ‘এই সরকার বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মহাসড়কে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে নিরন্তর সংগ্রাম এবং নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে, এখানে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই। সুতরাং এই সরকারকে কন্টিনিউ করে সামনের নির্বাচন (ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন) করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটা চতুর্দশ সংসদ নির্বাচন থেকে কার্যকর করা হোক বলে সবাই কমবেশি উপসংহারে উপনীত হয়েছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে আনা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে ১৪ বছর আগে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রায় দিয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায়, আদালতের রায়ের পর তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী এই সরকারব্যবস্থা বাদ দেয় শাসনতন্ত্র থেকে।
গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি আপিল বিভাগে আবেদন করেন। এরপর গত বছরের অক্টোবরে আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তারপর ওই মাসে আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর আরেকটি আবেদন করেন। এ ছাড়া হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠন রিভিউ আবেদন করে। সেন্টার ফর ল’ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের অপর একটি সংগঠন এ মামলায় ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উ™ূ¢ত আপিলের সঙ্গে রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে আপিল শুনানির জন্য ২১ অক্টোবর দিন ধার্য করেন আদালত। এ অনুসারে ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। দশম দিনে গতকাল শুনানি শেষে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করলেন।
আদালতে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরীফ ভূঁইয়া, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কারিশমা জাহান। বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও মো. রুহুল কুদ্দুস শুনানি করেন। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। এ মামলায় আপিলে ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন।
গতকাল শুনানি শেষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, শুনানিতে একটা প্রশ্ন এসেছিল জাজমেন্ট কি রেট্রোস্পেকটিভ (এখন থেকে কার্যকর হবে) না প্রসপেক্টিভ (পরবর্তী সময় থেকে কার্যকর) হবে। সেখানে আমি ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত মামলা, গোলকনাথের মামলার রেফারেন্স দিয়ে বলেছি, জাজমেন্ট ইজ অলয়েজ রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্ট, আনলেস কোর্ট গিভস প্রকপেক্টিভ ইফেক্ট (রায় সব সময়ই ভূতাপেক্ষ হয়, যদি না আদালত রায়ের সম্ভাব্য কার্যকারিতা নির্ধারণ করে দেন)। আর আইন সব সময়ই সম্ভাব্য হয়, যদি না সংসদ আইনের পূর্ববর্তী কার্যকারিতা নির্ধারণ করে দেয়। এটা হচ্ছে মূল তত্ত্ব।’
সাংবিধানিক আইন নিয়ে প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের লেখা বই থেকে উদ্ধৃত করে দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বলেন, এই বইয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, কোন কোন ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট জাজমেন্টকে প্রসপেক্টিভ ইফেক্ট (সম্ভাব্য কার্যকারিতা) দিতে পারেন। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার থাকবে না তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে, সেই দ্বন্দ্ব পরিহার করার জন্য ক্লিয়ার গাইডলাইন ওইখানে (মাহমুদুল ইসলামের বইয়ে) দেওয়া আছে লোকনাথ মামলার রায়ের আলোকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রসপেক্টিভ (সম্ভাব্য) হবে এবং প্রসপেক্টিভ হলে এটা আগামী নির্বাচন থেকে কার্যকর হতে পারে। এটাই আমাদের আন্ডারস্টেন্ডিং (বোঝাপড়া)। এখন আদালত সাবমিশনগুলো কীভাবে নিয়ে, কীভাবে রায় দেবেন, এটা আদালতের ব্যাপার।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রত্যাশা কী, জানতে চাইলে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমি আশা করি আমার সাবমিশন (শুনানি) সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করবে। আমার সঙ্গে অন্য যারা সমস্বরে যুক্তিতর্ক শেষ করেছেন, রাষ্ট্রপক্ষের আকাক্সক্ষা সব যুক্তিতর্ককে ধারণ করে আপিল বিভাগ রায় দেবেন।’