বাংলাদেশ প্রাণরসায়ন সমিতির নবম জাতীয় সম্মেলনের মাননীয় সভাপতি, মান্যবর প্রধান অতিথি, যিনি শিক্ষকের শিক্ষক এবং গুরুর গুরু জাতীয় অধ্যাপক এম. আর. খান, শিশুবন্ধু হিসেবে যিনি সুপরিচিত, অধ্যাপক এম ইসহাক, অধ্যাপক মো. সোহরাব আলী, মেজর জেনারেল দেবাশীষ সবাহা, অধ্যাপক সাহাদত হোসেন, অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ খান, অধ্যাপক মাহবুবুল হক, অ. মো. মোজাম্মেল হক, খ. আবু রায়হান, সম্মানিত বিশেষ অতিথিবৃন্দ, প্রীতিভাজন গবেষকমণ্ডলী ও রসায়নবিদগণ, বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ ও শ্রদ্ধেয় সুধীজন, শুভ সন্ধ্যা। বাংলাদেশ বায়োকেমিস্ট সোসাইটির ২০১৪ সালের নবম কনফারেন্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়ায় আমি সোসাইটির সদস্যদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমার বক্তব্যে অসঙ্গতিপূর্ণ কিছু থাকলে তার জন্য আমি অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আর যদি কিছু তথ্য থাকে তার কৃতিত্ব আমার শিক্ষকদের, ক্লাস প্রশিক্ষণদাতা রোলমডেলদের। যাদের কয়েকজন আমার মডেল শিক্ষক এখানে উপস্থিত আছেন। আমি আজও সবার কাছ থেকে শিক্ষালাভ করছি।
আজকের সম্মেলন আমাকে মনে করিয়ে দেয়, ২০১১ সালের সানফ্রান্সিসকোতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান একাডেমি অব অটোল্যারিংগোলজি এবং হেড-নেক সার্জারির সম্মেলনের কথা। সেই সম্মেলনের প্রধান অতিথি কোনো মন্ত্রী, মেয়র, গভর্নর, সিনেটর বা রাষ্ট্রপতি কিংবা উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন না। যিনি প্রধান অতিথি বা মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন তিনি ‘Children of the Lesser God’ ছবির অভিনেত্রী মিস মারলি মাটলিন (Ms Marlee Matlin)। তিনি ‘Children of the Lesser God’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সম্ভবত ৫টি অস্কার পেয়েছিলেন। কেন তাকে দিয়ে এই সম্মেলন উদ্বোধন করা হয়েছিল? কারণ তিনি একজন রোলমডেল! যাকে অনুসরণ করা যায়। কীসের রোলমডেল? জন্মগত বধির ও বোবা হয়েও তিনি সমাজের যে স্তরে নিজেকে আসীন করতে পেরেছিলেন, তা মানুষের কল্পনাতীত। অধ্যবসায়, চেষ্টা, নিরলস পরিশ্রম আর লক্ষ্য স্থির থাকলে মানুষ কোথায় যেতে পারে, সেটুকু বোঝানোর জন্যই বোধ হয় তাকে প্রধান অতিথির আসন দেওয়া হয়েছিল।
আজকের যিনি প্রধান অতিথি তিনিও হলেন তেমন একজন ব্যক্তিত্ব, সেবক ও চিকিৎসক, দেশ ও জাতি আজও তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। বয়স, আজ অধ্যাপক এম আর খানের কাছে হার মেনেছে। ২০১১ সালের সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনের মূল প্রবন্ধ এবং সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘোষণার পরে সোসাইটির সভাপতি তাকে যে স্বর্ণপদক স্মারক উপহার হিসেবে দেন, সেটা হাতে নিয়ে তার নিজস্ব ভাষায় অর্থাৎ ইশারা ভাষায় (Sign language) বললেন ‘Does it make me a doctor’ এবং ডাক্তারদের উপদেশ দিলেন ‘Support the patient, not just treat’ 'রোগীদের সাহায্য ও সহানুভূতি দাও, শুধু চিকিৎসা নয়'।
জ্ঞানী ব্যক্তির একটা উদাহরণ না দিলে আমার বক্তব্য যেমন থাকবে অসমাপ্ত, তেমনি আমি রয়ে যাব অকৃতজ্ঞ। ‘Children of the Lesser God’-এর বাংলা কী হবে তা নিয়ে আমি আমার সমসাময়িক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক জ্ঞানী এবং পণ্ডিত শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেউ আমাকে সুন্দর একটি বাক্য দিতে পারেননি, যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি অর্থাৎ ৩৪ জন উপাচার্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন) পরিষদের সভাপতি হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান স্যার এবং কনভোকেশন বক্তা প্রয়াত অধ্যাপক কবির চৌধুরী স্যারের সঙ্গে একই হেলিকপ্টারে চড়ে। কপ্টারে বসে কবীর চৌধুরী স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনি কি ‘Children of the Lesser God’ বইটি দেখেছেন? জবাব, কয়েকবার দেখেছি। পরবর্তী প্রশ্ন স্যার এর বাংলা কী হবে? সেকেন্ডের মধ্যে জবাব, 'বৈমাত্রেয় ঈশ্বরের সন্তানেরা'। আবারও প্রশ্ন করলাম, স্যার ঈশ্বর কি বৈমাত্রেয় হয়? জবাব দিলেন, একটা উদাহরণ টেনে, দেখ আমি কবীর চৌধুরী, আমার ভাই মুনীর চৌধুরী। আমরা দুজন যথাক্রমে ইংরেজি এবং বাংলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতাম। মুনীর চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী ডেকে নিয়ে হত্যা করল, যারা হয়তো বা তার ছাত্র। আমি আশি ঊধর্্ব বেঁচে আছি। একটু আগে আমার মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক অধ্যাপক শাহীন মাহবুব কবীর আমাকে এনে হাতে ধরে কপ্টারে বসিয়ে দিয়ে গেল। এখন চিন্তা কর নিশ্চয়ই আমার মেয়ের মনে খুব গর্ব, তার বাবা Convocation Speaker হয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যাচ্ছে। ঈশ্বর কী মহান। কিন্তু মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী এবং সন্তানের কাছে ঈশ্বর কী বলে মনে হবে? নিশ্চয়ই বৈমাত্রেয় আচরণসুলভ। মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমান স্যার আলোচনায় যোগ দিয়ে বললেন, 'ঠিক বৈমাত্রেয় ঈশ্বরের সন্তানেরা না বলে, বরং 'কৃপাহীন ঈশ্বরের সন্তানেরা' বলা বোধ হয় ঠিক হবে এবং কবীর চৌধুরী স্যারও মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। আমি সেই আলোচনাক্ষণটা কখনো ভুলতে পারব না। জ্ঞানীর সংস্পর্শ যে কী আশীর্বাদ, আমি আজও তা উপলব্ধি করি। আজও কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের প্রণতি জানাই। আশীর্বাদ চাই, আমাকে মানুষ হওয়ার আশীষ দিও। কবীর চৌধুরী স্যার তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আমার মতো ছাত্র পেয়ে আরেকটি উদাহরণ দিলেন। সেটা হল- ধর, একই মায়ের পেট থেকে দুজন সন্তান জন্ম নিয়েছে, একই পরিবেশে। একজন সম্পূর্ণ সুস্থ, অন্যজন জন্ম থেকে অন্ধ বা বোবা। তারা কিন্তু নিষ্পাপ। যে সুস্থ তার জন্য স্রষ্টা নিশ্চয়ই মহান, কিন্তু যে বোবা বা অন্ধ তার জন্য স্রষ্টা কী?
আপনাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও আমি এই ফোরামে এটাকে যুক্তিনির্ভর ও বিবেকপ্রসূত বলে মনে করছি। কারণ আমার বক্তব্যের মধ্যে আমি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি। অধ্যাপক এম আর খানের মতো একজন ব্যক্তি আজ প্রধান অতিথি।
একবিংশ শতাব্দী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শতক। বিজ্ঞান বলতে সাধারণত যা বুঝায় তা হলো- গণিত, পদার্থ, রসায়ন এবং প্রাণরসায়ন ও মেডিকেল জেনেটিক। আজকের সম্মেলনের কোনো স্লোগান বা থিম না থাকলেও প্রাণরসায়ন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অপরিহার্য অংশ। জীবন ধারণ, জীবন পরিবর্তন, এমনকি অনেক রোগের চিকিৎসায় প্রাণরসায়ন এবং বায়োটেকনোলজি অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এমনকি বায়োকেমিস্ট্রি এবং মেডিকেল মাইক্রোবায়োলজি এবং তার Safety ল্যাবরেটরি (Biosafety) দিয়ে পরিবেশকেও কলূষমুক্ত করা যেতে পারে। শক্তি ও পরিবেশ এ দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা অর্জন করেই মানুষ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে। এ ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্বের বলেই এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর ওপর, এক সমাজ অন্য সমাজের ওপর এবং এক দেশ অপরাপর দেশের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে।
সমগ্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণাতে অংক বা পরিসংখ্যান, মেডিকেল ফিজিকস, মেডিকেল জেনেটিকস এবং প্রাণরসায়ন ব্যবহার করে শক্তি, পরিবেশ ও মানবদেহের রোগ নির্ণয়, রোগ নিরাময় ও রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে। জীবন ধারণে পানির মতো, বায়োকেমিস্ট্রি সর্ব বিষয়ে অপরিহার্য। অন্যদিকে Genetic Technology এবং Biotechnology I Biosafety সব রকম গবেষণাতেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সমগ্র বিশ্বকে আমাদের দোরগোড়ায় আনয়নকারী তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ বিজ্ঞান কিংবা বিস্ময় জাগানো জেনোম বিজ্ঞানেরও হাতিয়ার মেডিকেল ফিজিঙ্ এবং মেডিকেল বায়োকেমিস্ট্রি। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য আমাদের দেশে মেডিকেল বায়োকেমিস্ট্রি খুব দ্রুত উন্নতি করছে না, উন্নত বিশ্বের তুলনায়, যার প্রধান কারণ আর্থিক অর্থাৎ পর্যাপ্ত Technology purchase এবং গবেষণা ফান্ডের অভাব। তা ছাড়াও উন্নত বিশ্বের অনেক বৈপরীত্য আমাদের মধ্যে জেনেটিকেলি বিদ্যমান। উন্নত দেশেগুলোর উন্নয়নের কারণ, সেখানকার জনগণের প্রাইমারি থেকে সর্বস্তরের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গুণ আছে, যেগুলো নিম্নরূপ : (ক) মিথ্যা কথা না বলা, (খ) খুব পরিশ্রম করা এবং (গ) নিজের কাজে ফাঁকি না দেওয়া (যা এদেশের সব পেশাতেই লক্ষ্য করা যায়)।
এক সময় ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা নির্ভেজাল ছিল। সার্বিক বিজ্ঞান শিক্ষা পদ্ধতি অতি উন্নত ছিল বলেই তারা উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম পর্যন্ত শাসন করেছিল এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক, গবেষক নিয়োগ ব্যবস্থা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হয়ে থাকে। পৃথিবীর Best available candidate-কে নিয়োগ প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে সবচেয়ে বড় শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এর প্রতিফলন আমরা যুক্তরাষ্ট্রে নোবেল বিজয়ীর ক্রমবর্ধমান সংখ্যাতে দেখতে পাই। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য ব্রিটিশদের প্রজা হিসেবে আমিও মেধার মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছি কোনো কোনো ক্ষেত্রে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সূত্রপাত রোগব্যাধির কার্যকারণ বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। নানা ধরনের প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পদ্ধতি দ্বারা রোগব্যাধি চিকিৎসার ব্যবস্থা মানব সভ্যতার শুরু থেকেই ছিল। কিন্তু রোগ উৎপত্তির ভৌত কারণ বা Physical causes বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এর চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া মাত্র কয়েক শতাব্দীর ফসল। এ বৈপ্লবিক অগ্রগতির পেছনে রয়েছে ফিজিওলজিক্যাল ও প্যাথলজিক্যাল অবস্থায় ভৌত কার্যকারণের অন্তরালে প্রাণরাসায়নিক বা Biochemical কার্যকারণের উদ্ঘাটন। এই প্রাণরসায়নের হাত ধরেই পরে জন্ম হয়েছে এর দুই কন্যা সেল বায়োলজি ও মলিকিউলার বায়োলজির, যার প্রায়োগিক সন্তান বায়োটেকনোলজি বদলে দিচ্ছে বর্তমান জগৎ ও সভ্যতার চেহারা। বায়োকেমিস্ট্রি, সেল বায়োলজি ও মলিকিউলার বায়োলজি- এই পরিবারটি তাই প্রকৃত অর্থে আলাদা আলাদা কোনো বিষয় নয়, এগুলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের সব শাখার সাধারণ সম্পদ; এগুলো বায়োমেডিকেল বিজ্ঞানের 'সর্বজনীন ভাষা'। Ellen Johnson Sirleaf বলেছিলেন, ‘The 3 H’s of Honesty, Hard work and Humility are guidelines for a great leader’ এ কথা একজন Greatest Scientist এর জন্যও প্রযোজ্য। Mike Adams এর মতে, ‘Organic Chemistry is the Chemistry of carbon compound. Biochemistry is the study of carbon compounds that crawl’. পরিশেষে, বিজ্ঞানের যে কোনো বিকল্প নেই, উন্নতির একমাত্র এবং প্রধান সোপান যে শুধু বিজ্ঞান তা উপমহাদেশের নোবেল বিজয়ীর বক্তব্যের মধ্য থেকেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি : নোবেল বিজয়ী স্যার চন্দ্র শেখর রমণ বলেছিলেন, ‘There is only one solution for India’s Economic problems and that is science and more science and still more science’.
প্রাণরসায়নই চিকিৎসাবিজ্ঞান ও চিকিৎসা সভ্যতার উন্নয়নের একমাত্র হাতিয়ার এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাণ্ডারি। প্রধান অতিথির প্রতি কৃতজ্ঞতা, সোসাইটিকে ধন্যবাদ ঠিক সময়ে এ সম্মেলন শুরু করার জন্য, যা ব্যতিক্রম এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনা। (বাংলাদেশ প্রাণরসায়ন সমিতির নবম জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য)।
লেখক : উপচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।