১৩ আগস্ট, ২০১৭ ১৩:৩০
জনকণ্ঠে প্রকাশিত সেই চাঞ্চল্যকর তথ্য

শেখ কামালের পাশে সেদিন ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু

অনলাইন ডেস্ক

শেখ কামালের পাশে সেদিন ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু

শেখ কামাল ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু

দীর্ঘ ৩৩ বছর আগের ঘটনা। কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকা সত্বেও একটি গুজব রয়েছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে শেখ কামাল নাকি ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মাঝে এ ঘটনার নিষ্পত্তি না হলেও ঘটনার ৩৩ বছর পর উপস্থাপিত হয় প্রকৃত সত্য। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক অবাক করার মতো ঘটনার একটি শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি প্রসঙ্গে সবিস্তারে বার্তা সংস্থা এনাকে বলেছেন সেই রাতে শেখ কামালের সঙ্গে থাকা এবং বর্তমানে সপরিবারে আমেরিকায় বসবাসরত লসএঞ্জেলেস প্রবাসী আবুল ফজল মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান।
 
লসএঞ্জেলেস প্রবাসী হান্নান বহুল বিতর্কিত ঘটনাটির ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছিলেন না, আবার এমন একটি বিষয় সম্পর্কে দেশবাসীকে না জানালেও তিনি শান্তি পাচ্ছিলেন না, এমন দ্বন্দ্ব তাঁর হ্নদয়কে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। অবশেষে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য জনাব নাসির উদ্দিন পিন্টুর বক্তব্য তাঁর নীরবতা ভাঙ্গতে সহায়ক হয়েছে। আব্দুল হান্নান শেখ কামালের বাল্যবন্ধু এবং সর্বক্ষণিক ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন আমৃত্যু।
 
হান্নান বলেন, ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাত প্রায় ১১ টা। পরদিন বিজয় দিবস এবং সেটি ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিজয় বার্ষিকী। তাই সারারাত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছিলো। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকা যেন আনন্দে নাচছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন ঈদের আনন্দে বিজয়ের উৎসব আসছে আর ক’ঘন্টা পরই। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও বেশ চাঙ্গা ছিলেন। তিনি বলেন, এখানে স্মরণ রাখা দরকার যে, সে সময় পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা চলছিলো।
 
তিনি বলেন, সে সময় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিপক্ষ ছিলো জাসদ। তিনি আরও বলেন সিরাজ সিকদার বিজয় দিবস মানতেন না। তিনি মনে করতেন দেশের পূর্ণাঙ্গ বিজয় হয়নি। অতএব, কীসের বিজয় দিবস? সে ধারণার বশবর্তী হয়েই ওরা (সর্বহারারা) ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় দু’টি বোমা মেরেছিলো। এর একটি বাংলার বাণী (অধুনালুপ্ত দৈনিক এবং মালিক ছিলেন শেখ কামালের ফুফাত ভাই শেখ মণি) অফিসে এবং অপরটি বিস্ফোরিত হয় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স অফিসে। বোমা দু’টি একটি লাল টয়োটা গাড়ি থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো বলে খবরে প্রকাশিত হয়।
 
আবাহনী ক্লাবের ভক্স ওয়াগন সাদা মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করতেন বন্ধুদের নিয়ে চলাফেরা এবং আড্ডার জন্য। ঠিক তেমনিভাবে সেই রাতেও ঢাকা ট্রিচারস ট্রেনিং কলেজের বিপরীতে ৩০ নম্বর মিরপুর রোডে ছাত্রলীগ অফিস থেকে আবাহনী ক্লাবের ভক্স ওয়াগন সাদা মাইক্রোবাসে ১০ বন্ধু চেপে বসেন। সঙ্গে ছিলেন আরও ৫ জন। কিন্তু একই মাইক্রোবাসে জায়গা না হওয়ায় আরেকটি জীপ নেয়া হয়। সেটি ছিলো রেজাউলের (কামালের বন্ধু) পারিবারিক গাড়ি। মাইক্রোবাসকে অনুসরণ করে জীপটি। ছাত্রলীগ অফিস থেকে উভয় গাড়ি যাত্রা শুরু করে মোহাম্মদপুরের দিকে।
 
সাদা মাইক্রোবাসটি ড্রাইভ করছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র শাহান চৌধুরী (বর্তমানে, ২০০৫ সালের) আমেরিকায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শমসের মবিন চৌধুরীর ছোট ভাই), তাঁর পাশে অর্থাৎ সামনের সারির মধ্যখানে বসেছিলেন ঢাবি সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র কাজী আনোয়ারুল হক তারেক (সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন এবং গত বছর আবহনীর যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন), সর্বডানে বসেছিলেন ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র শেখ কামাল।
 
দ্বিতীয় সারিতে বসেছিলেন (ড্রাইভার সিটের পেছনে, বাম থেকে) ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র আমি, আবুল ফজল মোহাম্মদ আব্দুল হান্নান, নিজে, মাঝখানে সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র, কিছু কাল জার্মানিতে ছিলেন এবং বর্তমানে শুল্ক বিভাগের সুপারিনটেডেন্ট রুহুল আমিন খোকা, ডানে বসেছিলেন ঢাবির পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র মুনির (কানাডা প্রবাসী),
 
তৃতীয় সারিতে (বাম থেকে) ঢাবির সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু (বর্তমানে (২০০৫) কৃষি প্রতিমন্ত্রী), মাঝখানে বরকত- ই খোদা (তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না তবে শেখ কামালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো এবং প্রায় সময় একত্রে আড্ডা দিতেন, বর্তমানে (২০০৫) বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের জেনারেল ম্যানেজার) এবং ডানে ছিলেন চুয়াডাঙ্গার সন্তান কাজী সিরাজ।
 
মাইক্রোবাসে সিট ছিলো ৯টি। এজন্য খোকা নামক আরেকজন আকারে ছোটখাটো ছিলেন বিধায় লাফ দিয়ে পেছনের লাগেজ স্পেসে বসেছিলেন।
 
অপর গাড়িতে ছিলেন ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র এবং বর্তমানে (২০০৫) ব্যবসায়ী রেজাউল করিম, শাহেদ রেজা (বর্তমানে (২০০৫) আঃ লীগ নেতা), শেখ রফিক (বর্তমানে, (২০০৫) ব্যবসায়ী), আক্কাস (বর্তমানে (২০০৫) ব্যবসায়ী) এবং মন্টু (যিনি ইন্তেকাল করেছেন)।
 
হান্নান বলেন, ভ্যানটি মোহাম্মদপুর হয়ে মিরপুর দিয়ে ঘুরে সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে ফার্মগেট থেকে বাংলা মোটর প্রদক্ষিণ করছে। সে সময় শীতকাল ছিলো। ট্রাফিকও হালকা ছিলো। দোকানপাটও বন্ধ। মাইক্রোবাস ভর্তি বন্ধুরা হৈহুল্লুড় করতে করতে মালিবাগ, রাজারবাগ হয়ে টিএ্যান্ডটি কলেজের সামনে দিয়ে ইত্তেফাক অফিসের দিকে চলছিলো। পরিকল্পনা ছিলো গুলিস্থান হয়ে আবার ছাত্রলীগ অফিসে ফিরে যাওয়ার। মাইক্রোবাস এগুচ্ছিলো শাপলা চত্বরের দিকে।
 
এমনি অবস্থায় মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন দেখেন যে বিপরীত দিক থেকে একটি লাল গাড়ি তাদের অতিক্রম করে চলে গেল। সে গাড়িতে কয়েকজন মুখ ঢাকা। মাইক্রোবাসের বন্ধুরা ভাবল হয়ত সিরাজ সিকদারের লোক হবে। সঙ্গে সঙ্গে মাইক্রোবাস ইউ টার্ন করে ঘুরিয়ে ঐ লাল গাড়িকে অনুসরণ করল।
 
তারা ধারণা করেছিলেন, পরদিনের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানকে বানচালের নতুন কোন ষড়যন্ত্র করেছে। কেননা আগের রাতেও ওরা বোমাবাজি করে জনজীবনকে সন্ত্রস্ত করেছে। গাড়িটির গতিরোধ করা হয়। দেখা গেল সেটি টয়োটা নয়। ঐ গাড়ির যাত্রীরা বললেন যে কাজ শেষে ঘরে ফিরছেন। শীতের কারণে মাফলার দিয়ে মুখ ঢাকা হয়েছে। ওরা চলে গেল। এমন সময় টুকু দেখতে পান যে নিকটেই আল হেলাল হোটলের সামনে লাল রঙ্গের একটি টয়োটা গাড়ি। সে গাড়িটি তাদের লক্ষ্য করছে।

হান্নান বলেন, এ অবস্থায় আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি ধীরে ধীরে ঐ গাড়ির দিকে এগুতে থাকে। এ সময় লাল টয়োটা সামনের দিকে চলতে থাকে। টয়োটা ক্রমশ স্পীড বাড়িয়ে দিল মাইক্রোবাসকে আড়ালে রেখে অন্যত্র যাবার মতলবে। টয়োটা এগুচ্ছে কমলাপুর হয়ে কবি জসীমউদ্দীন রোড দিয়ে ছোট্ট ব্রিজ পার হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে।
 
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশেই মুসলিম লীগের প্রাক্তন এমএনএ ওবায়দ্জ্জুামানের বাসা ছিলো। স্বাধীনতার পর সরকার সেটি দখল করে নেয় এবং সে বাড়িতে স্পেশাল ব্রাঞ্চের ২ নম্বর ফাঁড়ি স্থাপন করা হয়। টয়োটা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসের দিকে যাচ্ছিলো। পরে জানা গেছে, টয়োটায় ছিলেন সার্জেন্ট শামীম কিবরিয়া। তিনি ফাঁড়িতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সকল আলো নিভিয়ে দেয়া হয় এবং সকলকে পজিশন নিতে নির্দেশ দেন ওয়াকিটকির মাধ্যমে।
 
সঙ্গে সঙ্গে স্পেশাল ব্রাঞ্চের সশস্ত্র লোকজন বাড়িটির ছাদে ও বিভিন্ন অবস্থানে যান এবং টয়োটা একেবারে অফিসের ভেতরে ঢোকে। টয়োটাকে অনুসরণ করে মাইক্রোবাসটিও ভেতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে টয়োটার স্টার্ট বন্ধ করা হয় এবং মুহূর্তে এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন অবিরতভাবে গুলি চালায়। ছাদের উপর থেকে থ্রী নট থ্রী’র গুলি মাইক্রোবাসের ছাদ ভেধ করে ভেতরে ঢোকে এবং কয়েকটি গুলি শেখ কামালের বাম পাশের কলারে লাগে। ৪টি গুলি কলার বোনের ভেতরে ঢোকে। ভ্যানের আরও ৫জন গুলিবিদ্ধ হয়। একজনের হাতের ৪টি আঙ্গুল উড়ে যায়। কারোর পিঠে গুলি লাগে। একজনের পায়ে এবং আরেকজনের ঠোঁটে লাগে গুলি।
 
সৌভাগ্যক্রমে আমি (হান্নান), রুহুল, খোকা এবং টুকু গুলি থেকে বেঁচে যাই। জনাব হান্নান বলেন, মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ছেলে টুকু বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণের সময় চিৎকার করে বলেন যে এটা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিস। সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামাল আরো জোরে চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘আমি শেখ কামাল’।
 
এ কথা শুনে সার্জেন্ট গুলি বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েই দৌড়ে মাইক্রোবাসের কাছে আসেন এবং ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করেন। সার্জেন্ট বলেন, আমাদের ভুল হয়েছে। আমি বুঝতে পারিনি, আমাকে মাফ করে দিন।
 
এমনি অবস্থায় রেজাউল আহতদের জীপে তুলে সোজা চলে যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। তাৎক্ষণিকভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শেখ কামালের দেহ থেকে ৩টি বুলেট বের করা সম্ভব হয়। অপর বুলেটটি পরবর্তীতে মস্কো থেকে অপসারণ করে আনা হয়েছিলো। জনাব হান্নান বলেন, আমাদের মাইক্রোবাসটিতে কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি বলে সে সময়কার মিডিয়াসহ প্রশাসন অবহিত করেছিলো।
 
ভোররাত পর্যন্ত হাসপাতালে আহতদের নিয়ে চিকিৎসক এবং আহদের পরিবাবর্গ মহা টেনশনে ছিলো। সকালে বিজয় দিবসের মহাসমাবেশে জাসদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় যে, শেখ কামাল দলবল নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সারাদেশে খবরটি বাতাসের চেয়েও দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে। জনাব হান্নান বলেন, সেই থেকে ঘটনাটি রহস্যাবৃত্তই রয়ে গেছে। আজ অবধি কেউ সে ঘটনার পক্ষে বা বিপক্ষে কোন আলামত-প্রমাণাদি উপস্থাপন করেননি।
 
আমি তাই বাধ্য হলাম ঐতিহাসিক একটি মিথ্যাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য। কেননা ঐ মাইক্রোবাসে শেখ কামালের সঙ্গে যাঁরা ছিলাম তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন স্তরে রয়েছি। রাজনৈতিকভাবে পরস্পরের বিপক্ষে অবস্থান করলেও অন্তত ঐ ব্যাপারে কেউ সত্যকে আড়াল করতে চাইবেন না। কেননা শেখ কামালের মতো বিশ্বস্ত বন্ধু আমরা আর কখনও পাইনি।

সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ (১২-১০-২০০৫)

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর