কাল পহেলা ফাল্গুন। ঋতুরাজ বসন্তবরণে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ আনন্দে মেতে উঠবে। বাসন্তী রঙের শাড়ির সঙ্গে তরুণীরা সাজবে বাহারি রঙের ফুল দিয়ে। পরদিনই ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভালোবাসার বার্তা নিয়ে হাজির হবে ভ্যালেন্টাইন’স ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। শুধু ফাগুন হাওয়ায় ভালোবাসায়ই নয়, আসছে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
প্রতিবছর এ তিন দিবসে ফুল অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙালির জীবনে। এ সময় ফুলের চাহিদা সারা বছরের চেয়ে বেশি থাকে। আর এ দিবসগুলো ঘিরে রমরমা হয়ে ওঠে ফুলের বাণিজ্য। এ সময় ফুলের ব্যবসার সবচেয়ে বড় সুযোগ বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
বাজারে ফুল সরবরাহে মাঠ পর্যায়ে চাষি থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা ফুলের বাজার এখন পুরোদমে প্রস্তুত। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় দেশে ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। এ কারণে বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দেশে মোট ২০০ কোটি টাকা বা তারও বেশি ফুল বাণিজ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এর মধ্যে মাঠপর্যায়ে যশোরের গদখালি ও সাভারের বিরুলিয়ার সাদুল্লাহপুর ও ধামরাইয়ের বিভিন্ন ইউনিয়নে এ দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে প্রায় ৬০-৭০ কোটি টাকার ফুল বাণিজ্য হবে। বাকিটা রাজধানীর শাহাবাগ ফুলের বাজারসহ দেশের অন্যান্য স্থান পূরণ করবে।
কয়েক বছর আগেও দেশে ফুলের বাজারে হাতেগোনা কয়েক ধরনের ফুল পাওয়া যেত। বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ বেশি হওয়ায় এবং আমদানি করায় বাহারি রঙের ফুল পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে জারবেরা, গ্লাডিওলাস, অর্কিড, কসমস, ডালিয়া, টিউলিপ, কালো গোলাপ, ঝুমকা লতা, গাজানিয়া, পামেরিয়া, চন্দ্রমল্লিকা অন্যতম। দামও হাতের নাগালে। কিন্তু এই বিশেষ দিনগুলোয় ফুলের চাহিদা বেশি থাকায় অতি মুনাফার লোভে বেশি দামে ফুল বিক্রি করেন বিক্রেতারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রতিনিয়ত দেশে ফুল উৎপাদন বাড়ছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে ফুল উৎপাদন হয় ২৬৪ কোটি ৫ লাখ ৮৭ হাজার ২৪০টি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এই পরিমাণ বেড়ে হয় ২৭৩ কোটি ৩৪ লাখ ৮ হাজার ৩৩১টি ফুল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২৯৪ কোটি ১৪ হাজার ৭৭৬টি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৯৮ কোটি ৩৪ লাখ ২০ হাজার ৭৬৮টি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০৬ কোটি ৯৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩৩টি। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে ফুল উৎপাদন হয় ৩২০ কোটি ৯০ লাখ ৭৪ হাজার ৬৬টি।
সাভারের সাদুল্লাহপুর ইউনিয়নের (গোলাপ গ্রাম) ফুলচাষী আমজাদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশেষ করে এ তিন দিবসে ফুল বেশি বিক্রি হয়। ঢাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ও খুচরা ফুল ব্যবসায়ীরা সরাসরি বাগান থেকে ফুল নিয়ে যান। ধামরাই রুপনগর এলাকার ফুলচাষী ফারুক হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে ফুল বেশি বিক্রি হয়। এতে একটু লাভ বেশি হয়, যা বছরের অন্য সময় হয় না। আর এ সময় ফুলচাষীদের মনে আনন্দ থাকে। যে দামে মাঠ থেকে আমরা ফুল বিক্রি করি, তা খুচরা বাজারে দুই থেকে তিনগুণ বেশিতে ক্রেতাদের কিনতে হয়। এতে লাভ যা করার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা করে।
এদিকে সারা দেশের খুচরা বিক্রেতারা রাজধানীর শাহবাগ, ফার্মগেট ও আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ফুলের পাইকারি মার্কেট থেকে ফুল কিনে থাকেন। রাজধানীর এসব বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অন্য দিনের চেয়ে শুক্রবার ও শনিবার বিক্রি অনেক বেশি হয়। প্রতিদিন শুধু রাজধানীর পাইকারি বাজারে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ফুল কেনাবেচা হয়। আর বিশেষ দিবস যেমন পহেলা ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবসে ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। এছাড়া রাজধানীর শাহবাগে সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার। এখানে ফুলের দোকান ১২০টি এবং খুচরা বিক্রেতা আছে শতাধিক।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এবারের ভালোবাসা দিবসে রাজধানী ঢাকায় যে কয়েক কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে তার সিংহভাগই হবে শাহবাগে। মঙ্গলবার সরেজমিন সাভারের গোলাপ গ্রামে ফুলের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের ফুল দোকানে তুলেছেন। সাভারের বিরুলিয়ার বিভিন্ন স্থানের স্থায়ী ও ভাসমান ফুল ব্যবসায়ীরা ভিড় করছেন বিরুলিয়ার ফুলের দোকানে। ব্যবসায়ী ছাড়াও সাধারণ মানুষ ফুল কিনতে চলে এসেছেন। এর মধ্যে তরুণ-তরুণীদের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সহ-সভাপতি পুষ্প বিতানের মালিক লোকমান হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীর শাহবাগসহ অন্যান্য বাজারে ট্রাকভর্তি ফুল আসতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে তিন দিবসকে ঘিরে ফুল বেচাকেনাও জমে উঠেছে। এ বছর খুচরা ও মৌসুমি বিক্রেতারা আগেভাগে ফুল কিনতে এসেছেন। যার কারণে কিছুদিন আগে থেকে ফুলের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে।
শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাইকারি বাজারে মান ভেদে একটি গোলাপ ৫ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। জারবেরা ১৫-২০ টাকা, গাডিওলাস ১০-১৮ টাকা ও রজনীগন্ধা ৬-৮ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। এছাড়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে এক হাজার গাঁদাফুল। তবে খুচরা বাজারে একই ফুল বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে।
খুচরা ফুল ব্যবসায়ীরা জানান, একটি গোলাপ ২৫ থেকে ৪০ টাকা, আর একটু বড় সাইজের গোলাপ ৫০-৮০ টাকা, জারবেরা ৩০ থেকে ৫০ টাকা, গ্লাডিওলাস ২০ থেকে ৩৫ টাকা ও রজনীগন্ধা প্রতি স্টিক ১০-১৫ টাকা দরে বেচাকেনা হচ্ছে। ফুলের মালা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা দরে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ফুল দিয়ে সাজানো তোড়া বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে দুই হাজার টাকায়, যা অন্য সময়ের চেয়ে দাম একটু বেশি।
সেখানে মৌসুমি ফুল ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে আগে থেকেই ফুল সংগ্রহের প্রস্তুতি নিয়েছি। কারণ ওইদিন ফুলের দাম আকাশছোঁয়া থাকে। বাজার ঘুরে দেখছি, দামে পছন্দ হলে ৩০-৪০ হাজার টাকার ফুল কিনব। একই স্থানে পোশাক কারখানার শ্রমিক বাবেয়া আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ফুল কিনতে এসেছি। সেদিন ফুলের দাম তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, যে কারণে আগে থেকেই ফুল সংরক্ষণ করছি। এবার ফুলের দাম একটু বেশি বলে মনে হচ্ছে।
ফুলের মধ্যে গোলাপের পাশাপাশি কদর বেড়েছে গ্লাডিওলাসের। তাই ফুল চাষিরাও এখন গ্লাডিওলাস ফুল চাষে বেশি ঝুঁকছেন। ধামরাইয়ের বংশী নদীর চড়ে চাষ হচ্ছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুল গ্লাডিওলাস। দেশে যে কয়টি বিদেশি ফুল জনপ্রিয় হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এই গ্লাডিওলাস। বিভিন্ন বর্ণের কারণে ফুলটির চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ঢাকার ধামরাইর উপজেলার কুল্লা ইউনিয়নের বংশী নদীর চর অঞ্চলের রুপনগর গ্রামে বাণিজ্যিকভিত্তিতে শুরু হয়েছে গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ।
ফুল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন এ উপজেলার চাষিরা। এদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, অন্য ফসলের চেয়ে ফুল চাষ অনেক লাভজনক হওয়ায় দিন দিন ধামরাই উপজেলায় এ ফুলের চাষ বাড়ছে। কয়েক বছর আগেও এসব নদীর চর অঞ্চলে কোন ফসল চাষ হতো না। বর্তমানে এখন পরিত্যক্ত এই জমিতে গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করে ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। ফুল চাষীরা জানায়, তারা গ্লাডিওলাস ফুল চাষ করে ব্যাপক লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া এইসব ফুল বাগানে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাদের ফুল চাষের সাফল্য দেখে এলাকার অনেক চাষি ও বেকার যুবক ফুল চাষ শুরু করেছেন।
তারা বলেন, ফুল চাষ আমাদের অঞ্চলের জন্য লাভজনক হয়ে উঠেছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে আমাদের অঞ্চলে ফুল চাষ বৃদ্ধি পাবে। আমাদের উৎপাদিত ফুল দিয়েই আমাদের চাহিদা পূরণ করে অন্য জেলার চাহিদাও মেটাতে পারব।
এ বিষয়ে সাভার উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মুকাশেফা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফুল চাষীদের জন্য প্রশিক্ষণসহ নানা সহযোগীতা দেওয়া হচ্ছে। সরকারিভাবে আরেকটু সুযোগ সুবিধা পেলে সাভারে আরও অনেকে জারবেরা ফুল চাষে আগ্রহী হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এখানকার ফুল চাষিরা।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল