২৬ জানুয়ারি, ২০২১ ১৪:০০

চুক্তির মেয়াদ শেষেও টিকিট বিক্রি করছে সিএনএস

অনলাইন ডেস্ক

চুক্তির মেয়াদ শেষেও টিকিট বিক্রি করছে সিএনএস

টানা ১৪ বছর ধরে রেলের টিকিট বিক্রি করে আসছে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমস লিমিটেডের (সিএনএস)। যদিও গত মার্চেই রেলের সঙ্গে তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তখন উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সহজ লিমিটেডকে টিকিট বিক্রির জন্য মনোনীত করেছিল রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দরপত্রে সহজের চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি দরদাতা হয়েও উচ্চ আদালতে মামলা করে চুক্তি কার্যক্রম স্থগিত করে রেখেছে সিএনএস।

উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে সহজ লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করতে না পারায় সিএনএসকে দিয়েই টিকিট বিক্রি করাচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে তারা আগের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী টাকা পাবে। তবে মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী চুক্তি হলে টিকিটপ্রতি সহজকে রেলের পরিশোধ করতে হতো ২৫ পয়সা। সিএনএস আগের চুক্তিতে কমিশন নিত ২ টাকা ৯৯ পয়সা। সে হিসাবে সহজের চেয়ে সিএনএসকে ২ টাকা ৭৪ পয়সা বেশি দিতে হচ্ছে। রেলে মাসে গড়ে টিকিট বিক্রি হয় ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার। নতুন চুক্তি না হওয়ায় রেলওয়ের কাছ থেকে মাসে গড়ে ৯১ লাখ ৩২ হাজার ৪২০ টাকা বেশি নিচ্ছে সিএনএস। অথচ নতুন দরপত্রেও টিকিটপ্রতি তারা প্রস্তাব করেছিল ১ টাকা ২২ পয়সা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা স্পেকটাম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দর ছিল ৫৮ পয়সা।

চুক্তি ছাড়া টিকিট বিক্রি করা যায় কি না জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন জানান, আমরা তো দরপত্রের মাধ্যমে নতুন করে চুক্তি করার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলাম। এখন তো সেটা করতে পারছি না। ওরা (সিএনএস) ২০০৭ সাল থেকে কাজ করে আসছে। এজন্য বর্ধিত সময়ে ওরাই কাজ করছে। আমাদের তো আর বিকল্প নেই। আর আমাদের সেই সক্ষমতা নেই বলেই তো আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে এটা করাচ্ছি।

রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ২০০৭ সালে টিকিট বিক্রির জন্য সিএনএসের সঙ্গে ৯ কোটি ৯১ লাখ টাকায় পাঁচ বছর মেয়াদে চুক্তি করে রেল কর্তৃপক্ষ। তবে ট্রেনের সংখ্যা, কোচ, আসন এবং স্টপেজ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে মেয়াদ শেষে চুক্তির মূল্য দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। মেয়াদ ফুরালে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের পরিকল্পনা করে রেল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি জানতে পেরে সরকারে বিভিন্ন মহলে সিএনএস দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। পরে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিয়ে চুক্তির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। এরপর ২০১৪ সালে দরপত্র আহ্বান করা হলে আবারও ৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকা মূল্যে পাঁচ বছরের জন্য কাজ পায় সিএনএস। ওই চুক্তির মেয়াদ শেষে আবারও ট্রেনের সংখ্যা, কোচ, আসন স্টপেজ বৃদ্ধিসহ নানা অজুহাতে চুক্তিমূল্য ৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৪১ কোটি ৯০ লাখ টাকা করা হয়।

মেয়াদ ফুরানোর নির্দিষ্ট সময়ের আগে দরপত্র আহ্বান ও নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির কার্যক্রম শেষ করতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ সুযোগে আবারও ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে এক বছরের জন্য চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করে রেলওয়ে। ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি মতামত দেয়, চুক্তির ক্ষেত্রে মেয়াদের পরিবর্তে মূল্য বিবেচনা করতে হবে। এতে চুক্তিমূল্য ৩১ কোটি ৩২ লাখ টাকা ৪২ মাস তথা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরেই শেষ হয়ে গেছে। তাই চুক্তিমূল্য সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ তথা ১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকার আনুপাতিক চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এতে বর্ধিত চুক্তির মূল্য দাঁড়ায় ৪৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে অবশিষ্ট চুক্তিমূল্য ছিল ৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। বর্ধিত এ চুক্তিমূল্য দিয়ে আর মাত্র ছয় মাস চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো যায় বলে মতামত দেয় মন্ত্রিসভা কমিটি। ওই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর মার্চে। এরপর রেলওয়ে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেনি। সিএনএসের মেয়াদও বাড়ায়নি। চুক্তি ছাড়াই এখন টিকিট বিক্রি করছে সিএনএস।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন করে দরপত্র আহ্বান, বাছাই এবং সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা তৈরিতে লম্বা সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু রেলওয়ে কর্র্তৃপক্ষ দরপত্র আহ্বান প্রাক-কমিটির সভা ডাকে ২৩ জানুয়ারি। আর দরপত্র দাখিলের শেষ সময় নির্ধারণ করা হয় ২৩ মার্চ। অথচ মার্চ মাসেই সিএনএসের সঙ্গে রেলের বর্ধিত চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। এছাড়া ওই দরপত্রে এমন একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যা দেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব না। যদিও দরপত্রটি ছিল আন্তর্জাতিক। দরপত্রে বলা হয়, ‘আবেদনকারীকে অবশ্যই বছরে ৫০ লাখ টিকিট বিক্রির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।’

রেলওয়ে থেকে প্রাপ্ত নথি ঘেঁটে দেখা যায়, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি প্রাথমিকভাবে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত ঘোষণা করে। তাদের মধ্যে সহজ লিমিটেডও ছিল। এককভাবে সহজ লিমিটেড দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে না পারায় সিনেসিচ আইটি লিমিটেড ও ভিনসেন্ট কনসালটেনসি (পিভিটি) লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে দরপত্রে অংশ নেয়। তারা সবচেয়ে কম দর অর্থাৎ টিকিটপ্রতি ২৫ পয়সা প্রস্তাব দেয়। দরপত্রে সহজ লিমিটেড ৪০ লাখ টিকিট বিক্রির প্রমাণ জমা দেয়। প্রাথমিকভাবে মনোনীত হওয়ার পর সহজের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের কাছে আরও টিকিট বিক্রির প্রমাণ আছে কি না। এরপর সহজ কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা এনা পরিবহনের টিকিট বিক্রি করে। এর প্রমাণ তারা মূল্যায়ন কমিটির কাছে জমা দেয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির কারিগরি প্রস্তাবনা মূল্যায়নে ১০০ নম্বরের মধ্যে সহজ লিমিটেড ৭১ দশমিক ৯৩ নম্বর পেয়ে যোগ্য বিবেচিত হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম স্থান অধিকার করে এবং শতভাগ নম্বর পায়। সর্বনিম্ন দরদাতা ও আর্থিক সক্ষমতার বিচারে সহজের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য গত ১৮ নভেম্বর সুপারিশ করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি।

মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে উল্লিখিত প্রাক্কলনে (সম্ভাব্য দর) বলা হয়, বর্তমানে কম্পিউটার টিকিটিং পরিচালনার জন্য যাত্রীপ্রতি ২ টাকা ৯৯ পয়সা দেওয়া হয়। এ সার্ভিস চার্জকে ভিত্তি হিসেবে ধরে গত ছয় বছরের মুদ্রাস্ফীতি ও বাংলাদেশ রেলওয়ের ইন্টারগেটিক টিকিটিং সিস্টেমের (বিআরআইটিএস) কর্মপরিধি বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আলোচ্য দরপত্রে যাত্রীপ্রতি প্রদেয় প্রাক্কলিত সার্ভিস চার্জ ৪ টাকা ৩৫ পয়সা নির্ধারণ করে কমিটি। প্রতি মাসে গড়ে ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার টিকিট বিক্রির হিসাবে বিআরআইটিএসের সার্ভিস চার্জ বাবদ ৬০ মাসের ব্যয় ৮৭ কোটি টাকা।

মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে বলা হয়, ‘সহজ লিমিটেড সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত হয়েছে। তাদের আর্থিক প্রস্তাবনা যাত্রীপ্রতি ২৫ পয়সা, যা প্রাক্কলিত সার্ভিস চার্জ ৪ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে ৪ টাকা ১০ পয়সা বা ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ কম। এতে প্রতি মাসে ৩৩ লাখ ৩৩ হাজার টিকিট বিক্রির হিসাবে ৬০ মাসে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এতে সরকারের প্রাক্কলনের তুলনায় ৮৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।

এরপর কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সহজ লিমিটেডের সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষ চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা নিলে আদালতে যায় সিএনএস। তাদের দাবি, সহজ লিমিটেড দরপত্রে ৪০ লাখ টিকিট বিক্রির তথ্য দিয়ে পরে বাকি তথ্য সংযুক্ত করেছে। অথচ পিপিআর-২০০৮-এর ৯৮ (১৬) ধারায় বলা হয়েছে, ‘দরপত্র দলিলে উল্লেখ করা হয় নাই এরূপ অতিরিক্ত কোনো তথ্য দরপত্রে সংযোজন করা হইলেও উহা মূল্যায়নে বিবেচিত হইবে না।’ কিন্তু ওই ধারা লঙ্ঘন করে কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে এসব তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করেছে এ দাবি নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে সিএনএস। আদালত শুনানি শেষে চুক্তি স্বাক্ষরের ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। এরপর গত ২৩ ডিসেম্বর ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করে রেল ও সহজ কর্তৃপক্ষ। চেম্বার জজ আদালতও স্থগিতাদেশ বহাল রাখে।

এ বিষয়ে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান জানান, আমি দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে ছিলাম। সর্বনিম্ন দরদাতা, কারিগরি দক্ষতা ও আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনা করে সম্পূর্ণ যুক্তিসংগতভাবেই সহজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে এ প্রকল্পে কাজ দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এখানে কোনোভাবেই আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি।

সহজ লিমিটেডের দরপত্রের অংশীদারি প্রতিষ্ঠান ভিনসেন্ট কনসালটেনসি লিমিটেডের পরিচালক নাগির আহমেদ অপূর্ব জানান, আমরা চাই কম লাভে দেশের সেবা করতে। এজন্য সবচেয়ে কম রেটে আমরা দরপত্র জমা দিয়েছি। মূল্যায়ন কমিটি যোগ্য মনে করেছে বলেই আমাদের সঙ্গে চুক্তির জন্য সুপারিশ করেছে। 

সূত্র: দেশ রূপান্তর

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর