সম্পতি দেশে সংঘটিত বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ১৮ জন বিশিষ্ট নাগরিক। বুধবার এ বিবৃতি দেন তারা। ওই বিবৃতিতে তারা বলেন, “সাম্প্রতিক এসব ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করেছে, যা জাতির জন্য বহন করছে অশনি সংকেত।”
ওই বিবৃতিদানকারীরা হলেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমাম, অনুপম সেন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, সারোওয়ার আলী, আবেদ খান, সেলিনা হোসেন, লায়লা হাসান, আবদুস সেলিম, মফিদুল হক, শফি আহমেদ, শাহরিয়ার কবীর, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুনতাসীর মামুন, সারা যাকের, শিমুল ইউসুফ ও হারুণ হাবীব।
ওই বিবৃতি বলা হয়, “বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার ও জামিন না দেওয়া, কলেজের শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার কারণে পুলিশ সদস্য কর্তৃক লাঞ্ছনার ঘটনা, মুজিব শতবর্ষে কুষ্টিয়ায় ভাস্কর্য ভাঙা সমর্থন করে এবং ভাস্কর্য ইসলাম বিরোধী কাজ বলে চিহ্নিত করে পুলিশ সদস্যের ফেসবুক ও সরাসরি মাইকে ঘৃণ্য বক্তব্য, ইতিপূর্বে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্য ধর্মালম্বী মানুষকে ঘৃণা করার শিক্ষা সম্বলিত রচনার অন্তর্ভুক্তি, দু’বছর আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একজন সচিবের ‘টাকনু’র ওপরে কাপড় পরার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত অফিস আদেশ জারি এবং বাংলা নববর্ষের প্রভাতে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বিদাত বলে ঘোষণা আমাদের মনে এই ছায়াপাত করে যে রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তি তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে।”
বিগত কয়েক বছর যাবত সমাজে বিচ্ছিন্নভাবে ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠী সহিংস যে ঘটনা ঘটিয়েছে জনগণ তা প্রত্যাখ্যান করেছে উল্লেখ করে ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নিয়োজিত কর্মকর্তা ও আইন শৃঙ্খলা-রক্ষা বাহিনীর কতিপয় সদস্য যখন সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে শিক্ষক, শিল্পী ও সাধারণ মানুষকে নানাভাবে লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত করছে তখন জনগণের মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের মূল চারনীতি ও মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করতে সচেষ্ট নয়।”
“হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে বিধর্মীদের সংস্কৃতি বলে মিথ্যাচার করে সরকারের ও রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থান নেওয়া স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার-আলবদরের উত্তরসূরিরা আজ রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলার প্রয়াস নিয়েছে” ,বলেও ওই বিবৃতিতে বলা হয়।
বিবৃতি দাতারা বলেন, “রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দায়িত্বে থাকাকালে প্রতিক্রিয়াশীলদের এমন ভয়ঙ্কর কর্মকান্ড প্রমাণ করে আমাদের নির্লিপ্ততা ও ধর্মান্ধদের রাষ্ট্রক্ষমতার অভ্যন্তরে শিকড় বিস্তার। এখনই সময় এ প্রবণতা রোধ এবং এর শিকড় উৎপাটন করা। আর এই দায়িত্ব মূলত সরকারের। দ্বিধা ও বিলম্ব মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে।”
বিবৃতিতে সাম্প্রদায়িক ঘটনার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, “১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্যদিয়ে যে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উদ্ভব এবং সেই ধারা অনুগত শিক্ষা ও সংস্কৃতির উত্থান ঘটে যা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে একটি পশ্চৎপদ রাষ্ট্রেপরিণত করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি একযুগেরও বেশী সময় ক্ষমতায় থেকেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সেই রাহুমুক্ত করতে পারেনি। আমরা আবারো উল্লেখ করছি এখনই সময় এই প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি সংহত করে এদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে বিতাড়িত করা। আর সরকারের এ মহতি কাজে বাংলাদেশের জনগণ সরকারে সাথে থাকবে। আমরা নিশ্চয়ই একথা সকলে স্বীকার করবো যে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের অবৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও সাম্প্রদায়িক পাঠদানই আজকের এই বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। কেননা আজকের দানবরূপী এই মানুষগুলো একদা শিশু-কিশোর ছিলো। আমরা বাংলাদেশের শিক্ষাধারায় বিজ্ঞান ভিত্তিক ও সমতার সমাজ গড়ার লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে পাঠ্যসূচি থেকে যে কোন ধরনের ঘৃণা সঞ্চারি রচনা বাদ দেওয়ার দাবি করছি।”
বিবৃতিতে হৃদয় মন্ডলের নিঃর্শত মুক্তির দাবি জানিয়ে, “যে কিশোর ছাত্ররা মৌলবাদী চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে অপমান করে পুলিশে সোপর্দ করেছে তাদের মধ্যে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের যে সকল ব্যক্তি এমন কাজে সহযোগিতা ও ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।”
বিবৃতিতে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, “আসুন আমরা যে যার অবস্থান থেকে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, সম্প্রীতি ও ন্যায়ের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একযোগে কাজে নেমে পরি। বিলম্ব হয়েছে বিস্তর। এখন সময় হয়েছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের প্রতিহত করার ও দেশ থেকে বিতাড়িত করার।”
“আসুন সকলে সম্মিলিতভাবে বলি-
‘অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো,
সুন্দর কর হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো,
নির্ভয় করো হে।
মঙ্গল করো, নিরলস নিঃসংশয় করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো,
অন্তরতর হে।
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে,
মুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল মর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।”