ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেশি দিন চললে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমাদের রাজনীতিতে, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আমি প্রস্তাব রাখবো, অধ্যাপক ইউনূস যেন সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
শনিবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএফডিসি) ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণ নিয়ে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে এক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। এতে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ইতিহাস যুদ্ধ করে না। যুদ্ধ করে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। কিন্তু ইতিহাসের দরকার আছে। ইতিহাসকে বাদ দেয়া যাবে না। নতুন ইতিহাস লিখতে হলে পুরনো ইতিহাসকে মুছে ফেলা যায় না। ভারতীয় গণমাধ্যমেই দেখেছি যে, ভারতে সামনে দুটো নির্বাচন আছে। বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে। দুটোই রাজনৈতিক দিক থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য চ্যালেঞ্জ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানকেও রক্ষা করতে পারে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কিন্তু নির্বাচিত নন। ইমরান খান এখন জেলে। তার এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইমরান খানের রাজনৈতিক নেতৃত্ববৃন্দেরও ফয়সালা হয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনী সামনের কাতারে চলে আসছে। পাকিস্তানের জনগণ এখন কী বলবে? তারা বলবে দেশ রক্ষা করেছে আমাদের সেনাবাহিনী। সেজন্য দুই দিকেই রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। রাজনীতি বাদ দিয়ে ঐতিহাসিক কারণ লেখা যাবে না। আর ইতিহাস লিখতে হলে রাজনীতি লিখতে হবে।
মানবজমিন প্রধান সম্পাদক বলেন, এবারের যুদ্ধের দুটো দিক। ভুয়া সংবাদ অন্যতম। আরেকটা হচ্ছে এআই। আমরা নিজেরা যাচাই বাছাই করে দেখতে পাচ্ছি এবার যুদ্ধ হচ্ছে এআই’র মাধ্যমে। এটার একটা ব্যবসা আছে। এই যুদ্ধ যদি চলতে থাকে আমরা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো। এই যুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে বেশি। কারণ আমাদের কোনো একটা বক্তব্য, কোনো একটা সিদ্ধান্ত স্পর্শকাতর কোনো বিষয়ের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেটা আমরা আশা করি না। আশা করি যে, আমরা সতর্ক থাকবো। পুশ ইন চলছে। পুশ ইনকে বাধা দিতে গিয়ে আমরা এমন কোনো কাণ্ড না ঘটাই যেটা সামাল দিতে পারবো না।
তিনি বলেন, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে সবকিছু। বাংলাদেশে একটা টালমাটাল অবস্থা চলছে। শেয়ার বাজার কলাপস করেছে। আমদানিতে বিরাট চাপ। আমাদের সামনে একটা অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এমনিতেই আছে। আরেকটা তৈরি হতে যাচ্ছে। ইস্টার্ন ফ্রন্টে কিন্তু যেকোনো সময় যেকোনো ধরনের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমার আশঙ্কা- এখানে চীন একটা ফ্যাক্টর। ‘সাত কন্যা’র দিকে কিন্তু চীনের নজর রয়েছে। ভূ-রাজনীতিতে এটার প্রভাব অনেক থাকবে। এটাকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমরা চলে যাবো, ভবিষ্যতে আপনারাও দেখবেন এই যুদ্ধ থামবে না। এই বিরোধ চলতেই থাকবে। কাশ্মীর হচ্ছে রাজনীতির দাবার গুটি। কাশ্মীর না থাকলে পাকিস্তানের নেতৃত্ব এবং ভারতের নেতৃত্বের ফয়সালা হবে না। ’৪৭-এ ভাগ হয়েছে, তারপরও কেন বিরোধ? সরকার বদলায় এই যুদ্ধের কারণে। আগামীতেও তাই হবে।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, ভুয়া সংবাদের কারণে যেকোনো সময়, যেকোনো সিদ্ধান্তে আমাদের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভুয়া খবর থেকে সতর্ক থাকতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যারা নেন তাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। দল নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত। তারা এখন পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। কিন্তু জাতিকে টাইম টু টাইম জানাতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। এরমধ্যেই আমাদের খুব বেশি সতর্ক থাকতে হবে- আমাদের কথা বলা, আচার-আচরণ থেকে সব কিছুতে। যাতে কোনো আঁচড় না লাগে। যে আঁচড় থেকে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমার-আপনার একটা বক্তব্য কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
তিনি বলেন, হঠাৎ করে আমরা পাকিস্তানের দিকে নজর দিচ্ছি, সম্পর্ক গড়ছি। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, ভারত আমাদেরকে বৈরি মনে করে। প্রতিপক্ষ মনে করে। ভারতের সঙ্গেও আমরা সুসম্পর্ক চাই। পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক চাই। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের দেনা-পাওনার বিষয়টিও আসছে। ভারতের অনেক সিদ্ধান্ত আমরা অপছন্দ করি। কিন্তু লক্ষ করেছেন যে- ভারতের যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সব রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি কথা বলেছেন। তার আগের ঘটনা হচ্ছে কংগ্রেস বলেছে, তিনদিন আগেই অর্থাৎ ১৯শে এপ্রিল তিনি জানতেন পেহেলগামে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে। নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আমি সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না, সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছি সেনাবাহিনীর উপর। এটা কি আসল কথা? না এটা আসল কথা না। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া সেনাবাহিনী যুদ্ধ শুরু করে না।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের মৃত্যু যেমন দুঃখজনক, তেমনই ভারতের হামলায় পাকিস্তানের বেছে বেছে মসজিদ ধ্বংস করাসহ ৩২ জন বেসামরিক নাগরিক হত্যা করার যে অভিযোগ উঠেছে তাও দুঃখজনক। পেহেলগাম হামলায় নিহতের ঘটনায় ভারত পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। তবে পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করে ভারতের সাজানো নাটক বলে দাবি করেছে। ভারত বিশেষ ফায়দা অর্জনের জন্য এই ধরনের নাটক সাজিয়েছে বলে পাকিস্তানের দাবি।
তিনি বলেন, ৬ মে মধ্যরাতে পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যে সকল মসজিদ ধ্বংস হয়েছে সেই সব মসজিদেই ঐদিন পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে ফজরের নামাজ আদায় করেছেন স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ব্ল্যাক আউটের মধ্যেই সংহতি প্রকাশের জন্য ফজরের ওয়াক্তে একত্রিত হয়েছিল পুরো এলাকার বাসিন্দারা। এই পরিস্থিতিতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কোনো উস্কানিতে নিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো যাবে না। তবে বিজিপি সরকার কর্তৃক ওয়াক্ফ সংশোধনী বিলের বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করে ভারতীয় মুসলমানদের স্বস্তি প্রদান করা উচিত। তাই এই দুই দেশে অবস্থানকারী মুসলমান ও হিন্দুরা যার যার অবস্থান থেকে ধর্মীয় উত্তেজনা পরিহার করে এই যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করা উচিত। তা না হলে বিশ্ব এই দুই পারমাণবিক শক্তির সংঘাতের ভার বইতে পারবে না।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে ‘ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের মূল কারণ রাজনৈতিক নয় ঐতিহাসিক’ শীর্ষক ছায়া সংসদে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ও বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ’র বিতার্কিকগণ অংশগ্রহণ করেন। এতে জয়লাভ করেন বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের বিতার্কিকরা। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন সাংবাদিক মিজানুর রহমান, সাংবাদিক মাঈনুল আলম, ড. তাজুল ইসলাম চৌধুরী তুহিন, সাংবাদিক এ কে এম মঈনুদ্দিন, কবি ও সাংবাদিক জাহানারা পারভিন। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়।
বিডি-প্রতিদিন/শআ