প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাম্প্রতিক সংলাপ সত্ত্বেও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য স্পষ্ট ও কার্যকর রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া এখনো অনিশ্চিত ও অস্থিতিশীল। নির্বাচন ও সংস্কারের নির্দিষ্ট সময়সূচি সংক্রান্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্পষ্ট ও দৃঢ় অঙ্গীকার না পাওয়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আলোচনাগুলোকে ‘অপরিণত’ এবং অপ্রতুল হিসেবে আখ্যায়িত করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিভিন্ন অংশীজনের মতে, চলমান অনিশ্চয়তা বর্তমান সংকটকে আরও তীব্র এবং দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে পারে। স্বচ্ছতার অভাবে বর্তমান সমস্যাগুলো আরও জটিল হয়ে উঠবে।
রাজনৈতিক নেতারা জোর দিয়ে বলেন, সরকারকে অবশ্যই অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের দ্রুত অপসারণের মাধ্যমে- জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-সহ সকল রাজনৈতিক দলকে সমানভাবে বিবেচনা করে নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘বিশেষ করে, যদি সরকার বিএনপির আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠতে পারে। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টার উচিত নির্বাচন ও সংস্কারভিত্তিক একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এতে অংশগ্রহণে সম্মত হয়, তাহলে চলমান অচলাবস্থা নিরসন সম্ভব।’
গত একসপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রস্তাবিত মানবিক করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি, এবং নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে এনসিপির নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ।
একইসঙ্গে, অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন ইস্যুতে ঢাকাসহ দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পড়েছে, যার ফলে জনজীবনে চরম ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
সংকট নিরসনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা শনি ও রবি- এই দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি-সহ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপে অংশগ্রহণ করেন।
শনিবার রাতে বিএনপির সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানান। পাশাপাশি তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ এবং নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে একটি আনুষ্ঠানিক রোডম্যাপ প্রকাশের জন্য সরকারকে আহ্বান করেন।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের দাবির বিষয়ে কোনো আশ্বাস দেননি। তারা (সরকার) কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্তও দেয়নি। প্রেস সেক্রেটারির আনুষ্ঠানিক বিবৃতি শোনার পর আমরা নিজেদের অবস্থান জানাব।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, তার দল নির্বাচন ও সংস্কারের জন্য একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে। তারা দুইটি সম্ভাব্য সময়সীমা প্রস্তাব করেছে- ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, অথবা রমজানের পর দ্রুততম সময়ে, যা সংস্কারের গতি অনুসারে নির্ধারিত হবে।
তবে, কয়েকজন বিএনপি নেতা বৈঠকের পর হতাশা প্রকাশ করে বলেন, বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চিত বিষয়গুলোর কোনো সমাধান হয়নি। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি এক বা দুই দিনের মধ্যে তাদের পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে ঘোষণা করবে।
সূত্রটি আরো জানায়, বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে না, তবে সরকারের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। এই সময়ের মধ্যে, নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা ও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবিকে আরো শক্তিশালী করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হবে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জনগণ নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চাইছে। প্রধান উপদেষ্টাকে অবশ্যই ভোটাররা কখন ভোট দিতে পারবেন- সেই তারিখ ও মাস ঘোষণা করতে হবে। তিনি একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন- তাহলে নির্বাচন তারিখ ঘোষণা করতে কী বাধা আছে? সরকার যখন নির্বাচন রোডম্যাপ ঘোষণা করতে ব্যর্থ হয়, তখন জনগণের আস্থা হারায়। এতে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আর জনগণ যখন অন্ধকারে থাকে, তখন তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে।
তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই ডিসেম্বরের মধ্যেই হওয়া উচিত কেননা রমজান, ঈদ ও বর্ষাকালের কারণে পরবর্তী মাসগুলো নির্বাচন আয়োজনের জন্য অনুপযুক্ত।
রবিবার অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, যে কোনো সরকারি পরিকল্পনা যদি স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বজায় রাখতে না পারে তাহলে তা অবশেষে ব্যর্থ হবে।
বিএনপি জোটসঙ্গী ও বামপন্থী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ এবং ডিসেম্বরেই জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেওয়া কমপক্ষে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, বৈঠকগুলো ‘ফলপ্রসূ’ হয়নি, কারণ চলমান সংকট সমাধানের লক্ষ্যে নির্বাচন ও সংস্কারের কোনো স্পষ্ট রোডম্যাপ বা অঙ্গীকার তারা পাননি।
তারা অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের অপসারণ করে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান। বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএ) সংকট সমাধানের জন্য ন্যূনতম সংস্কারের মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে।
রবিবার এক লিখিত বিবৃতিতে বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএ) সরকারকে চলমান রাজনৈতিক সংকটের জন্য দায়ী করে। জোটটির অভিযোগ, সরকার একদিকে সংস্কার ও গণহত্যা মামলার কার্যক্রম দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে ফেলেছে, অন্যদিকে কার্যক্ষমতা সীমা লঙ্ঘন করে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে- যার মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডোর চালু করা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন টার্মিনাল একটি বিদেশি কোম্পানির কাছে লিজ দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
এলডিএ-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকারকে ২০২৪ সালের গণহত্যা মামলার প্রক্রিয়াটি জনগণের কাছে দৃশ্যমান করতে হবে। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যকর করার পর, ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
জোটটি আরও অভিযোগ করে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষপাতিত্ব করছে- যা তাদের মতে সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেন, সরকার যদি দ্রুত নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করে তাহলে দলগুলো সরকারের উপর আস্থা হারাতে পারে এবং সংকট নাগালের বাহিরে চলে যেতে পারে।
তাঁদের মতে, সরকারের উচিত ভোটার ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা এবং যেকোনো ধরনের পক্ষপাতিত্বের ধারণা দৃঢ়ভাবে পরিহার করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাহবুব উল্লাহ বর্তমান সংকটের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দায়ী করে বলেন, মানব করিডোর ও বন্দর ব্যবস্থাপনার মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সামরিক বা আধা-সামরিক শাসনব্যবস্থা ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে- যা একদিকে ভারতের এবং আওয়ামী লীগের জন্য সুবিধাজনক হলেও, দেশের জন্য তা হবে মারাত্মক ক্ষতিকর।