কয়েক বছর আগে হলেও বিষয়টিকে একেবারেই পাত্তা দেওয়ার কিছু ছিল না। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বলে একটি রাজনৈতিক দল খাতা-কলমে থাকলেও কোন লোকসভা কিংবা বিধানসভাতে বিজেপির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে যে রাজ্যে শুধু বামফ্রন্টের সঙ্গে লড়াই ছিল কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের মধ্যে। তবে ১০ বছর ধরে জাতীয় কংগ্রেসকে ঘিরে যে দুর্নীতি দেখা দিয়েছে আজ সেই ১২৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী দলটিকে হঠাতে এবারের লোকসভায় একটি প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া চলছে।
এতদিন কখনও কংগ্রেস-তৃণমূল জোট কখনও বিজেপি-তৃণমূল জোট লড়াই করেছে এ রাজ্যে। কিন্তু এবারের মতো চতুর্মুখী লড়াই এই প্রথম। গত লোকসভায় ২০০৯-এ বিজেপি এ রাজ্যে ১০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, আসন পেয়েছিল ১টি। ২০০৯-এ কংগ্রেস-তৃণমুল জোট ছিল তাতেও ১০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু এবার চতুর্মুখী লড়াইয়ে বিজেপি যে একটা বড় ফ্যাক্টর সেটা নিঃসন্দেহে বলাই যায়। ভঙ্গুর সিপিআইএম, কংগ্রেস এবং তৃণমূল এই মুহূর্তে সারদা, টেট, ধর্ষণ এই তিনমুখী কেলেঙ্কারিতে জব্দ। তাই সেভাবে প্রচারেও চমক আনতে পারছে না। সেই জায়গাতেই চমক বিজেপির এবং তাই মোদির বারংবার এ রাজ্যে সফর। বেশি আসন না পেলেও ভোটে শতাংশ হার বাড়বে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর তা হলেই আসন সংখ্যা বেড়ে ২/৩ টি হয়ে যেতে পারে। সেখানেই কেল্লা ফতে।
দার্জিলিং আসনটি তারা জিতেলেও জিততে পারে। কিন্তু কৃষ্ণনগর, শ্রীরামপুর, আসানসোল, বারাসত সম্পর্কে হলফ করে কিছু বলা সম্ভবপর না হলেও আশায় বুক বাঁধছেন দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থরা। মোদি ইতোমধ্যেই পাঁচবার এসেছেন। সভা করেছেন আটটি (ব্রিগেড, শিলিগুড়ি, শ্রীরামপুর, বাঁকুড়া, আসানসোল, কৃষ্ণনগর, বারাসত এবং কাঁকুরগাছি)। যদি তারা ৩ টি আসন দখল করতে পারে তা হবে তাদের পক্ষে বিশাল লাভ, কারণ তা ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে প্রভাব ফেলতে সাহায্য করবে। কারণ ৭ টি বিধানসভা আসন নিয়ে একটি লোকসভা গঠিত হয়ে তাকে। সেক্ষেত্রে ৩টি লোকসভা আসন প্রায় ২১ টি বিধানসভা আসনের সমতুল্য। অতএব বিজেপি প্রভাবকে একের নস্যাৎ করে দেওয়া উচিত হবে না।
মোদি নামক এই ঝড়ে রাজ্য থেকে কয়েকটি আসন দখল করতে পারে তাহলে তার পুরো কৃতিত্বই কিন্তু মেদির। কারণ ভারতের ফেডারেল ফ্রন্ট কিংবা তৃতীয় ফ্রন্টের মতো শক্তিশালী দল আজ পর্যন্ত গড়ে উঠতে পারেনি, যারা মিলেমিশে একটা স্থায়ী সরকার উপহার দিতে পারে দেশের মানুষদের। আর এই স্বীকৃতিকেই সুকেৌশলে ব্যাপকভাবে প্রচারে ব্যাবহার করে আজ নরেন্দ্র মোদি যে ভাবমূর্তি তৈরি করে ফেলেছেন দেশের আমাপর জনসাধনের কাছে তাতে সবাইকে ছাপিয়ে তিনিই এখন প্রচারের আলোয়। প্রতিটি সভাতেই তিনি নরমে-গরমে আক্রমণ শাণিয়েছেন তৃণমূল-সিপিআইএম-কংগ্রেসকে। কিন্তু তার যুক্তিযুক্ত পাল্টা দিতে এখনও সক্ষম হয়নি বিপক্ষ দলগুলি।
বাম জামানার অবসানের পর রাজ্যে তৃণমূলের সরকার এলেও তেমনভাবে কর্মসংস্থান হয়নি। স্বভাবতই তরুণ শিক্ষিত প্রজন্মের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। আর এই হতাশা থেকে বেরিয়ে আলোর মুখ দেখতে চাইছে তারা। এরা অবশ্য নিজের চোখে গুজরাট দেখেনি। কিন্তু বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকেই জানছে গুজরাটে নামী শিল্প ও কৃষির বিপুল উন্নতি সাধন করেছে।
স্বভাবতই তৃণমূল বা কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার নয়, মোদির উন্নয়ন যজ্ঞের কথা মাথায় রেখেই বিজেপি মুখি হয়েছে সেই যুবসমাজ। মোদিও জনগণের প্রতি বার্তা দিয়েছেন, 'আমি কোন প্রতিশ্রুতি দেব না, আমার লক্ষ্য শক্তিশালী ভারত গড়ে তোলা। আমাকে সাত মাস সময় দিন, না হলে আমাকে সরিয়ে দেবেন'। মোদির এই বক্তব্য মরীচিকা কিনা সেটা পরের প্রশ্ন, কিন্তু দেশজুড়ে যে মোদি হাওয়ার চেরাস্রোত বইছে তা থেকে ব্যতিক্রম নয় পশ্চিমবঙ্গও। আর এ রাজ্যে মোদির এই ঘন ঘন সফরই তা প্রমাণ করছে যে 'মোদি লাও দেশ বাঁচাও'। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলির ভূমিকাও কম নয়। দেশের গণমাধ্যমগুলি মোদির পক্ষেই দেশজুড়ে প্রচার চালাচ্ছে। মোদি প্রধানমন্ত্রী হবেন কি সেটা সময়ই বলবে তবে একটা কথা ঠিক বিকল্প নেই বলেই শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয় সারা দেশেই বিজেপি একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে