লেখা যেদিন ছাপা হচ্ছে সেদিন অবরোধের ৩৭তম দিন চলছে। দৈনিক পত্রিকাসমূহের খবর অনুযায়ী রবিবার পর্যন্ত মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছে ৮৫ জন। মাঝে দুই দিন গেল তার প্রথম দিনে অন্তত দুজন মারা গেছেন। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ মঙ্গলবারের কথা বলতে পারব না কারণ এখন আমি লিখছি। যদি এরকম হতো অন্তত একটা দিন মৃত্যুর সংবাদ ছাড়া যেত তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু এই পোড়া দেশে সে রকমটি হওয়ার জো এখন আর নেই। সত্যি সত্যি দেশ এখন একটি মৃত্যুপুরিতে পরিণত। এই অবস্থাকে সামনে রেখেই ৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এক গোলটেবিল বৈঠকে মিলিত হন। বিরাজিত পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংকট নিরসনে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা একটি জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান, এম হাফিজউদ্দিন খান, শফি সামি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক প্রমুখ এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ড. কামাল হোসেন, সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান, বিকল্প ধারার সাধারণ সম্পাদক মেজর (অব.) মান্নান, জেএসডির সভাপতি আ স ম রবসহ রাজনৈতিক নেতারা উপস্থিত থাকলেও সমাবেশ সুস্পষ্টভাবে ওই বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রভাবান্বিত ছিল। আলোচনা ছিল উন্মুক্ত।
৭ তারিখে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল বৈঠক প্রচণ্ড নাড়া দেয় মানুষকে। কারণ মানুষ সত্যি সত্যি ইতিমধ্যে অধীর হয়ে উঠেছেন। কী যে অবর্ণনীয় ক্ষতি হচ্ছে দেশের তা কারও অজানা নয়। মিডিয়ার বিশেষত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে দেশের মানুষ চিন্তার দিক থেকে অনেক এগিয়ে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের, এমনকি সাধারণ মানুষেরও টেলিফোন পাই। তারা তাদের উদ্বেগের কথা বলেন। অবরোধ শুরুর দিকে ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো জানিয়েছিল, অবরোধের কারণে প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো। দুই দিন আগে এক পত্রিকায় পড়লাম এ পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ৯০ হাজার কোটি টাকা। সোজা কথা? আমাদের বাজেটের পরিমাণ কত? অর্ধেকের মতো টাকা তো আগেই নাই হয়ে গেল। ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম আমরা। লাখ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিল, লাখো মা-বোন ইজ্জত। কেন? একটা সুন্দর সম্মানের জীবন পাওয়ার জন্যই তো। একটা শান্তির দীপ গড়ার প্রত্যাশায় হয়তো। অথচ সেই দেশে মানুষ জ্বলছে পেট্রলবোমায়। মরছে পুড়ে অঙ্গার হয়ে। দেশের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এসএসসি হতে পারবে কি পারবে না তা নিয়েই তীব্র সংশয়।
এগুলো তো বন্ধ হতে হবে। সেই বিবেচনা থেকেই নাগরিক সমাজের এই আকুতি, সংলাপের সনির্বন্ধ অনুরোধ। সভায় যিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা ইতিমধ্যেই এই আকুতি জানিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বরাবর চিঠি তাদের কার্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এটা নেহায়েতই একটি নাগরিক দায়িত্ববোধ। একজন মানুষ সমাজ বা রাষ্ট্রের তেমন কেউ নয়, তিনি কি এরকম বোধে জাগতে পারেন না? একেবারেই রাম-শ্যাম, যদু-মধু যদি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ব্যাপারে কিছু বলতে চায়, তবে কি বলব নাকি, এই বেটা তুই কেরে। তোর ন্যাশনাল আইডি দেখা। সংলাপের প্রস্তাবে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়েছে তা সচেতন মহলকে রীতিমতো বিস্মিত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বিবিসিকে বলেছেন, এখনকার উদ্যোগে শামসুল হুদা ছাড়া অন্য সবার ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে বলে তারা মনে করেন। তারা এ মুহূর্তে এ উদ্যোগকে গুরুত্ব দিতে চান না। তাদের নিশ্চয়ই এজেন্ডা আছে। কি সেই এজেন্ডা? ওই একই দিন, সোমবার যে রাতে এইচ টি ইমাম বিবিসির সঙ্গে কথা বলেছেন সেদিন দিনের বেলা মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিশিষ্ট নাগরিকদের ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলব বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই কুশীলবরা সংলাপের এজেন্ডা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মানে কি দাঁড়াল? এই বিশিষ্ট নাগরিকরা ১/১১-এর কুশীলব কিনা সে নিয়ে মন্তব্য পরে করছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বললেন, এদের নিশ্চয়ই এজেন্ডা আছে, সেটা কি? প্রধানমন্ত্রী নিজেই জবাব দিচ্ছেন- সংলাপ। এর মধ্যে তো কোনো রহস্য নেই। রাগঢাক নেই। তাহলে উষ্মা প্রকাশ করা কেন? সংলাপকেই অপছন্দ তাদের এখন। মিছি মিছি ১/১১-এর কুশীলব বলে গালাগালি কেন? এইচ টি ইমাম কি আলাদা আলাদা করে ব্যাখ্যা করতে পারবেন? উপস্থিত বিশিষ্টজনদের কাদের কাদের এ রকম ভূমিকা ছিল? বরং যারা এখন ক্ষমতায় আছেন তাদের অনেকের ব্যাপারে এ সময়ের অনেক কথা উঠেছে। আমি বলি কি এই নিন্দাবাদের চর্চা বাদ দিন। বিষয়ের মধ্যে আসুন। ৩৬ দিন পরে বলতে পারছেন কি যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত পত্রিকার খবরে জানা গেল রাতে মহাসড়কে বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। এর মানে কি? একদিন আগেই পত্রিকায় আসল, এখন থেকে নিয়মিত বাস চলাচল করবে। সরকার প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেবে। মাত্র একদিনের ব্যবধানে সেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই বাস না চালানোর ব্যাপারে অনড় অবস্থান নেয়। কেন? এর আগে সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ দায়িত্বশীল মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্তারা তাদের বক্তব্যে ঢাকার বাইরের অবস্থা খারাপ বলে মন্তব্য করেন। তখন অনেকেই অর্থমন্ত্রীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও বয়স নিয়ে রসিকতা করেছেন। কিন্তু এখন এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য সত্যায়িত হলো যে, ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ।
ঢাকার ভিতরেই বা পরিস্থিতি কি রকম? ঢাকার মধ্যে অবরোধ নেই। মাঝে মাঝে হরতাল ডাকছে ২০ দল তাতে কোনো পিকেটিং নেই। কিন্তু তাতেও অস্বস্তি যাচ্ছে না পরীক্ষার্থীদের। ঢাকার অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন তারা তাদের সন্তানদের পরীক্ষা নিয়ে কি উৎকণ্ঠায় আছেন। মিছিল না থাক নাশকতা আছে ঢাকা মহানগরীতে। সরকার পক্ষ মিছিল ঢুকিয়ে দিয়েছেন গুলশানের কূটনৈতিকপাড়ায়। বিদেশি দূতাবাসগুলোর কেউ কেউ পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিচারের পিঠস্থল সুপ্রিমকোর্টে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এজলাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বিচারপতিরা। বিচারকাজ বন্ধ হয়ে গেছে বলে বলা যেতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঢাকা থেকে দিলি্লকে যতই আশ্বস্ত করা হোক বাস্তব সে কথা বলছে না। আর দিলি্লকে আশ্বস্ত করার প্রয়োজন পড়ছে কেন? তারা কি উদ্বিগ্ন?
কেন এই পরিস্থিতি? সে আলোচনার মধ্যে আমি যাচ্ছি না। এ সম্পর্কে আমি অতীতে বলেছি। কিন্তু ৭ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের পর তারা সে বিশ্লেষণে যাননি। তারা পরিস্থিতির গভীরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। কঠোরতম মনোভাব দেখানো সত্ত্বেও সরকারের সাফল্য শূন্যের কোঠায়। অতএব সংলাপের প্রয়োজন। কোনো শর্ত নেই। কে আগে কী করবে এ নিয়েও কোনো বিতর্ক নেই। উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ বলছে সরকার পক্ষ বলুক তারা সংলাপ করবে। আন্দোলনকারীরা বলুক তারা সংলাপের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সরকার পক্ষ তো ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখাচ্ছেই না। উল্টো তারা বলছেন, অাঁততায়ীর সঙ্গে সংলাপে বসা যেতে পারে না। কী অদ্ভুত কথা। আপনারা শান্তি বাহিনীর সঙ্গে বসতে পেরেছেন, বিডিআরের বিদ্রোহীদের সঙ্গে বসতে পেরেছেন আর এখন বেগম জিয়াকে অাঁততায়ী বলছেন। এই বেগম জিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনা আগে বসেননি? আবদুল জলিল-মান্নান ভূঁইয়ার সংলাপ তো ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে। বলবেন সেই সংলাপ তো সফল হয়নি। কিন্তু ১৯৮৭ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ৮ নভেম্বর ৮৭ পর্যন্ত দুই নেত্রী এককভাবে অথবা তাদের সহযোগীসহ যে বৈঠকগুলো হয়েছিল তা তো সাফল্যের পালকে ভরপুর।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : mrmanna.bd@gmail.com