তিন মাস ধরে চলা এক ভয়ঙ্কর অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের মেয়র ও অন্যান্য কাউন্সিলর পদে নির্বাচন কিছুটা স্বস্তির ভাব এনেছে, যদিও এ ভাব কতটা স্থায়িত্ব লাভ করবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এ নির্বাচনে সরকার বদল হবে না। এটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। তবু রাজধানী ঢাকা ও দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নগরী চট্টগ্রামের এ নির্বাচনের গুরুত্ব যে যথেষ্ট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচনকে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু করার প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন ও সরকারের। তবে সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যে কথা বলেছেন সেটাই যদি সরকারের অভিপ্রায় হয়ে থাকে তাহলে রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে এবং গণতন্ত্রের ক্ষীণতম আশা যেটি দেখা যাচ্ছে, তাও মিলিয়ে যাবে। মন্ত্রী বলেছেন, 'তিন সিটি করপোরেশনে আমাদের যেমন করেই হোক জিততে হবে।' স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে মন্ত্রীরা কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারেন না। মন্ত্রীর এহেন উক্তি নির্বাচনী বিধির লঙ্ঘন বলে ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে। দ্বিতীয়ত, 'যে কোনো প্রকারে জিততে হবে' কথাটার তাৎপর্য কী? এর আগে আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এইচটি ইমাম প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে দলীয় পুলিশ কীভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিল। গত বছর ১৩ নভেম্বর বিভিন্ন কাগজে তার যে বক্তব্য ছাপা হয়েছিল তার থেকে দুটি বাক্য উদ্ধৃত করা এখনকার জন্য অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি বলেছিলেন, 'নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ প্রশাসনের যে ভূমিকা, নির্বাচনের সময় আমি তো প্রতিটি উপজেলায় কথা বলেছি। সব জায়গায় যারা আমাদের দ্বারা রিক্রুটেড তাদের সঙ্গে কথা বলে তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে নির্বাচন করেছি।' উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন যে, পুলিশ ও প্রশাসনে দলীয়করণ হয়েছে। তৃতীয়ত, যে কাজটি নির্বাচন কমিশনের করার কথা, সেটা তিনি করেছেন আইন বহির্ভূতভাবে। আশা করি, এবার সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।
তবে এখনো পর্যন্ত যা চলছে, অর্থাৎ একদিকে পেট্রলবোমার সন্ত্রাস, অন্যদিকে গুম, ক্রসফায়ার, গণপিটুনির নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং হামলা, মামলা, গ্রেফতারবাণিজ্য- তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে নির্বাচনের উৎসবমুখর ভাব তো দূরের কথা, নির্বাচন নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। এ জন্য কমিউনিস্ট পার্টি ও বাসদের মেয়র প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফি রতন (উত্তর) ও বজলুর রশিদ ফিরোজকে (দক্ষিণ) পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স যথার্থই বলেছেন, 'ঢাকার মানুষ যাতে উৎসব ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে ভোট দিয়ে তাদের প্রার্থী বেছে নিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে এই নির্বাচন মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে না।' এ তো গেল এবারকার বিশেষ পরিস্থিতির কথা। কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলেও আমরা এ নির্বাচন থেকে কতটুকু আশা করতে পারি? এ সম্বন্ধে সন্দেহ পোষণ করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পাতায় (১ এপ্রিল) এক চমৎকার প্রবন্ধ পাঠ করলাম- 'এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে'। প্রবন্ধটির চমৎকার রচনাশৈলী ও সাহিত্যিক ভাষা আমাকে আকর্ষণ করলেও এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা নিয়ে আলোচনা করছি না। মাত্র কয়েকটি বাক্যে প্রবন্ধ লেখক নঈম নিজাম ঢাকাবাসীর কিছু আশু সমস্যা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, 'দুই ঢাকার কাজে সমন্বয় না থাকলে সব কিছু হোঁচট খাবে। ব্যাহত হবে উন্নয়ন প্রক্রিয়া।' ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী যথাক্রমে ক্বাফি রতন (সিপিবি) ও বজলুর রশিদ ফিরোজ (বাসদ) ঠিক এ কথাই বলেছেন। তারা আরও নগর সরকারেরও দাবি করেছেন।
নঈম নিজাম উক্ত প্রবন্ধে আরও বলেছেন, 'উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ইট-পাথরের কাঠিন্য ভেদ করে এ শহরে সবুজের হাতছানি ফিরিয়ে আনতে হবে। যানজট দূর করতে হবে পরিকল্পিতভাবে। মাদক ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে সম্মিলিত তৎপরতায়। নাগরিক হৃদয়ে দিতে হবে স্বস্তির ছোঁয়া। ফিরিয়ে দিতে হবে খেলার মাঠ, পার্ক, মানুষের হাঁটার ফুটপাথ। মেট্রোরেল, পাবলিক যানবাহন বাড়াতে হবে। নগরবাসীর পক্ষে সব অধিকার নিয়ে লড়তে হবে মেয়রকে।' লেখক এমন কিছু দাবি করেননি, যা নিয়ে রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিতর্ক হতে পারে। খুবই সামান্য অথচ খুবই প্রয়োজনীয় দাবি। কিন্তু মেয়রের জন্য যারা দাঁড়াচ্ছেন তারা কি এসব নিয়ে ভাবছেন। কিছু ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু দুই বড় দলের যেসব হেভিওয়েট প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে, তারা এখন ভোট পাওয়ার আশায় যাই বলুন না কেন, বাস্তবে এসব নিয়ে মোটেও ভাবেন না। লেখক নঈম নিজাম তার প্রবন্ধের শেষে একটা মজার গল্প বলেছেন। নির্বাচনের আগে প্রার্থীর বাড়িতে ভোটারের আপ্যায়নের অন্ত নেই। প্রার্থীর স্ত্রী আসেন শরবত নিয়ে। কাজের লোকেরা গলদঘর্ম কী খাওয়াবে তা নিয়ে। ভোট শেষ হলে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এবার ভোটারের পক্ষে তার প্রিয় প্রার্থীর সাক্ষাৎ পাওয়া তো দূরের কথা, সামান্য পানিও মেলে না। বাড়ির কাজের লোকের সাফ জবাব, 'ভোটের আগে এই বাড়িতে পানি মেলে। পরে মেলে না।'
দুই বড় দলের যে সব হেভিওয়েট অত্যন্ত ধনবান প্রার্থীদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা সবাই কোটি কোটি টাকার মালিক। এসব প্রার্থীর নিজেদেরই দেওয়া হলফনামা থেকেই জানা গেছে, কী বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদের মালিক তারা। মেয়র নির্বাচিত হলে তাদের বাসায় ঢোকার অধিকার পাবে কি সাধারণ ভোটাররা? এক গ্লাস পানি খাওয়া তো দূরের কথা। নিম্নবিত্ত মানুষের, বস্তিবাসী জনগণের নিত্যদিনের সমস্যার কতটুকু তারা জানেন বা বোঝেন? গরিবের দুঃখ গরিবই বোঝে। যারা এবং যাদের পরিবারের সদস্যরা কখনো প্রাইভেট কার ছাড়া চলাফেরা করেন না, তারা কীভাবে অনুভব করবেন, ঢাকার পাবলিক যানবাহনের সমস্যার তীব্রতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদ-বৃষ্টিতে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থেকে ঠেলাঠেলি করে বাসে ওঠার অভিজ্ঞতা না থাকলে, সমস্যার গভীরে তারা যেতেই পারবেন না। যাদের পরিবারের চিকিৎসা হয় বিদেশে অথবা কমপক্ষে পাঁচতারকা হোটেলের মতো ব্যয়বহুল হাসপাতালে তারা কীভাবে অনুভব করবেন, নগরবাসীর চিকিৎসার সমস্যাটি কী এবং কেনই বা তা তার অতি শিগগির সমাধান দরকার। ঢাকার ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে। হেভিওয়েট প্রার্থীরা ভোটের জন্য অবশ্যই বস্তিতে যাবেন বক্তৃতা করতে। অনেকটা যেন আনন্দ ভ্রমণের মতো। তারা কি কখনো ভালোভাবে জানার চেষ্টা করেছেন, বস্তির পানি সরবরাহ ঠিকমতো হয় কি না। দুর্গন্ধময়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তারা এবং তাদের পরিবার কি একটি রাতও কাটিয়েছেন?
সাধারণ ভোটার আর হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে দুস্তর ফারাক। নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, মির্জা আব্বাসের বাৎসরিক আয় সাত কোটি টাকার বেশি। সম্পদের পরিমাণও বিপুল, প্রায় একশত কোটি টাকার কাছাকাছি। আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাঈদ খোকনের ব্যাংক ঋণই আছে ১৯ কোটি টাকার বেশি। অনেকগুলো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত। মোটরগাড়ি আছে ৩৮ লাখ টাকার। ১৭ কোটি টাকার শেয়ার আছে। বিস্তারিত বিবরণে গেলাম না। ঢাকা উত্তরের আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিশাল ধনাঢ্য ব্যক্তি আনিসুল হক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে নাকি কোনো প্রাইভেট কার নেই। আমি বলছি না তিনি হলফনামায় অসত্য বলেছেন। তবে নিশ্চিতভাবেই শুভঙ্করের ফাঁক আছে। আমি আরও নিশ্চিত যে, তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন না। ২২টি ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক আনিসুল হকের বাৎসরিক আয় ৭৫ লাখ টাকা। অবশ্য তার স্ত্রীর আয় আরও বেশি ৮৫ লাখ টাকা। ছেলেমেয়েদের বাৎসরিক আয় ৫১ লাখ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ ১৬০ কোটি টাকা। ভোটারদের ৮০ শতাংশ এ ধরনের ধনাঢ্যদের সম্পদ, আয়, ব্যাংক ঋণ পরিমাপ করতেও পারবেন না। মাথা ঘুরে যাবে।
প্রার্থীদের হলফনামার ওপর বাংলাদেশ প্রতিদিনের ১ এপ্রিলের সংখ্যায় যে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, সেখানে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মামলা প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয়েছে। 'মহানগরীর নগরপিতা পদে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদের কারও কারও শিক্ষাগত যোগ্যতার বহর দেখে মনেই হতে পারে, নির্বাচনে হয়তো শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনো বিষয় না।' প্রার্থীদের অনেকের বিশেষ করে বিরোধী দল সমর্থিত প্রার্থীদের মামলার পরিমাণ দেখে 'ভিরমি খেতে হবে।' তবে 'মামলাগুলো যদি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য আরোপিত হয়ে থাকে তবে স্বীকার করতেই হবে, স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও দেশ গণতন্ত্রচর্চার উপযোগী হয়ে উঠলো না।' এই নির্বাচন যে গণতান্ত্রিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন দাবি করা যায় না। অতিকায় ধনীরা যেখানে প্রার্থী সেখানে টাকার খেলা হবেই। তাহলে যেটা হবে তা হলো টাকাওয়ালাদের গণতন্ত্র। উপরন্তু পেট্রলবোমার ভীতি এবং মামলা, হামলা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস অব্যাহত আছে, তাতে কি দাবি করা যায় যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে! বস্তুত প্রধান বিরোধী দল কোনো প্রচার করার সুযোগ পাবে কি না সন্দেহ। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই প্রহসনের নির্বাচনের পর এবার প্রথম বিএনপি ইসির সঙ্গে বসেছে। শতনাগরিক কমিটির প্রধান অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদও ইসির সঙ্গে বসেছেন। কিছু যৌক্তিক দাবি তারা উত্থাপন করেছেন। হয়তো ইসি এড়িয়ে যাবেন, বলবেন, এসব বিষয় তাদের এক্তিয়ারভুক্ত নয়। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তারা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ তো নিতে পারেন। দেখা যাক তারা কী করেন? আগের মতো আজ্ঞাবহ থাকবেন নাকি নিরপেক্ষ ভূমিকা নেবেন। সরকার ও বিরোধী পক্ষ এবং বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের সামনে একটা সুযোগ এসেছে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে ক্ষীণ হলেও কিছুটা আলোর রেখা দেখানোর। আমরাও প্রতীক্ষায় থাকলাম, কে কী দেখান।
লেখক : রাজনীতিক