৩ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১৬:৩২

পুলিশ বাহিনীর আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে মানবিক পুলিশিংয়ে

হাসিনা আকতার নিগার

পুলিশ বাহিনীর আচরণগত পরিবর্তন আসতে পারে মানবিক পুলিশিংয়ে

হাসিনা আকতার নিগার

‘মানবিক পুলিশিং’-এ শব্দটিকে এক সময় অলীক স্বপ্ন মনে হতো। কিন্তু এমন অলীক স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে চট্রগ্রাম মহানগর পুলিশ বাহিনী কাজ করছে একাত্মভাবে।

চট্রগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমান তার ১৬টি থানার পুলিশ বাহিনী দিয়ে নিত্যনতুন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে নগরবাসীর জন্য। যার মাধ্যমে পুলিশ জনগণের সেবক হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দিচ্ছে নগরবাসীকে। 

রাস্তার পাশের ড্রেনের ঢাকনা খুলে ছিনতাইকারীরা পালানোর পথ হিসাবে ব্যবহার করে এ খবর সামাজিক মাধ্যমে জেনে ব্যবস্থা নেয় সিএমপি। সিটি কর্পোরেশনের কাজ ড্রেনের সংস্কার করা৷ কিন্তু মানবিক বিবেচনায় সিএমপি শহরকে ছিনতাই মুক্ত করতে ড্রেনের ঢাকনা লাগিয়ে দেয়।

অপরাধ ও অপরাধ জগত নিয়ে এ বাহিনীর কারবার। তবে চট্রগ্রামের পুলিশ বাহিনী নিজেদেরকে শুধুমাত্র অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ রাখেনি। তারা জনগণের দ্বারে পৌঁছে গেছে ‘হ্যালো ওসি’ কার্যক্রমের মাধ্যমে। যেখানে মানুষ নিজেদের এলাকার সন্ত্রাস মাদক বা অন্য ত্রাস নিয়ে কথা বলতে ভয় পেতো, এখন ‘হ্যালো ওসি’ কার্যক্রমের মাধ্যমে সরাসরি ওসির সাথে কথা বলতে পারে তারা। জানায় অপরাধের কথা। থানায় গিয়ে ওসিকে অভিযোগ করার কথা চিন্তা করতে মানুষ এক সময় ভয় পেত। সিএমপি তাদের জনবান্ধব মনোভাব দিয়ে সে ভয় দূর করতে পেরেছে।

‘পুলিশ হবে ভালো মানুষের বন্ধু আর অপরাধী পাবে ভয়’-এ চিন্তাকে ধারণ করে বলেই চট্রগ্রামবাসী খুব সহজে নিজেদের সমস্যা নিয়ে শরণাপন্ন হয় এ বাহিনীর এসি, এডিসি, ডিসিদের কাছে। আর এ কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের সামিল করে মানবিক পুলিশিংয়ের বিভিন্ন উদ্যোগে। তাই থানার ওসি ও অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে তারা রাস্তায় নেমে কখনো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ক্যাম্পইন করছে। আবার কখনো পথ শিশুদের তুলে এনে নতুন জীবনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। গাড়ির চালক ও পথচারীদের সচেতন করতে এখন সক্রিয় চট্টগ্রাম পুলিশ বাহিনী।

কমিউনিটি, স্কুল পুলিশিং পরিচালনার মুখ্য উদ্দেশ্য মানবিক পুলিশিং। জনগণের সম্পৃক্ততায় আগামী প্রজন্মকে উৎসাহিত করতে স্কুল পুলিশিং সত্যি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ‘আমাদের সন্তানরা যদি নিজেরা বুঝতে পারে ন্যায়-অন্যায়, তবে সমাজকে শুদ্ধ করা সম্ভব হবে। আর এর জন্য পরিবারকে সচেতন হবে সন্তানদের বিষয়ে। স্কুল পুলিশিং বির্তক প্রতিযোগিতা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে মানবতার কার্যক্রমে সিএমপি সদস্যদের উপস্থিতি নগরবাসীর নজর কেড়েছে।

পুলিশ যত গণমানুষের কাছে যাবে ততই সবার আচরণগত ও মানসিক পরিবর্তন আসবে। যার আর একটি উদাহরণ হলো সামাজিক মাধ্যমের পেইজ ‘হ্যালো পুলিশ কমিশনার’। যেখানে সিএমপির ১৬টি থানার মানুষ নিজেদের অভিযোগ, সমস্যা জানাতে পারবে সরাসরি পুলিশ কমিশনারকে। 

তথ্য প্রযুক্তির যর্থাথ ব্যবহার করে সেবা পাবার এ পরিকল্পনাটি চালু করলো সিএমপি। যার মাধ্যমে সাম্প্রতিককালে সোহাগ পরিবহনের একজন নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে অপরাধীদের। আবার অনেকে নিজেদের আইনগত হয়রানি বিষয় অবগত করে প্রতিকারের সঠিক পথ পেয়েছে। বিজয়ের মাসে সিএমপিতে মুক্তিযোদ্ধা ও সিটিজেন কর্নার স্থাপন সন্দেহাতীতভাবে একটি অনবদ্য আয়োজন।

বলা হয়ে থাকে, ‘থানার বারান্দাও টাকা খায়।’ এ কারণে মানুষ সাধারণত খুব সহজে থানায় যেতে চায় না। অলিখিতভাবে কিছু বিষয় যেমন– জিডি লেখা, আসামির সাথে সাক্ষাত বা অপরাধ সংঘটনের ঘটনাস্থলে পুলিশ যাওয়াসহ নানাবিধ কাজে পুলিশকে টাকা দিতে হয়। আর এটা দেশের সকল থানার চিত্র।

কিন্তু পুলিশ সেবা দেয়ার পরিবর্তে কেন এমন টাকা নিচ্ছে তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পুলিশের এ কালচার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। আবার থানার আনুষঙ্গিক বিষয়ের বাজেট যথেষ্ট পরিমাণ নয়। যার কারণে যাতায়াত ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে পুলিশের মধ্যে ঘুষ নেয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। বিশেষ করে থানার নিজস্ব যানবাহন কম থাকার কারণে গাড়ি ভাড়া করে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয় পুলিশকে। সেক্ষেত্রে পুলিশ ভাড়ার টাকা অভিযোগকারীর থেকে নিয়ে থাকে। 

আবার অন্যদিকে বলা হয়ে থাকে, পুলিশের বদলী বানিজ্য একটা বিশেষ কারণ তাদের ঘুষ প্রবণতার ক্ষেত্রে। পুলিশের পরিশ্রম অনুপাতে বেতন ভাতাসহ অন্য সুবিধা যথেষ্ট নয়। তাই ঘুষের নামে উপরি পাওনাতে জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ লোভাতুর করে তুলে ক্রমশ।

অপরাধ ও অপরাধীদের নিয়ে রুটিন মাফিক কাজে মানবিক বিবেক বোধ স্তিমিত হয়ে পুলিশ বির্তকিত হয় অনেক ক্ষেত্রে। তারা যে জনগণের সেবক তা ভুল যায়। বরং এক ধরনের রক্তচোখে মানুষকে ভয়ভীতি দেখানোর প্রবণতার কারণে পুলিশকে মানুষ আলাদা একটি শ্রেণি মনে করে। এ অবস্থায় সিএমপির মানবিক পুলিশিং পাল্টে দিতে শুরু করছে পুলিশের আচরণ। 
অন্তত পুলিশ কমিশনার মাহবুবর রহমানের সারথিরা থানাতে জনবান্ধব পরিবেশ দেয়ার চেষ্টা করছে। মানুষ ভয়ে শংকিত হয় না পুলিশের নাম শুনে। এদেশে পুলিশকে ম্যানেজ করা যায় বলে অপরাধী এ বাহিনীকে ভয় পায় না। উল্টো ভয় পায় নিরাপরাধী অন্যায়ের শিকার সাধারণ মানুষ। এ সাধারণ মানুষদের পাশে দাঁড়াতে সি এমপির মানবিক পুলিশিং হতে পারে সারাদেশের পুলিশ বাহিনীর জন্য দৃষ্টান্ত।

সময় বদলে যাওয়ার সাথে সাথে এ পেশাতে আধুনিক মননশীল মেধা ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরাও অনেক বেশি সক্রিয় হচ্ছে। বৃটিশ আমলের পুলিশ মনোভাব কাটিয়ে সরকারের উন্নয়নে পুলিশ বাহিনীর ভুমিকা জন কল্যাণ মুখী করার প্রচেষ্টা চলছে। আর সে প্রচেষ্টাতে সমাজের আইনী সমস্যাগুলোর উত্তরন ঘটাতে মানবিক পুলিশিং এর বিকল্প কিছু নেই।

যার মাধ্যমে জনগণকে আপন করে নেবার পাশাপাশি অযথা হয়রানি করার মনোভাব ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সিএমপির সদস্যদের। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যখন ন্যায়ের পথ চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠে তখন তাকে দেখে শিক্ষা নেয় অধীনস্তরা।

প্রকৃত পক্ষে যে কাণ্ডারীর হাল ধরে সে ই বুঝে উজানের ঢেউকে ডিংগিয়ে যাবার পথ। আর সিএমপি’র কান্ডারী মাহবুবর রহমান তার অধীনস্তদের অভিনব কৌশলকে স্বাগত জানিয়ে সমাজে অপরাধ কমাতে চাইছেন মানবিক পুলিশিং দিয়ে। একই সাথে আইন আর মানবতা বোধ যখন সমতালে চলে, তখন অন্যায়ভাবে অসহায় মানুষের কাছ থেকে দশ টাকা নিতে বিবেকে বাধবে। এ বোধটা জাগ্রত করা সময়সাপেক্ষ হলেও তার চেষ্টা চলছে এ বাহিনীতে৷ দীর্ঘদিনের অভ্যাসকে রাতারাতি বদলে দেয়া যায় না কেবল আইন আর নিয়ম করে৷ এর জন্য মানসিকতার পরিবর্তনটা আসতে হবে নিজের ভেতর থেকে। একইভাবে আশেপাশের পরিবেশটা বদলাতে হবে।

তাই চট্টগ্রামবাসীর জনবান্ধব পুলিশিং কে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে সহযোগিতা করতে হবে সবাইকে। আর সে সাথে স্যলুট জানিয়ে সিএমপিকে বলতে চাই ‘মানবিক পুলিশিংয়’র প্রদীপ শিখা এক স্বরে ছড়িয়ে যাক এ বাংলার দিক থেকে দিগন্তে। আর পুলিশ হোক মানুষের নির্ভরতার স্থান।’


লেখক: কলামিস্ট     

 

বিডি-প্রতিদিন/ সিফাত আব্দুল্লাহ

সর্বশেষ খবর