১ এপ্রিল, ২০২১ ১৮:০১

উপলক্ষ্য নরেন্দ্র মোদি, টার্গেট বাংলাদেশ!

হাসান ইবনে হামিদ

উপলক্ষ্য নরেন্দ্র মোদি, টার্গেট বাংলাদেশ!

প্রতীকী ছবি

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করেছেন। শুধু নরেন্দ্র মোদি নয় বরং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিরাও এই সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। 

বিশ্বের অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশের এই আনন্দযজ্ঞে শামিল হয়েছেন। গোটা দেশ যখন স্বাধীনতার ৫০ বছর পালনে নানামুখী আয়োজনে ব্যস্ত, গভীর শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে তারা তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মরণ করছে, ঠিক সেই মুহূর্তকেই বেছে নিয়ে হেফাজতে ইসলাম দেশব্যাপী চালাচ্ছে সন্ত্রাসী কার্যক্রম। আর এই সন্ত্রাসকে বৈধতা দিতে তারা পূর্বের ন্যায় এবারো খেলেছে ধর্মীয় কার্ড। 

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মানুষকে এই বার্তা দিয়েছে যে, নরেন্দ্র মোদি 'ইসলামবিরোধী' ও 'গুজরাট দাঙ্গা'র মূল হোতা। তাই বাংলাদেশে কোনভাবেই আসতে দেয়া যাবে না নরেন্দ্র মোদিকে। আর একে কেন্দ্র করেই গত কয়েকদিন ধরে হেফাজতে ইসলাম নারকীয় তাণ্ডব দেশব্যাপী চালাচ্ছে। প্রকাশ্য মিডিয়াতে মামুনুল হকরা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রমে এবার লিপ্ত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদিকে প্রতিহত করতে দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ারও হুমকি দিয়েছে। যেই কথা সেই কাজ, আমরা দেখলাম চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে হেফাজতে ইসলাম মিছিল নিয়ে এসে আচমকা হামলা চালায় হাটহাজারী থানা, ভূমি অফিস ও ডাকবাংলোতে। 

পুলিশ-হেফাজত সংঘর্ষে নিহত হয় চারজন। লাশ না পড়লে সহিংসতা জমেনা তা ভালো করেই জানে মামুনুল হকেরা, ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি এরা করছে অনেককাল আগে থেকেই। এবারো তারা তাই করছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে যে, 'আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ যারা করে তারা মুসলমান না, তাদেরকে হত্যা করা জায়েজ'। এই ভিডিও ইতোমধ্যে গণমাধ্যমেও এসেছে। একবার ভাবুন, মসজিদ যেটা ধর্ম পালনের স্থান, উপাসনালয়ের স্থান সেই মসজিদ কিনা ব্যবহার হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের আঁতুড়ঘর হিসেবে। এই মসজিদ ব্যবহার করেই তারা চালাচ্ছে সন্ত্রাস। একই অবস্থা বায়তুল মোকাররমের, নামাজের স্থান আগেই ব্যবহৃত হচ্ছে অস্ত্র রাখার জায়গা হিসেবে।

হেফাজতে ইসলাম ২০১৩ সালের ৫ মে এই বায়তুল মোকাররমে অস্ত্র মজুদ রেখে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, এবারো অস্ত্রের ঝনঝনানি প্রত্যক্ষ করেছে এই বায়তুল মোকাররম। সাধারণ মুসল্লিরা এখন আর বায়তুল মোকাররমে যেতে পারে না আতঙ্কে, ভয়ে। কেননা প্রতি শুক্রবার এই জাতীয় মসজিদ এখন রাজনীতির জন্য ব্যবহার করে হেফাজতে ইসলাম। এই ধ্বংসলীলা আমাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ৫ মে'র কথা, আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে সেই রক্তপাত, সেই ভাঙচুর, সেই দেশবিরোধী রাজাকার আলবদরের বংশধরদের তান্ডবলীলা। 

আজ তারা বায়তুল মোকারমমের সামনে স্লোগান দিচ্ছে, 'বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালেবান'! স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে এই বাংলাদেশে যদি এমন স্লোগান আমাদের শুনতে হয় তবে মনে হয় সবকিছু বুঝি বৃথা; এতো সমৃদ্ধ ইতিহাস, ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণহানী, লাখো নারীর আত্মত্যাগ বুঝি ম্লান হয়ে যায় এই মৌলবাদীদের আস্ফালনেই! 

শুধু কি নরেন্দ্র মোদির বিরোধীতাই এখানে মুখ্য নাকি এর পেছনে কোন ভিন্ন কারণ রয়েছে। অনেকের প্রশ্ন, এর আগেও তো নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে এসেছেন, প্রায় তিন দিন বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন, কই তখন তো কেউই প্রতিবাদ করেনি, তখন তো কেউ রাস্তায় নেমে এমন অরাজকতা সৃষ্টি করেনি! তাহলে এই হঠাৎ মোদি বিরোধীতার কারণ কি!

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যদি বাংলাদেশ কোন একটি দেশকেও আমন্ত্রণ জানায় তবে সেই দেশটি যে হবে ভারত সে ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ থাকবে বলে মনে হয় না। কারণ আমাদের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে যে দেশটি সার্বিক সহায়তা দিয়েছে সেটি হলো ভারত। এককোটি শরণার্থীকে আশ্রয়দান, নয় মাস নিত্য-প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো, যুদ্ধকালীন অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দান থেকে শুরু করে সার্বিক সহায়তাই দিয়েছে ভারত। বলতে গেলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল কেন্দ্রই ছিলো ভারতে যেখান থেকে বুদ্ধি,পরামর্শ, অস্ত্র, কলাকৌশল সবকিছু আসতো। কিন্তু আমরা দেখলাম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যখনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানো হলো সাথে সাথেই শুরু হলো ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম। যদি ভেবে থাকেন নরেন্দ্র মোদীর কারণেই এই অবস্থা, তবে আপনাদের একটা বিষয় পরিস্কার হবার দরকার আছে। 

নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধীতার কারণ হিসেবে হেফাজতে ইসলাম বললো, মোদি গুজরাট দাঙ্গার হোতা এবং ইসলামবিরোধী! যদি এটাই কারণ হয়ে থাকে তবে নরেন্দ্র মোদি তো ২০১৫ সালেও বাংলাদেশ সফর করেছে তখন কেনো কোন প্রতিবাদ করেনি হেফাজতে ইসলাম? তখন কেন রাজপথে নামেনি তারা? নাকি হেফাজত তখন শীতনিদ্রায় ছিল? এতোদিন পর হঠাৎ করেই তাদের মনে হলো নরেন্দ্র মোদি গুজরাট দাঙ্গার জন্য দায়ী! নরেন্দ্র মোদির বিরোধীতার পেছনে মূলত গুজরাট  বা অন্যকিছু যে মুখ্য না তা স্পষ্ট, যদি গুজরাট বা ইসলামবিরোধীতা মুখ্য হত তবে ২০১৫ সালেই মোদির সফরকে কেন্দ্র করে বিরোধীতা হতো। কেনো নরেন্দ্র মোদি কেবল উপলক্ষ্য তা কয়েকটি বিষয় সামনে আনলেই বুঝা যাবে। 

সরকার যেমন সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উদযাপনের ঘোষণা আগেই দিয়েছে, হেফাজতে ইসলামও সরকারের সাথে পাল্লা দিয়েই অনেক আগে থেকে এই উৎসবকে নারকীয় তান্ডবে রূপ দেয়ার মিশনে নেমেছে। মূলত তারা আজকের এই ধ্বংসযজ্ঞের ড্রেস রিহার্সেল দিয়েছে গতবছরই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে তারা প্রথম আঘাত হানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপরই। যেহেতু বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু একে অপরের পরিপূরক, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশই পেতাম না তাই তাদের মূল ক্ষোভের জায়গাটিতেই প্রথম হামলা চালায় হেফাজত। 

হেফাজতে ইসলাম নেতা, একাত্তরের রাজাকারপুত্র আল্লামা মামুনুল হক জাতির পিতার ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার ঘোষণা দেয়। এই ভাস্কর্য ইস্যুতে তখন গোটা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বেছে বেছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর রাতের অন্ধকারে হামলা চালায় হেফাজতে ইসলাম, নানা জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক ভাঙচুর করে তারা। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫০ বছর। এই ৫০ বছরে ভাস্কর্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি, এই ৫০ বছরে ভাস্কর্যের কারণে ধর্মের ক্ষতি হয়নি কিন্তু এখন হঠাৎ করেই জাতির পিতার ভাস্কর্য তাদের কাছে বড় ইস্যু হয়ে গিয়েছে। জাতির পিতার ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় না ফেললে তাদের ধর্ম চলে যাচ্ছে! 

ভাস্কর্য ইস্যুর পরেই হেফাজতে ইসলাম আক্রমণ চালালো শাল্লায়। শাল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের মাধ্যমে হেফাজতে ইসলাম তাদের দ্বিতীয় আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার ওপর। ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার যে চর্চা বাংলাদেশ রাষ্ট্র করতে চায় শাল্লায় আক্রমণ হলো সেই নীতির সাথে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।  একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে মামুনুল হকের অনুসারীরা সুনামগঞ্জের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর আক্রমণ চালালেও মূলত এই হামলা ছিলো পূর্ব পরিকল্পিত, ফেসবুক স্ট্যাটাস তো ছিল কেবল একটা বাহানা মাত্র। শাল্লার হামলায় ৮৮টি হিন্দু বাড়ি ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়, ৮টি মন্দির ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। এই ঘটনার একদিন আগে শাল্লায় হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ছিল যেখানে বাবুনগরী ও মামুনুল হক এসেছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে সেখানের মানুষকে উস্কে দিয়েছিল তারা এবং এর ফল এই শাল্লায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ। অথচ এই আক্রমণের ভিডিও ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও হামলাকে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টা চালায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূলস্তম্ভের ওপর একের পর এক আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তি। 

উপরোক্ত প্রতিটি ঘটনা একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনকের জন্মশতবর্ষকে নানা উপায়ে কালিমা লেপনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টায়রত দেশবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে যেনো অনেকটা হঠাৎ করেই আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয় নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের ঘটনা। বাংলাদেশে বহু আগে থেকেই যেহেতু ভারতবিরোধী রাজনীতি চলমান, বিএনপি-জাময়াতের হাত ধরে যেহেতু দেশবিরোধী একটি অংশের মাঝে চরম ভারতবিরোধীতা রয়েছে, ভারতের নাম শুনলেই যারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে তারা সবাই হুমড়ি খেয়ে পরে এই সফরের বিরোধীতার আড়ালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে  বিতর্কিত করতে। 

এখানে স্পষ্ট যে, উপলক্ষ্য নরেন্দ্র মোদি হলেও, মূল টার্গেট ছিল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ মানতে পারেনি মামুনুল হকের পিতা আল্লামা আজিজুল হক। পঞ্চাশ বছরের ক্ষত আজো ভুলতে না পারা আজিজুল হকের উত্তরসূরীরা এখনো পিতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে চায়, চাঁদ-তারা মার্কা বেইমান পতাকার স্বপ্নে বিভোর মামুনুল হক ও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। আর তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে পুরোপুরি বিতর্কিত ও রাষ্ট্রের আয়োজনকে নস্যাৎ করতে হেফাজতে ইসলাম এই ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। নরেন্দ্র মোদি তো একটা ইস্যু মাত্র যেখানে ধর্মীয় কার্ড খেলে সাধারণ মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে কলঙ্কিত করা যাবে। 

লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

বিডি প্রতিদিন/আরাফাত

সর্বশেষ খবর