১৯ জুন, ২০২২ ১৬:১৯

‘প্রতিটি পদক্ষেপে বেঁচে থাকার মানে খুঁজবি’

আসিফ ইকবাল

‘প্রতিটি পদক্ষেপে বেঁচে থাকার মানে খুঁজবি’

‘বাবা, কতদিন দেখি না তোমায়, কেউ বলে না ডেকে ওরে খোকা বুকে আয়’-জেমসের বিখ্যাত গান। যখনই গানটি শুনি, মন আমার তখন কেঁদে উঠে হু হু করে। যিনি আমায় ‘খোকা’ বলে ডাকবেন, ‘বাবা’ বলে ডাকবেন, ‘আসিফ’ বলে ডাকবেন, সেই তিনি আমায় ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ১৩ বছর আগে, ২০০৯ সালে। 

তখন থেকে আর শুনি না, ‘আসিফ, এদিকে আয় বাবা।’ সেই থেকে বাবার পথপানে চেয়ে থাকি- ‘বাবা, তোমায় ভীষণ মিস করি, চলার পথে, কাজের ভিড়ে, তোমায় খুঁজে ফিরি, বাবা, তোমায় ভীষণ মিস করি।’

বাবা জীবনবোধের কথা বলতেন। নিজের বাবা, আমার দাদার গল্প করতেন। গ্রামের গল্প বলতেন। পড়াশোনার কথাও বলতেন। তবে কোনোদিনই আলাদা করে চাপ দেননি পড়াশোনার জন্য। বাবা সব সময়, সবচেয়ে বেশী বলতেন মানুষ হতে, ‘প্রতিটি নিঃশ্বাসে বেঁচে থাকবি, আর নিঃশ্বাসে নতুন কিছু শিখবি। প্রতিটি পদক্ষেপে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে বেড়াবি। প্রতিদিন একজন অসহায়কে আশ্বস্ত করবি। ডাক্তার হবি, না ইঞ্জিনিয়ার হবি, জানি না। কিন্তু একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবি।’

সেই থেকে বাবা তোমার কথাগুলো মন্ত্র বলে মেনে চলছি। বাবা, তোমায় ঘিরে আমার কত স্মৃতি। বারবার ফিরে আসে সেসব। অস্থির হয়ে উঠি তখন। 

১৯৭৮ সাল; অনূর্ধ্ব-২০ যুব এশিয়া কাপ ফুটবলের আসর বসেছে ঢাকায়। ছোট মামাসহ আমায় ও শরীফ ভাইকে নিয়ে সৌদি আরবের খেলা দেখতে গেলেন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে (তখনকার ঢাকা স্টেডিয়াম)। ফ্লাড লাইটের আলোয় সেই প্রথম খেলা দেখা! সে কি আনন্দ, তখন ছোট্ট ওই মনে, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না । 

ক্রিকেট খেলতাম যখন, বাবা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় সমর্থক। দারুণ উৎসাহ যোগাতেন। প্রতিটি খেলার আগে আত্মবিশ্বাসী মন্ত্র জপে দিতেন। খেলার আগের রাতে বলতাম, ‘বাবা, তুমি কিন্তু মাঠে যাবেনা।’ তুমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে, ‘আচ্ছা।’ আর কিছু বলতে না। শুধু একনজর তাকিয়ে মাথায় হাত দিয়ে চলে যাওয়ার আগে বলতে, ‘ঘুমিয়ে পর। শরীরের বিশ্রাম দরকার।’ আমিও বলতাম, আচ্ছা।

বাবা কোনোদিনও আমার কথা রাখেননি- এটা আমার অভিযোগ নয়, অভিমান নয়। ভালো লাগার কথা, ভালোবাসার কথা। ছেলে খেলবে, আর মাঠে যাবেন না, এটা হয় কখনো। তিনি আমার অনুরোধ মানতেই পারতেন না। তাই অফিস থেকেই ছুটে যেতেন মাঠে। চোখের আড়ালে থাকতে কত চেষ্টা ছিল তার। কিন্তু আমার চোখ ঠিকই খুঁজে বের করতো বাবাকে। তখন কপট রাগ দেখাতাম। বাবা হাসতেন।

রাগের ভাব দেখালেও বাবা বিশ্বাস করো, আমি অপেক্ষা করতাম তোমার জন্য। ব্যাটিং কিংবা ফিল্ডিংয়ের সময় পুরো মাঠ চষে ফেলতো আমার চোখজোড়া। খুঁজতাম তোমায় একনজর দেখতে। যখনই তোমায় দেখতাম, কি যে ভালো লাগতো তখন। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আনন্দে নেচে উঠতো মন।

বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গর্ব বোধ করতেন। সময় পেলেই মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেন। বলতেন বঙ্গবন্ধুর কথা। চার নেতার কথাও বলতেন। যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বলতেন, তখন দেখতাম তার তেজোদ্দীপ্ত চেহারা! চোখেমুখে ফুটে উঠতো আনন্দের ঝলকানি। জানবাজি রেখেছো দেশের জন্য। তোমার সন্তান হয়ে গর্ব বোধ করি। তোমরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে আমি গর্বিত। কিন্তু তোমার মান রাখতে পারিনি। তোমার কথাগুলো মানতে চেষ্টা করলেও সত্যিকারের মানুষ হতে পারিনি। বাবা, আমায় ক্ষমা করো।

হাজারো স্মৃতির মাঝে একদিনের কথা বলি। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। জন্ডিসে ভীষণ দুর্বল। মতিঝিল টিএন্ডটি কলোনিতে ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি উচ্চতার ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছে তখন। এক বিকালে বাবার সাথে কষ্ট করে খেলা দেখতে যাই। বন্ধুরা খেলছে, আমার ভীষণ ইচ্ছা করলো খেলার। বাবা বুঝে ফেলেন বিষয়টি। জানতে চাইলেন, খেলবি? ‘হুম বলি।’
 
কিছু বলেন নি। বাসায় চলে আসি সন্ধ্যার আগে। পরের দিন বাবা আমায় মাঠে নিয়ে খেলতে নামিয়ে দেন। আমার মনে আছে, মাঠে ৩/৪ টি দৌড়  দেওয়ার পর বমি করে দেই। ভীষণ কষ্ট লাগছিল। বাবা সাহস যোগাচ্ছিলেন তখন। বাসায় ফেরার পর আমার অবস্থা সিরিয়াস, সবাই বাবাকে অভিযোগ করছেন। কিন্তু বাবা আমার শিয়রে বসে ছিলেন সারা রাত। বাবা, LOVE YOU.

আজ ‘বাবা দিবস’- নির্দিষ্ট একটি দিন। সবাই লিখছে, বলছে। কিন্তু আমার বাবা দিবস প্রতিটি দিন। বাবা, তুমি আমার আজীবনকার ভালোবাসা। তোমায় খুঁজে ফিরবো আমৃত্যু। আমি এখন বাবা। মাঈশা, রুসলানের বাবা। আমার কলিজার টুকরা দু’জন। আমিও আমার বাবার মতো তাদের বলি, ‘তোমরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যারিস্টার, কিংবা যাই হও না কেন, সবার আগে মানুষ হবে। অসহায়ের পাশে দাঁড়াবে।’

আমার সন্তানদের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনায় আল্লাহকে বলি, ‘আমার সন্তানদের তুমি রহম করো।’ অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। কিন্তু মাঈশা, রুসলান ঘুমায়নি। অপেক্ষায় ছিল, বাবাকে শুভেচ্ছা জানানোর। আমি ফিরতেই রুসলান আমায় জড়িয়ে ধরে উইশ করে, ‘বাবা, লাভ ইউ।’ ‘লাভ ইউ টু’ বলতেই মাঈশা জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘আমার লক্ষ্ণী বাবা।’

বাবা, তুমি নেই ১৩ বছর। এখন ওরাই আমার সব। বাবা, মা, স্বর্গ- সব। ওরা যেন তোমার মান রাখতে পারেন, দূর অজানা থেকে ওদের জন্য প্রার্থনা করো। বাবা তোমায় ভালোবাসি নিজের থেকেও বেশী...

বিডি প্রতিদিন/আবু জাফর

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর