দেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন ধরে বেশ খারাপ অবস্থায় পড়ে আছে। পুঁজিবাজারের যে দুটি অবস্থান অর্থাৎ প্রাথমিক পুঁজিবাজার এবং দ্বিতীয় স্তরের পুঁজিবাজার, উভয় খাতেই মারাত্মক স্থবিরতা বিরাজ করছে। প্রাথমিক পুঁজিবাজার মূলত এমন একটি অবস্থান, যেখান থেকে আইপিও (ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং) শেয়ার বিক্রি করে কম্পানি মূলধন সংগ্রহের সুযোগ পায়। একটি লিমিটেড কম্পানি যে পদ্ধতিতে প্রথমেই জনগণের মাঝে শেয়ার বিক্রি করে প্রাথমিক মূলধন সংগ্রহ করে, সেটিই হচ্ছে প্রাথমিক পুঁজিবাজার বা প্রাইমারি মার্কেট।
পক্ষান্তরে কম্পানির ইস্যু করা আইপিও শেয়ার যেখানে বা যে পদ্ধতিতে ক্রয়-বিক্রয় বা হাতবদল হয়, সেটিই হচ্ছে দ্বিতীয় স্তরের পুঁজিবাজার বা সেকেন্ডারি মার্কেট। দেশের স্টক মার্কেট হচ্ছে পুঁজিবাজারের দ্বিতীয় স্তরের বাজার। পুঁজিবাজারের জন্য দুটি পদ্ধতি অর্থাৎ প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি মার্কেট ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার বলতে স্টক মার্কেটকেই বুঝে থাকে।
বেশ কিছুদিন ধরে পুঁজিবাজারের প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি উভয় মার্কেটে মন্দা অবস্থা বিরাজ করলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা স্টক মার্কেটের মন্দা অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রাইমারি মার্কেট যেহেতু আইপিও শেয়ারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই সংখ্যায় কম আইপিও বাজারে এলে সেখানে মন্দা অবস্থা বিরাজ করে। কম আইপিও আসার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিছু লাভ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু এ কারণে তাঁরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হন না। আইপিও বাজার মন্দা থাকলে বিনিয়োগকারীদের চেয়ে উদ্যোক্তা বা কম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বেশি খারাপ অবস্থায় থাকে।
কেননা তারা পুঁজিবাজার থেকে মূলধন সংগ্রহ করতে সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তাদের ব্যবসার অগ্রগতি থমকে যায়। প্রাইমারি মার্কেটের ঠিক উল্টা অবস্থা বিরাজ করে স্টক মার্কেটে। কেননা স্টক মার্কেটে মন্দা অবস্থা থাকলে উদ্যোক্তা বা কম্পানির তেমন কোনো সমস্যা হয় না বললেই চলে। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হন যখন দেশের স্টক মার্কেটে মন্দা অবস্থা বিরাজ করে।
পুঁজিবাজার মন্দা থাকতেই পারে।
কিন্তু মন্দা থাকার চেয়েও বেশি খারাপ অবস্থা হচ্ছে স্থবির হয়ে থাকা। আমাদের দেশে পুঁজিবাজার মূলত স্থবির হয়ে পড়ে আছে। পুঁজিবাজারের বৈশিষ্ট্যই এমন যে এখানে কখনো চাঙ্গাভাব বিরাজ করবে আবার কখনো মন্দা অবস্থা থাকবে। এককথায় পুঁজিবাজার হচ্ছে এমন একটি স্থান, যেখানে ষাঁড় এবং ভালুক (বুল অ্যান্ড বিয়ার) উভয়ই অবস্থান করে। পুঁজিবাজারে ষাঁড় এবং ভালুকের অবস্থান জেনেই বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগ করতে আসেন। কিন্তু তাঁরা এটি কখনো বিবেচনায় নেন না যে এখানে দীর্ঘ সময় স্থবির অবস্থা বিরাজ করবে। আমাদের দেশের পুঁজিবাজার মূলত স্থবির হয়ে আছে দীর্ঘ সময় ধরে।
পুঁজিবাজারে মন্দা অবস্থা বিরাজ করা আর স্থবির হয়ে থাকার মধ্যে পার্থক্য আছে। পুঁজিবাজারে যখন বেশির ভাগ শেয়ারের ক্রমাগত দরপতন ঘটে এবং শেয়ার মূল্যসূচক হ্রাস পেতে থাকে, তখন বলা হয় পুঁজিবাজারে মন্দা অবস্থা চলছে। বেশির ভাগ শেয়ারের দরপতন ঘটলেও শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ যে সব সময় কমে তেমন নয়, বরং শেয়ারের দাম কমলেও শেয়ার লেনদেনের পরিমাণ বাড়তেও পারে এবং অতীতে এ রকম অনেক হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শেয়ারবাজারে মন্দা অবস্থা বিরাজ করলেও বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না। তাঁরা বাজারেই থাকেন এবং অবস্থা বুঝে তাঁদের শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের কৌশল নির্ধারণ করেন। অবশ্য কিছু দুর্বল চিত্তের বিনিয়োগকারী থাকেন, যাঁরা আতঙ্কিত হয়ে তড়িঘড়ি শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে সরে যান। আবার বাজার ভালোর দিকে মোড় নিতেই সেসব বিনিয়োগকারী পুঁজিবাজারে ফিরেও আসেন।
পুঁজিবাজার স্থবির হয়ে থাকার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে শুধু যে শেয়ারের দরপতন এবং শেয়ার মূল্যসূচক হ্রাস পায় তেমন নয়, সেই সঙ্গে শেয়ার লেনদেনের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হ্রাস পায়। শেয়ার লেনদেনে কোনো রকম গতি থাকে না। বিনিয়োগকারীরা দিশাহারা অবস্থায় পড়ে যান। অনেক খুচরা বিনিয়োগকারী তো বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও কিছুটা গুটিয়ে থাকে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের সে রকম তৎপরতা মোটেই লক্ষ করা যায় না। সরকার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকেও সে রকম দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় না। সাধারণত যেসব পুঁজিবাজার সেভাবে পরিপক্ব বা ম্যাচিউরড নয়, সেখানেই এ ধরনের অবস্থা হয়। এর বাইরে যখন দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করে, তখনো সেখানকার পুঁজিবাজারে স্থবিরতা বিরাজ করে। মন্দা পুঁজিবাজারেও শেয়ার লেনদেনের কার্যক্রম যথারীতি চালু থাকে এবং কিছু বিনিয়োগকারী যেমন লাভবান হন, তেমনি অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন, যা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু পুঁজিবাজার যখন স্থবির হয়ে থাকে, তখন বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা এবং দেশের অর্থনীতি সব কিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুঁজিবাজার স্থবির হয়ে থাকার কারণে দুই ধরনের ক্ষতি হয়ে থাকে। প্রথমত, স্বল্পমেয়াদি বা তাৎক্ষণিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা এবং স্টক মার্কেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ। দ্বিতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের পুঁজিবাজার ও অর্থনীতি।
পুঁজিবাজারে বিরাজমান স্থবির অবস্থা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাদের কার্যকর ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপই পারে স্থবির পুঁজিবাজারকে কার্যকর করে তুলতে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে বিএসইসি পুঁজিবাজারকে কার্যকর এবং বিনিয়োগবান্ধব রাখতে সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে বলে মনে হয় না। পুঁজিবাজারে তাদের অবস্থানই এখন সেভাবে বোঝা যায় না। মুদ্রাবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মতৎপরতা অন্তত দৃশ্যমান। ফলাফল যেমনই হোক না কেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপ বেশ আঁচ করা যায়। সেই তুলনায় পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির অবস্থান মোটেই দৃশ্যমান নয়। অবস্থা দেখে মনে হয় যে পুঁজিবাজারের চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি বেশি ঝিমিয়ে পড়েছে। অথচ এ কথা অনস্বীকার্য যে পুঁজিবাজারে বিএসইসি যত বেশি তাদের দৃঢ় অবস্থান দৃশ্যমান করতে পারবে, তত দ্রুত পুঁজিবাজারের স্থবিরতা কাটতে থাকবে। তবে এই দৃশ্যমান অবস্থানের অর্থ এই নয় যে তাদের দেখে বিনিয়োগকারী ভীতসন্ত্রস্ত হবেন। মূলত তাদের দৃশ্যমান কৌশল এমন হবে, যেখানে দুষ্ট বিনিয়োগকারী বা বাজার কারসাজির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের জন্য বিএসইসি হবে এক আতঙ্ক এবং ভালো বিনিয়োগকারীর জন্য হবে সবচেয়ে বেশি আস্থার জায়গা।
সারা বিশ্বে, এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ধরন, বিনিয়োগ মাধ্যম—সব কিছুতেই এসেছে অনেক পরিবর্তন এবং আধুনিকতা। অথচ আমাদের দেশের শেয়ারবাজার সেই সেকেলে ধরনের ব্যক্তি উদ্যোগে স্টক ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। পোর্টফলিও ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সুযোগ সেভাবে সৃষ্টি হয়নি। সম্পদ ব্যবস্থাপনা বা ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট আমাদের দেশে এখনো এক অচেনা বিনিয়োগ প্রডাক্ট। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহকদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ব্যবস্থা একেবারেই নেই। প্রবাসী মিউচুয়াল ফান্ড গঠন করে প্রবাসীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেই। কার্যকর বন্ড মার্কেট চালু করে কম ঝুঁকির, মধ্যম ঝুঁকির এবং অধিক ঝুঁকির বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। সর্বোপরি আমরা দেশের বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরতে পারিনি যে শেয়ারবাজার মোটেই রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জায়গা নয়, বরং এটি ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের একটি বিকল্প ব্যবস্থা, যেখান থেকে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের ওপর উপার্জনের চেয়ে কিছু কম উপার্জন হবে, কিন্তু ভবিষ্যতে ভালো উপার্জনের একটি সুযোগ থাকবে।
দেশে স্থিতিশীল পুঁজিবাজারের স্বার্থে বিএসইসি এই কাজগুলো করতে সক্ষম হয়নি। সরকার পরিবর্তনের পর বিএসইসির পুরো কমিশন অর্থাৎ চেয়ারম্যান, মেম্বার সবাই পরিবর্তন হয়েছেন। এখন যাঁরা এসেছেন, তাঁরা সবাই নতুন এবং তাঁদের পেশগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যথেষ্টই আছে। কিন্তু তার পরও দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নে তাঁরা সে রকম ভূমিকা এখন পর্যন্ত রাখতে পারেননি। বিএসইসির যে কাঠামো, সেখানে কমিশন নিয়োগ হয় নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। পক্ষান্তরে কমিশনের কর্মকর্তারা সেখানে স্থায়ীভাবে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে তাঁদের পেশাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অনেক বেশি। তাঁরা একদিকে যেমন কমিশনকে সহযোগিতা করেন সঠিকভাবে পুঁজিবাজার বিষয়ে নীতি প্রণয়নে, অন্যদিকে তেমনি সেই নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করেন কমিশনের কর্মকর্তারাই। ফলে পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিএসইসির কমিশন ও কর্মকর্তাদের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকতে হয় এবং আছেও। কিন্তু মাঝেমধ্যে কিছু ব্যত্যয় ঘটে এবং তখনই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের শেয়ারবাজারে। এ রকম কিছু ব্যত্যয়ের ঘটনা সম্প্রতি এই বিএসইসিতে ঘটেছে এবং এর প্রভাব নিশ্চয়ই শেয়ারবাজারে পড়েছে। যেসব কর্মকর্তা ভুক্তভোগী, তাঁরা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং তাঁদের অবদান থেকে দেশের শেয়ারবাজার বঞ্চিত হয়। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় যখন ভুক্তভোগী নন এমন কর্মকর্তাও স্বচ্ছন্দে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না এই চিন্তা থেকে যে ভবিষ্যতে তাঁরাও ভুক্তভোগী হতে পারেন। এ রকম অবস্থায় সব কর্মকর্তার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ দেশের পুঁজিবাজার এখন যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে এর উন্নতি ঘটাতে হলে বিএসইসির নিরন্তর কাজ করার প্রয়োজন আছে। কমিশন এবং কর্মকর্তা একযোগে কমিটমেন্ট নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে পারলেই পুঁজিবাজারের স্থবিরতা কাটতে পারে। পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিএসইসির অনেক কিছু করার আছে। কেননা দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নে বিএসইসির ভূমিকাই মুখ্য।
লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা