হোক একতরফা, তবু তো হয়েছে। একেবারে না হওয়ার চেয়ে উত্তম। গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হলো রবিবার শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার হলি ডেতে। গত ৯ মাসে কত জন, কত মহলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তাঁর।
বেসরকারি সেক্টর, বেসরকারি বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হয়নি। দেশি বিনিয়োগকারী, ব্যবসায়ী তথা পুঁজিবাজারের গুরুচরণদশা যেন দৃষ্টিতেই নেওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে শর্টকাটে কিছুটা একতরফা ধাঁচের হলেও হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়) আনিসুজ্জামান চৌধুরী, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক।
মোটকথা গুরুত্ব পেলেন অর্থ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এনবিআর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ সরকারি নীতিনির্ধারকরাই। ডিএসই, ডিবিএ, বিএপিএলসির প্রতিনিধিরা মুখ্য নন। বিনিয়োগকারীরাও আমল পাননি।
এর পরও প্রধান উপদেষ্টাতেই আস্থা-ভরসা।
শেয়ারবাজারের উন্নয়ন ও বাজারকে শক্তিশালী করতে তাঁর পাঁচ নির্দেশনা এ সময়ের জন্য প্রত্যাশিত। টনিক বা কোরামিনের মতো নির্দেশনাগুলো হচ্ছে : দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী যেসব বিদেশি বা বহুজাতিক কম্পানিতে সরকারের মালিকানা রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত বাজারে আনার ব্যবস্থা করা; বেসরকারি খাতের ভালো ও বড় বড় কম্পানিকে প্রণোদনা দিয়ে হলেও বাজারে আনার উদ্যোগ নেওয়া; পুঁজিবাজার সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করতে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে তিন মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া; অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া এবং বড় বড় কম্পানি যাতে ব্যাংকঋণের বদলে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া।
জরুরি মনে করার কারণেই হয়েছে বৈঠকটি। নির্দশনাগুলোও প্রাসঙ্গিক। অভিযোগ আছে এমন কম্পানি ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত-নির্দেশনাও জরুরি ছিল।
এসব সিদ্ধান্তের একটা প্রভাব নিশ্চয়ই এ সপ্তাহেই পড়তে শুরু করবে। ছোট-বড় বিনিয়োগকারীদের কামনা, সূচক রথের চাকা ঘুরুক। ডানা মেলে ঊর্ধ্বমুখী উড়ুক। সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধ দামামা কেবল দেশের নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রতে নাড়া দেয়নি, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ-উৎপাদন বৃদ্ধি, দেশি পুঁজির নিরাপত্তা, ছোট-বড় মাঝারি বাণিজ্য ও শিল্প বিকাশের তাগিদও দিয়েছে। সরকারের অভ্যন্তরেও অনুভূতির একটা নাড়া পড়েছে। কারণ অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক বাজার সম্প্রসারণ করতেই হবে। দেশি-বিদেশি জাত না খুঁজে বিনিয়োগ বাড়ানো, পুঁজিবাজারের শক্তি বাড়ানো, জনবান্ধব করনীতি সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের ঋণনির্ভরতা কমাতে বিনিয়োগ উৎপাদন বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ উৎস ও পুঁজিবাজার ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। একটু বিলম্বে হলেও সরকার সেই পথ মাড়াতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান। প্রয়োজনে পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ছোট-বড়দের সঙ্গে সরকার দফায় দফায় বসতে পারে।
গৃহীত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে তাঁদের পরামর্শ ও সহযোগিতা পাওয়া সরকারের জন্য কঠিন নয়। ব্যবসায়ী ও বিরিয়োগকারীদের নিয়ে বসলে তাঁরা আরো পথ দেখাতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা হচ্ছে তাঁদের রাজনীতিমুক্ত রাখা। নিশ্চিন্তে ব্যবসায় মনোযোগী থাকতে পারা। সেই সঙ্গে গুরুতর অভিযোগে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত অবশ্যই করতে হবে। তা ব্যবসা বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বা উৎপাদনের চাকা বন্ধ করে নয়। ব্যাপক বিনিয়োগ, গতিময় ব্যবসা, চাঙ্গা পুঁজিবাজার, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধিসহ সম্ভাবনার দরজা-জানালা খোলা রাখা সরকারকে বাজেট সহায়তা দিতে পারে। তখন বাজেট সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছে এত ধরনা দিতে হবে না। দেশের শেয়ারবাজারের আইসিইউতে থাকার তথ্য গোপন রাখার কোনো সুযোগ নেই। ৫ আগস্টের পর বিএসইসি চেয়ারম্যানসহ অনেক সদস্যকে চলে যেতে হয়েছে, যা পরিস্থিতির অনিবার্যতা। চব্বিশের ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর পরিবর্তনের আশায় ৬-৮ আগস্ট মানুষ নতুন সরকারের প্রতি আশাবাদী হয়। তলানিতে পড়ে থাকা শেয়ারের মূল্যে ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। আর ৮ আগস্ট নতুন সরকার ক্ষমতায় বসতে না বসতেই বাজারে মূল্যপতন শুরু হয়। দেশের গোটা অর্থনীতির বেহাল ধামাচাপা দিয়ে রাখারও সুযোগ নেই। পুরো বিষয়ই ওপেন সিক্রেট।
দেরিতে হলেও পুঁজিবাজারের দিকে সরকারের মনোযোগ ও উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক একটি ইতিবাচক ঘটনা। সেখানে মাত্রা যোগ হতে পারে ছোট-বড় বিবেচনা না করে বিজনেস কমিউনিটির সঙ্গে সংযোগ বাড়ানো। তাদের কথা শোনা, অভিজ্ঞতা শেয়ার করা। তাদের সব কথা রাখতে হবে, বিষয়টা মোটেই এমন নয়। সংযোগ গড়লে উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক তথ্য পাবে। জানতে পারবে বাজারের ভেতরের অবস্থা, যার মধ্য দিয়ে সহজ হয়ে আসতে পারে বাজার ব্যবস্থাপনার পথঘাট। বিগত সরকারের লুটতরাজ, পাচার, দুর্নীতিতে বাজারের এ অবস্থা বা মূল্যস্ফীতি বাড়ছে—সত্য হলেও এসব কথা শুনতে শুনতে কাহিল অবস্থা মানুষের। তারা মাগনা বা ফ্রি কিছু চায় না। কন্ট্রোল রেটেও চায় না। চায় সাধ্যের মধ্যে কেনাকাটায় জীবন নির্বাহ করতে। সেখানেই চরম খরার টান। আর আঙুল দেখায় ৯ মাসের সরকারের দিকে। বাস্তবটা সরকারের জন্য বড় নিদারুণ। গেল সাড়ে ১৫ বছর দেশে চলা অকল্পনীয় লুটপাটের জেরে অর্থনীতির ক্ষত শিগগিরই শুকাবে না। সময় লাগবে। সেই সময়টা যেন কম লাগে, ব্যবস্থাটা করতে হবে সরকারকেই। এ কাজে শ্রীলঙ্কার ধাঁচে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা হতে পারেন সরকারের সহায়ক-অনুঘটক।
শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল। এখন তা মাইনাস ৫ শতাংশ। তাদের শেয়ারবাজারের ইনডেক্স বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বিনিয়োগ ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদনও চাঙ্গা। তারা সরকার পরিচালনাকে প্রশাসনিক কাজের চেয়ে বেশি ভেবেছে ব্যবস্থাপনার কাজ হিসেবে। সেই ব্যবস্থাপনার সারথি করেছে দেশটির ব্যবসায়ীদের। কিন্তু আমাদের এখানে বাস্তবতা একদম ভিন্ন। নানা কাজে ও আচরণে বিজনেস কমিউনিটিকে প্রতিপক্ষ করে ফেলা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এর মাঝে কিছুটা দেড় যুগ আগে এক-এগারো পটপরিবর্তন পরবর্তী ছাপ দেখছেন। ওই সময় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের ধরে আটকে রাখা, অনৈতিকভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এবং ব্যাবসায়িক পরিবেশ বিপন্ন করে দেশের ঘাড়ে বেকারত্বের বোঝা বাড়িয়ে দেওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাঁদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ীর নামে হত্যা মামলাসহ নানা হয়রানি সেই ঘায়ে টোকা দিচ্ছে, যা তাদের জন্য পূর্ণিমা-অমাবশ্যায় পুরনো ব্যথা-যন্ত্রণা চাগাড় দেওয়ার মতো। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২১৬ জন বড় শিল্পোদ্যোক্তা ও রাজনীতিককে কারাগারে আটক রাখা হয়। সে সময় ব্যবসায়ীদের জরিমানার নামে শুধু হয়রানি নয়, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনও করা হয়েছে। জোর করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এক-এগারোর পর ১৭-১৮ বছরেও সেই টাকা ফেরত পাননি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। সেই ধকল এখনো টানতে হচ্ছে।
এবার ব্যবসায়ীদের একটা প্রত্যাশা ছিল, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে নানা কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে চেপে বসা স্থবিরতা একটু একটু করে কাটানোর ব্যবস্থা হবে। বাস্তবে হয়েছে বিপরীত। শিল্প-কারখানায় হামলা-ভাঙচুর, ব্যবসায়ীদের নামে হত্যা মামলার আপদ নেমেছে। এ দেশে বরাবরই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব শিল্পঋণ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংকগুলো স্বল্পমেয়াদে ঋণ নেয় তিন থেকে পাঁচ বছরের হিসাবে। এর বিপরীতে শিল্পঋণের মেয়াদকাল ১৫ থেকে ২০ বছর হয়। যথাযথসহ জামানত নেওয়া সম্ভব হয় না। এ ছাড়া ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কালে বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়। এরাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়। ইচ্ছাকৃত ছাড়াও ব্যাবসায়িক মন্দা, বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা, সরকারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতির কারণে অনেকে খেলাপি হয়। এর বিপরীতে ক্ষুদ্র ও মাইক্রো লেভেলের শিল্প ব্যবসায় ঋণ আদায়ের হার ৯৮ শতাংশের ওপরে। শিল্পঋণের বিকল্প হতে পারত ভাইব্র্যান্ট ক্যাপিটাল মার্কেট গঠন। পৃথিবীর সব দেশ যে কারণে এমন শেয়ার মার্কেট গঠনে উদ্যোগী হয়। শ্রীলঙ্কা এটা বুঝেছিল। তাই অর্থনীতির চেহারা ফেরাতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। আর এখানে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর প্রায় ৯০ শতাংশ পুঁজিই হাওয়া। ক্রমাগত লোকসানের কারণে গত ৯ মাসে ৩০ হাজার বিনিয়োগকারী সব শেয়ার বিক্রি করে কেনাবেচার বিও অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। ৫৭ হাজার বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এই সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক এক হাজার পয়েন্টের বেশি কমেছে, যার কারণে পুঁজিবাজারের যাচ্ছেতাই অবস্থা।
এ অবস্থার লাগাম টানতে রবিবার প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকটি কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছে। এ আশার বিস্তার-বিস্তৃতি ধাপে ধাপে বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের দিকে আগুয়ান হোক। সাধারণ মানুষ কিন্তু এগিয়েই থাকছে। তাদের ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী হওয়ার সামর্থ্য নেই। তারা পারে যদ্দুর সম্ভব সঞ্চয় করতে। তা করছেও, যার ইঙ্গিত মিলছে গত মাস কয়েক ধরে সাধারণ বিল-বন্ডের পাশাপাশি প্রাইজ বন্ডেও বিনিয়োগ বাড়তে থাকার ঘটনা। ব্যবসা-বিনিয়োগ বাড়লে, সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমলে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তাদের সঞ্চয় প্রবণতা আরো বাড়বে। এর মাঝে হিতে বিপরীত হওয়ার শঙ্কাও থাকে। কেনাকাটা কমিয়ে, কম খেয়ে প্রাইজবন্ড বা অন্য কোনো খাতে টাকা আটকে রাখাকে প্রবৃদ্ধি বলা যাবে, অর্থনীতির উন্নতি বলা যাবে না।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন