মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন অনেক প্রবাসী। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির তালিকাভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও দ্বিধাহীন চিত্তে কমলা হ্যারিসকে ভোট প্রদানের সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হননি অধিকাংশ প্রবাসী। আগাম ভোটে যারা অংশ নিচ্ছেন তারাও জানাতে চাননি কোন প্রার্থীকে ভোট দিলেন। মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিতে বাইডেন-কমলা প্রশাসনের আচরণে ক্ষুব্ধ মুসলিম আমেরিকানরা। নতুন প্রজন্মের অধিকাংশ একইভাবে কমলা হ্যারিসকে ভোট না প্রদানের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন।
এদিকে, আগাম ভোট কেন্দ্র পরিদর্শনকালে দেখা যায়- বাইরে এবং ভেতরে বাংলা নির্দেশিকার পাশাপাশি ব্যালটেও বাংলার ছাপ রয়েছে। অনেক কেন্দ্রে বাংলা অনুবাদকও আছেন। এর ফলে মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থায় বাংলা ভাষার পাশাপাশি বাঙালির বিচরণকেও মেনে নেয়া হয়েছে।
বুধবার (৩০ অক্টোবর) পর্যন্ত গত ৫ দিনে নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, কানেকটিকাট, ম্যাসেচুসেট্স, ফ্লোরিডা, ম্যারিল্যান্ড, জর্জিয়া, মিশিগান, ইলিনয়, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, আরিজোনা, মিনেসোটা, ভার্জিনিয়া প্রভৃতি স্টেটের নেতৃস্থানীয় ৫ শতাধিক বাংলাদেশি আমেরিকানের সাথে কথা হয় বাংলাদেশ প্রতিদিনের। প্রায় সকল স্টেটেই আগাম ভোট শুরু হয়েছে। অধিকাংশই ভোট দিয়েছেন। ভোট প্রদানকারিগণের মধ্যে ৮০% এর অধিক ডেমক্র্যাটিক পার্টির সমর্থক। ৫% হলেন স্বতন্ত্র এবং ১৫% এর মত রিপাবলিকান। সামগ্রিক ভোটের হিসাবে তালিকাভুক্ত বাংলাদেশি আমেরিকান ভোটারের ৯০% হলেন ডেমক্র্যাট। অর্থাৎ ৯০% ভোটই পাবার কথা কমলা হ্যারিসের। কিন্তু ৫০% এর অধিক দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ২০% দিচ্ছেন গ্রীণ পার্টির জিল স্টাইনকে।
প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভুত এবং প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হবেন বিজয়ী হতে পারলে, এতকিছু স্বত্ত্বেও কেন কমলা হ্যারিসকে ভোট দিচ্ছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশ প্রবাসীই প্রচন্ড ক্ষোভের সাথে বলেন, গাজা পরিস্থিতিতে জো বাইডেনের সহযোগী হিসেবে কমলাও কম দায়ী নন। এমনকি নির্বাচনী সমাবেশে কখনোই কমলা বলেননি যে, বিজয়ী হতে পারলে গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গিকারও করেননি। এছাড়া করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা দূরের কথা, যুদ্ধ লাগিয়ে বিপাকে ফেলেছেন স্বল্প আয়ের আমেরিকানদের। ইমিগ্রেশন ইস্যুতে দৃশ্যমান কিছু করার উদ্যোগ নেননি কমলা হ্যারিস। অথচ জো বাইডেন তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সীমান্ত অতিক্রমে আগ্রহী বিদেশীদেরকে নিবৃত্ত করতে যথাযথ একটি উপায় খুঁজে বের করতে।
বস্টনভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক ‘ইন্টারন্যাশনাল সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউট’ (আইএসডিআই)’র নির্বাহী পরিচালক ইকবাল ইউসুফ ‘স্বতন্ত্র ভোটার’ হিসেবে তালিকাভুক্ত। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আগাম ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে। কারণ, ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত হোয়াইট হাউজে অধিষ্ঠিত থাকাবস্থায় নতুন কোনও যুদ্ধ বাধাননি। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছিলেন। ইমিগ্রেশন ইস্যুতেও ইতিবাচক মনোভাব দেখেছি।
ইকবাল ইউসুফ আরও জানান, ট্রাম্প আবারো প্রেসিডেন্ট হলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ থামবে-এটা প্রায় নিশ্চিত। এছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধেরও শান্তিপূর্ণ অবসান ঘটতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থার অবসান ঘটাতেও ট্রাম্প সিদ্ধহস্ত।
ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান এবং আরিজোনা কম্যুনিটির নেতা মাহাবুব রেজা রহিম বলেন, আমি আগাম ভোটে অংশ নিয়ে কমলা হ্যারিসকে ভোট দিয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বতন্ত্র ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হলেও নানাবিধ কারণে কমলাকেই অধিক যোগ্য বলে মনে করেছি। এছাড়া আড়াই শত বছরের ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হলে সেই ইতিহাসের অংশ হবার প্রত্যাশা থেকেই কমলা হ্যারিসকে বেছে নিয়েছি। তবে আরিজোনার অনেক মানুষ কমলা এবং ট্রাম্পের বদলে গ্রীনপার্টির জিল স্টাইনকে ভোট দেবেন বলে ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন। গাজায় মুসলিম নিধনে ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তার প্রতিবাদে মুসলিম আমেরিকানরা এমন সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন।
আমেরিকান মুসলিম ডেমক্র্যাটিক ককাসের চেয়ারম্যান জোনায়েদ আকতার বলেন, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতিতে বাইডেন-কমলার ভূমিকায় অনেকেই বিতশ্রদ্ধ। আমিও সন্তুষ্ট নই কমলার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতায়। তবুও কমলা হ্যারিসকেই ভোট দিতে হবে ককাসের নীতি অনুযায়ী। তবে ফ্লোরিডা, জর্জিয়ার অনেক বাংলাদেশি আমেরিকান ভোটার কমলাকে ভোট দেবেন এমন নিশ্চয়তা পাইনি। যদিও সকলেই ডেমক্র্যাটিক পার্টির সমর্থক।
নিউইয়র্ক সিটির কুইন্স কাউন্টি ডেমক্র্যাটিক পার্টির জুডিশিয়াল ডেলিগেট মাজেদা এ উদ্দিন বলেন, গাজা ও লেবানন পরিস্থিতি ও ইমিগ্রেশন ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বাংলাদেশি আমেরিকান কমলা কিংবা ট্রাম্প কাউকেই ভোট দিতে চাচ্ছেন না। তারা গ্রীনপার্টির জিল স্টাইনকে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। এরফলে ট্রাম্পের বিজয় ত্বরান্বিত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এ শ্রেণির ভোটারের ধারণা, ট্রাম্প পুনরায় প্রেসিডেন্ট হলে নতুন যুদ্ধ বাধবে না। অধিকন্তু চলমান যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। শুধু তাই নয়, চীনের পণ্য আমদানী করলে ৬০% ট্যাক্স ধার্য করবেন। কমলার এমন কোনও পরিকল্পনার কথা কেউ জানেন না।
নিউইয়র্ক অঞ্চলের প্রবাসীদের সর্ববৃহৎ সামাজিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’র নবনির্বাচিত সভাপতি আতাউর রহমান সেলিম বলেন, সকলকে অনুরোধ জানিয়েছি কমলা হ্যারিসকে ভোট প্রদানের জন্যে। কারণ ডেমক্র্যাটরাই ইমিগ্র্যান্টদের প্রকৃত বন্ধু। কম্যুনিটি লিডার ও সাংস্কৃতিক সংগঠক দ্বীনেশ মজুমদার বলেছেন, আমি ট্রাম্পকে ভোট দেব। কারণ তিনি হোয়াইট হাউজে থাকাবস্থায় বিশ্বে কোনও যুদ্ধ বাধাননি। অধিকাংশ শান্তির জন্যেই কাজ করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হোসাইন বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিসহ নানাবিধ কারণে ট্রাম্পকে ভোট দেব। চলমান যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প সত্যিকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।
ডেমক্র্যাটিক পার্টির নিবন্ধিত ভোটার হয়েও কেন কমলা হ্যারিসকে ভোট দিতে চান না- এমন প্রশ্নের জবাবে জ্যামাইকার এসআরকে রিয়েল্টর ইনকের মোহাম্মদ আহমদ বলেন, জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কিছুই করতে পারেননি। শুধু মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন। এজন্যেই ইমিগ্র্যান্ট এবং ব্যবসায়ীদের সত্যিকারের বন্ধু ট্রাম্পকে ভোট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
জ্যাকসন হাইটসের ফ্রেশ বেকারির অন্যতম মালিক নাহিদ খান বলেন, ডেমক্র্যাট পার্টির সমর্থক হলেও কমলাকে ভোট দেব- এ ব্যাপারে এখনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি। ট্রাম্পের আমলে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো ছিল। বাইডেনের আমলে একেবারেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সেজন্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছি। নিউইয়র্কে হিন্দু কম্যুনিটির নেতা মনতোষ দে বলেন, যুদ্ধ-পরিস্থিতি এবং জননিরাপত্তার ব্যপারটিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। ইমিগ্রেশন ইস্যুতে কমলা কতটা দায়িত্ব পালন করেছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেটিও বিশ্লেষণ করছি। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেব।
কম্যুনিটি লিডার এবং রিয়েল অ্যাস্টেট ব্যবসায়ী সমীরুল ইসলাম বাবলু বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতিকে শান্ত করার পাশাপাশি আমেরিকার অর্থনীতি-কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সক্ষম-এমন একজনকে প্রেসিডেন্ট পদে দেখতে চাই। সেজন্যেই হোয়াইট হাউজের নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ভোট দেব।
মিশিগান কম্যুনিটির লিডার সৈয়দ শাহেদুল হক জানান, গাজা ও লেবানন পরিস্থিতিতে বাইডেন-কমলার ভূমিকায় ক্ষুব্ধ অনেকে। এজন্যে কমলার ভোট ব্যাংকে কিছুটা হলেও ধস নেমেছে। তবে ট্রাম্প ক্ষমতা পেলে মুসলিম আমেরিকান এবং ইমিগ্র্যান্টরা যে নাজুক অবস্থায় নিপতিত হবে-সেটি বুঝানোর চেষ্টা করছি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সংগঠক হিসেবে। শেষ পর্যন্ত কী হবে কিছুই অনুধাবনে সক্ষম হচ্ছি না।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ