১৪ এপ্রিল, ২০২১ ১০:১০

মনজমিনে তাকওয়ার বীজ রুয়ে দেয় সিয়াম

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

মনজমিনে তাকওয়ার বীজ রুয়ে দেয় সিয়াম

আজ মাহে রমজানের প্রথম দিন। আজ থেকে মাবুদের অফুরান রহমতের বারিধারা বর্ষিত হবে রোজাদারের রুহে। বরকতের জোয়ার লেগে ফুলফল ফুটতে থাকবে মনের জমিনে। নাজাতের সওগাত বিতরণ হবে আজ থেকে সারা জাহানে। রমজান আসে নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নয়ন, সামাজিক শিষ্টাচার, পারস্পরিক সহনশীলতা, সাম্য, মৈত্রী ও শান্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে। তাকওয়া-খোদাভীতি, ধৈর্য, ত্যাগ, সাধনা, দয়াদ্রতা, দানশীলতা ও মানব প্রেমের মতো নৈতিক গুণাবলির বিকাশ হয় এই মাসে। একমাত্র নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলির কারণেই মানুষ সৃষ্টির সেরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দিতেই প্রতি বছর আসে মাহে রমজান। মানুষ যখন নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলি হারিয়ে ফেলে তখন হয়ে যায় ইতর পশুর মতো; বরং তার চাইতেও অধম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি অনেক জিন ও মানুষকে সৃষ্টিই করেছি জাহান্নামের জন্য। কারণ তাদের অন্তর আছে, কিন্তু তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে, তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে, তারা শোনে না। এরা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং এরচেয়েও নিকৃষ্ট। আর এরাই গাফেল। সুরা আরাফ, আয়াত ১৭৯। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী-সংশ্রব থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম। এ সময় ক্ষুধা-পিপাসার অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে রোজাদার আল্লাহর ভয়ে পানাহার থেকে বিরত থাকেন। প্রাণপ্রিয় স্ত্রী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় শুধু আল্লাহর ভয়ে। এভাবে কাম, ক্রোধ, লোভ ও নানারকম মন্দ স্বভাব যেগুলো মানুষকে নিয়ে যায় পশুর স্তরে, জন্ম দেয় সমাজে নানা অশান্তি ও অনাচার; এসবের সঙ্গে রোজাদারের সংগ্রাম চলে এক মাসব্যাপী। এক মাসের এ কৃচ্ছ্রসাধনা ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ নিজের নফস বা প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। দেহ পরিচালিত হয় নৈতিক চরিত্র ও বিবেকের নির্দেশ মতো। এভাবেই মানব দেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় বিবেকের শাসন ও আল্লাহর রাজত্ব। ফলে মাটির মানুষ পরিণত হয় সোনার মানুষে। সারা দিন রোজা রেখে সন্ধ্যায় ইফতারের পর ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর যখন বিছানায় মিশে যেতে চায় তখনই তাগাদা আসে তারাবি নামাজের। যুবক, বৃদ্ধ, কিশোর মিলে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারাবি নামাজ আদায় করে মসজিদসমূহে মুসল্লিরা। তারাবির পর বিশ্রামের জন্য যেতে না যেতে আবার শেষ রাতে সাহরি খাওয়ার ডাক পড়ে। রমজানে কর্মব্যস্ততা আর তৎপরতা মানুষের যাবতীয় অলসতা-বিলাসিতা দূর করে তাকে সতেজ করে দেয়। এ মাস নিত্য-নতুন কর্মচাঞ্চল্য ও কর্ম ব্যস্ততায় উজ্জীবিত করে রোজাদারকে। প্রত্যেকের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় সুষ্ঠু নিয়ম শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা। রমজান হচ্ছে মুসলমানদের আত্মশুদ্ধি, আত্মগঠন সামাজিক উন্নতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মাসব্যাপী এক কর্মশালা। এই কর্মশালা রোজাদারের মনে জাগিয়ে দেয় আল্লাহর ভয় ও আখেরাতে আল্লাহর অফুরান প্রতিদান লাভের ইচ্ছা। এ জন্য রোজার প্রধান শর্ত হচ্ছে, পানাহার ও স্ত্রী সংশ্রব ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত ও সওয়াবের নিয়ত করা। সহিহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমলের প্রতিদান নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’। বুখারি। বিশুদ্ধ নিয়তের রোজা মুমিন বান্দার অন্তরে এনে দেয় দুর্জয় শক্তি। যে শক্তি বান্দাকে আল্লাহর দাসত্ব ও প্রতিনিধিত্বের যথার্থ উপলব্ধি দিয়ে পাশাপাশি বানিয়ে দেয় ইনসানে কামেল। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ইমান ও এহতেসাব অর্থাৎ আত্ম বিশ্লেষণসহ রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।’ বুখারি। এমনিভাবে রোজা সম্বন্ধে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ পাক বলেন, ‘রোজা একমাত্র আমার জন্য এবং তার প্রতিদান আমি নিজ হাতে দেব, অথবা অন্য অর্থে আমিই স্বয়ং তার প্রতিদান।’ বুখারি ও মুসলিম।

যারা সমাজের ওপর তলার বাসিন্দা তারাও রমজানে উপোস থেকে উপলব্ধি করতে পারবেন অনাহার-উপবাসের কী ভয়াল যন্ত্রণা। তাই তারা নিজের সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ জাকাত হিসেবে বিতরণ করেন গরিবদের মাঝে। রমজান শেষ হতেই তারা ফিতরা দিয়ে দেন অভাবী লোকদের হাতে। আর সে জাকাত-ফিতরায় গরিবদের সংসারে ফিরে আসে সচ্ছলতা। ধনীর ধনের প্রতি হিংসা আক্রোশের পরিবর্তে গরিবদের মনে জাগ্রত হয় শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার ভাবধারা। আল্লাহর জন্য দান করে ধনীরাও পায় অনাবিল তৃপ্তি ও কল্যাণ। এমনি করে মাহে রমজানে ধনী ও গরিবের মাঝে মমত্ব, ভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার অনুশীলন হয়। বিকশিত হয় অশরাফুল মাখলুকাতের অনন্য রূপসৌন্দর্য। দুনিয়ার সর্বত্র আজ ধনী-গরিবে চলছে শ্রেণি সংগ্রাম, হানাহানি, রক্তপাত। সমাজের একদিকে দেখি পুঁজিপতিদের স্বর্গসৌধ, অন্যদিকে সেই সৌধের প্রাচীর ঘেঁষে অনাহার-ক্লিষ্ট দরিদ্র মানুষের সারি। এক্ষেত্রে রমজানুল মোবারকের আদর্শ হচ্ছে সর্বহারা আর পুঁজিপতির আকাশ-পাতাল ব্যবধান দূর করে সমাজে সাম্য ও শান্তিধারা বইয়ে দেওয়া। রমজানের পর ঈদের দিনে আমরা সাম্য মৈত্রীর সেই শান্তিময় সমাজ ব্যবস্থারই প্রদর্শনী দেখতে পাই মুমিনের ঘরে ঘরে আর ঈদের ময়দানে। দুনিয়ার সব অশান্তির মূল হলো আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস ও আখেরাতের প্রতি উদাসীনতা। রমজান মানুষের মনে জাগিয়ে দেয় আল্লাহর ভয়, আত্ম-উপলব্ধি ও পরকালে জবাবদিহির তীব্র অনুভূতি। ফলে কোনো বিশেষ ফোর্স বা দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রয়োজন হয় না রোজাদারকে শাসন করার জন্য। রোজাদার আল্লাহর ভয়ে নিজে নিজেই সংযত হয়ে যায়। আদর্শ নাগরিক, সোনার মানুষ, আল্লাহর প্রতিনিধি, দীনের মুজাহিদ প্রভৃতি যে কোনো উপাধিই প্রযোজ্য হয় রোজাদারের জন্য। আল্লাহ আমাদেরকে মাসব্যাপী সাধনায় একনিষ্ঠ সাধক বানিয়ে দিন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি। পীর সাহেব, আউলিয়ানগর। www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর