১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ১৪:৫০

ফুলি

নাইম আবদুল্লাহ

ফুলি

প্রতীকী ছবি

ফুলি ঘরের দাওয়ায় মন খারাপ করে বসে আছে। আজ রাতে তার বাজান যাত্রা পালা গাইতে গঞ্জে যাবে। বাজানকে ছেড়ে থাকতে তার একদম ইচ্ছে করে না। যতক্ষণ বাজান ঘরে থাকে ফুলি সবসময় তার কাছাকাছি থাকে।

ফুলির বাজান রজব মৃধা যাত্রাদলে পাঠ গায়। যাত্রা দলের সাথে সে গঞ্জে গঞ্জে ঘুরে বেড়ায়। একেকবার সে তিন থেকে চার মাস গঞ্জে কাটায়। ফুলির বয়স পাঁচ বছর। মেয়েটার জন্মের পর তার আর গঞ্জে যেতে ইচ্ছে করে না। ফুলির মা আঙ্গুরি বেগমকে বিয়ে করেছে প্রায় এক যুগ আগে। অনেক তাবিজ কবজ ঝাড় ফুঁক আর মান্নত পানি পড়া খাওয়ানোর সাত বছর পর ফুলির জন্ম হয়। মেয়েটার জন্মের সময় তার ইচ্ছে ছিল আঙ্গুরির পাশে থাকার। কিন্তু জন্মের সপ্তাহ খানেক আগে যাত্রার নতুন কাজ পাওয়ায় তাকে আগেভাগেই চলে যেতে হয়েছিল।

তখন পৌষ মাসের কনকনে শীতের রাত। পাঠ গেয়ে মঞ্চ থেকে গ্রিনরুমে ঢোকার মুখে যাত্রাদলের মালিক প্রশান্ত বাবু তাকে ফুলির জন্মের সুখবরটা দেয়। আঙ্গুরি কাউকে দিয়ে প্রশান্ত বাবুর মোবাইলে ফোন করে খবরটা দিয়ে রেখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে রজব যাত্রাদলের সবাইকে আমিত্তি খাওয়ানোর ঘোষণা দেয়। পরদিন ভোরেই সে গঞ্জ থেকে ফুলির জন্য জামাকাপড় পুতুল আর আঙ্গুরির জন্য শাড়ি কেনে।

খাওয়া সেরে দাওয়ায় হাত ধুতে এসে দেখে ফুলি বেজার মুখে বসে আছে।

ফুলি মা তুমি এইহানে একলা বইয়া কি করো?

বাজান তুমি চইলা যাইবা, মনটা ভালো ঠেকতাছে না।

মা’রে আমি তো যামু আর চইলা আমু। তুমার লাইগা গঞ্জের থনে এইফিরা কি কি সদাই পাতি আনন লাগবো?

বাজান আমার আর কিচ্ছু লাগবো না। তোমারে মেলাদিন না দেইখা থাকতে কষ্ট লাগে। এইবার বাজান গঞ্জে না গেলে অয়না?

না রে মা। এইবার যাওনই লাগবো। না গেলে আমার পাঠ কইবো কে? এইবার দেহিস যামু আর পলকেই ফিরা আমু।

তারপর রজব ফুলির কপালে আর গায়ে হাত দিয়ে দেখে গায়ে এখনও বেশ তাপ। মধু কবিরাজের কাছ থেকে নিয়মিত পথ্য খাওয়ানো হচ্ছে কিন্তু তাপটা কিছুটা ঝিমিয়ে আবার ফাল দিয়ে ওঠে। ফুলির মাও তাকে এবার গঞ্জে যেতে বারণ করেছিল। কিন্তু তার না গিয়ে উপায় কি? নতুন পালা নামবে তার হয়ে পাঠ গাইবার আর কেউ নাই। আর এই মৌসুমে এটাই শেষ পালা। না গেলে আগামী সিজন অব্দি উপোষ দিয়ে মরতে হবে।

রজব ফুলিরে কোলের মধ্যে টেনে নেয়। আঙ্গুরি থালাবাসন গুছিয়ে পাশে এসে বসে।

মাগো এইবার ফেরত আইসা তোরে পাঠশালায় দাখিল কইরা দিমু। পাঠশালার মাস্টারের সাথে আমার পাকা কথা হইছে।

বাজান পইলা দিন কইলাম তোমারে আমার লগে যাওনই লাগবো।

রজব ও আঙ্গুরি দুজনেই হেসে ওঠে। 

হইলো মা লক্ষ্মী, পহেলা দিন পাঠশালায় গিয়া হগল সময় তোর লগে থাকমু অনে। তয় তার বাদে আর থাকবার পারুম না।

কেন বাজান হগল দিন থাকলে কি অইব?

পাঠশালার পোলাপানেরা তোরে চেতাইবো। তোরে ভীরু কইব।

হইলো বাজান তয় তুমি কিন্তু আমারে ছুটি অইলে নিতে আইবা?

হ আমি পাঠশালার বড় গাছটার পাশে লুকাইয়া তোরে দেইখা রাখমুনে আর ছুটি ওইলেই তোরে কান্ধে লইয়া বাড়ি ছুট দিমু।

পাশের থেকে আঙ্গুরি বলে ওঠে, আফনে ফিরলে এইবার কিন্তু হক্কলে মিল্লা আমার বাজানরে দেখবার যামু। ফুলি কোলে আসার পর থনে আর বাজানের লগে দেহা নাই। বাজানে ফুলিরে দেখবার লাইগা পথের পানে চাইয়া বইয়া আছে।

অইল বউ এইবারে ফেরত আইয়া আমরা তোমার বাজানের বাড়ি থনে ঘুইরা আমুনে।

দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। আঙ্গুরি রজবের কাপড়ের বোচকাটা গুছিয়ে দেয়। ফুলি রজবকে উঠতে দেয় না। সে বউয়ের হাত থেকে পাঞ্জাবী নিয়ে উঠে পড়ে। ফুলি তার হাতে গুজে রাখা একটি মাটির পুতুল বাজানের বোচকায় ঢুকিয়ে দিয়ে বলে বাজান তোমার যখন আমার জন্য পরান পুড়বি তখন এই পুতুল ডারে সোহাগ দিও।

রজবের দু’চোখ পানিতে ছল ছল করে ওঠে। আর কিছুক্ষণ পরেই তার লঞ্চ ছাড়বে। সে ফুলিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আঙ্গুরির কোলে দিয়ে বোচকাটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলে, তয় গেলাম তোমরা ভালো কইরা থাইকো। আর বউ দাওয়াই শেষ হইলে ফুলিকে আবার মধু কবিরাজের কাছে লইয়া যাইও।

বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে এক ফালি বাঁকা চাঁদ উঁকি মারে। দূরে কোথাও বুনো পাখিরা আর্তনাদ করে ওঠে। রজব মৃধা দ্রুত পায়ে লঞ্চ ঘাটার দিকে এগিয়ে যায়।

এইবার নতুন পালা নামবে। ডায়লগ মুখস্থ করে রিহারসেল দিতে আর প্যান্ডেল তৈরিতে সপ্তাহ খানেক লেগে যায়। চারিদিকে জাঁকিয়ে শীত নেমেছে। মনে হয় এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে বেশি শীত পড়বে।

প্রশান্ত বাবুর মুখে শুনেছে এবারে চার সপ্তাহের সব টিকেট আগে ভাগেই বিক্রি হয়ে গেছে। তাই সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে মালিক বাড়তি কিছু টাকা সবাইকে ধরে দিবে। রজব মনে মনে ভাবে রাখে কি কি কিনবে ফুলি আর আঙ্গুরির জন্য। আঙ্গুরির বাবার জন্যও কিছু কিনে নিতে হবে।

প্রশান্ত বাবুর মোবাইল নম্বর আঙ্গুরিকে দেয়া আছে। আসবার সময় ফুলির ম্যালেরিয়ার মতো দেখে এসেছে। রজব রিহারসেলের সময় হাতে পায়ে গলায় আগের মতো জোর পায় না। বুকের ভেতরটা কেমন জানি জ্বালা পোড়া করে।

প্রথম সপ্তাহেই নুতন যাত্রা পালা সারা এলাকা জুড়ে হৈ চৈ ফেলে দেয়। যাত্রা প্যান্ডেলে তিল ধারণের জায়গা নাই। তার পাঠ জমিদারের নায়েবের। সারাটা পালা জুড়ে একছত্র পাঠ। জমিদারের মেয়ের উলাউঠা অসুখ যে ভালো করে দিতে পারবে তার জন্য অর্ধেক জমিদারির ঘোষণা দেয়া হয়।

রজব সময় পেলেই তার গাঁয়ের বাজারে মোবাইলে ফোন করে ফুলির খোঁজ খবর নেয়। ফুলির ম্যালেরিয়া জ্বরটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। মধু কবিরাজের সাধ্যমতো দাওয়াইতেও কাজ হচ্ছে না। আঙ্গুরিকে সে বলে রেখেছে দাওয়াইতে কাজ না হলে ফুলিকে পাশের থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে।

কয়েকদিন পরে দুপুরে ঘুমের ঘোরে রজব ভয়ের স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে। একটা পাগলা বুনো ঘোড়া নিচে ফেলে ক্ষুর দিয়ে তার বুকে প্রাণপণে লাথি মারছে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। সারাটা বিকাল তার খুব খারাপ লাগে। একবার মনে হয় সব কিছু ছেড়ে এখুনি গ্রামে মেয়ের কাছে ফিরে যেতে।

শেষ রাতে কোনও রকমে সে যাত্রার পাঠ শেষ করে গ্রিনরুমে ফিরে আসে। প্রশান্ত বাবু তাকে ডেকে আড়ালে নিয়ে আসলে তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। সে সংক্ষেপে ফুলিকে থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার খবরটা দেয়। রজবের সারা শরীর ভয়ে কেঁপে ওঠে। সে প্রশান্ত বাবুর কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে গ্রামের বাজারে ফোন করে। ওপাশ থেকে যা শুনতে পায় তা বাবা হিসাবে তার পক্ষে হজম করা অসম্ভব। তার হাত থেকে মোবাইলটা নিচে পড়ে যায়। সে পাগলের মতো তাবুতে ফিরে ঝোলা হাতিয়ে ফুলির দেয়া পুতুলটা খুঁজে বের করে মুখের কাছে জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকে।

তখন রাত প্রায় শেষ। পুতুল হাতে বাইরে বেরিয়ে এসে সে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে থাকে। বুকফাটা আর্তনাদ করে পুতুলের সাথে কথা বলতে থাকে। ফুলি ও ফুলি মা, কথা কও মা, এইযে আমি তোমার বাজান, এই যে ফুলি মা, ফুলি মা, কথা কও মা।

লেখক: সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর