দিন দিন বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এর সাথে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। দেশ এক অজানা গন্তব্যে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট কেউ বলতে পারছে না, কবে শেষ হবে করোনার প্রকোপ। জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে আমরা এখন দ্বিধা বিভক্ত। আমাদের অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গার্মেন্টস, দোকানপাট বিভিন্ন কারণে আমরা খুলে দিতে বাধ্য হয়েছি। এতে আমাদের সংক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দীর্ঘ দেড় মাসের সাধারণ ছুটিও আমাদের করোনার প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পারছে না।
আমাদের সবাই এখন ঘরবন্দী থাকলেও মানুষ তার নিত্যপ্রয়োজনে বিশেষ করে কাঁচাবাজারের কারণে হলেও ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশের একে একে ৬৪টি জেলা আজ করোনায় আক্রান্ত। অনেক উন্নত দেশ লকডাউন চালিয়ে সামর্থ্য হলেও আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ বেশিদিন সাধারণ ছুটি চালিয়ে যেতে পারবে না। আমাদেরকে অবশ্যই সাধারণ ছুটি শেষ করতে হবে।
জীবন জীবিকাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এজন্য প্রয়োজন আমাদের সকলের সমন্বিত উদ্যোগ। আমরা যদি করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ না হই তাহলে আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে বিশাল অন্ধকার। আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা ও চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং আগামীতে হবে। এর ফলশ্রুতিতে আমাদের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হবে। বিপুল পরিমাণ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ আমাদের সকলের। আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় আমরা প্রিয় দেশকে করোনা থাবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। আমরা যদি ১৫ দিন কঠোরভাবে নিউজিল্যান্ডের মত গৃহবন্দী থাকতে পারি তাহলেই আমরা করোনার প্রকোপ থেকে মুক্ত হতে পারব। আমরা সবাই আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব। এখন কথা আসতে পারে, দেড় মাসে আমরা যেটা পারলাম না সেটা কিভাবে আমরা ১৫ দিনে অর্জন করতে পারব? আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা এই দেড় মাসের লকডাউন মেনে চলি নি। কিভাবে লকডাউন কার্যকর হবে আমরা সেটা বুঝতেই সময় নিয়ে নিয়েছি বেশি।
আমাদের সাধারণ ছুটির মেয়াদ আমরা বাড়িয়েছি বিভিন্ন মেয়াদে। আমাদের সাধারণ ছুটির মধ্যে আমরা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গমন করেছি। যেমন অনেকে বিভিন্ন শহর (যেমন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম) থেকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে নিজ নিজ গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছে। আমরা দেখেছি, আমাদের গার্মেন্টস কর্মীরা পায়ে হেঁটে বিভিন্ন সময়ে ঢাকা শহর ছেড়েছে এবং এসেছে। আমরা আরো দেখেছি, ত্রাণের কার্যক্রম পরিচালনা করতে যেয়ে আমাদের সুস্থ ব্যক্তিরা কিভাবে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। শুধু তাই নয়, ডাক্তার, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন এই করোনার সংক্রমণে।
আমাদের সকলের অংশগ্রহণে অর্থবহ গৃহবন্দী অবস্থা পালন করলেই করোনার প্রকোপ থেকে মুক্তি সম্ভব। আমি শব্দ হিসেবে অন্যান্য বিদেশী শব্দ যেমন লকডাউন, কোয়ারেন্টাইনের মত কঠিন শব্দ ব্যবহারের বিপক্ষে। আমার মতে, আমাদের অবশ্যই সহজ ও বোধগম্য শব্দ ব্যবহার করতে হবে যাতে আমাদের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ আমাদের কথাগুলো বুঝতে পারে। আমি এজন্য গৃহবন্দী শব্দটি বেছে নিচ্ছি। আমরা যদি ১৫ দিন কার্যত গৃহবন্দী থাকতে পারি তাহলে আমাদের নতুন সংক্রমণের পরিমাণ কমে আসবে। নতুন সংক্রমণ না হলে আমাদের পক্ষে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
এই ১৫ দিনের গৃহবন্দীকালীন সময়ে সকল গণপরিবহন যেমন বাস, সিএনজি, রিকশা, ভ্যান, এমনকি মালামাল বহনকারী ট্রাকও বন্ধ থাকবে। শুধুমাত্র সরকার অনুমোদিত যানবাহন চলাচল করতে পারবে। দেশের সকল কাঁচা বাজার বন্ধ থাকবে। যার যা কাঁচা বাজার লাগবে তা অবশ্যই এই গৃহবন্দী সময়ের আগে সংরক্ষণ করতে হবে। এ সময়ে কোনভাবেই ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না। জরুরি সেবা ছাড়া সকল দোকানপাট, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আড়ত, ত্রাণ বিতরণ এমনকি নিয়মিত বাজার সব কিছুই বন্ধ থাকবে। যার যা কার্যক্রম করার দরকার তাকে অবশ্যই গৃহবন্দী সময়ের আগে করতে হবে এবং গৃহবন্দী কাল শেষ হলে করতে হবে।
এখন কথা আসতে পারে, এই সময় যদি মানুষ অসুস্থ হয় সে কিভাবে হসপিটালে যাবে। সরকার অবশ্যই এজন্য সংশ্লিট এলাকায় সরকার অনুমোদিত যানবাহনের ব্যবস্থা রাখবে। যদি কারো খুব জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয় সে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট থানার সাথে যোগাযোগ করবে এবং তারা প্রয়োজন বোধ করলে রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। আর এ সময়ে অবশ্যই সকল রোগী করোনা পজেটিভ সাসপেক্ট হিসেবে চিকিৎসা পাবেন। স্বাস্থ্যকর্মীরা অবশ্যই পর্যাপ্ত প্রটেকশান নিয়ে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেবেন। কারণ কোন চিকিৎসা কর্মী যদি এ সময়ে সংক্রমিত হন তাহলে আমাদের গৃহবন্দী থাকাটা বৃথা হয়ে যাবে।
আমরা চাচ্ছি, এই ১৫ দিনে যারা যারা সংক্রমিত তাদের বের করে আনতে। আমরা যদি এই ১৫ দিনে সংক্রমিতদের বের করে আনতে পারি তাহলে আমরা তাদেরকে প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন সেন্টার বা হাসপাতালে রেখে দিতে পারবো। আমি কখনোই সংক্রমিতদের বাসায় রাখার পক্ষপাতি না। কারণ এতে করে পরিবারের অন্যান্যদেরও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আমরা যদি এই সকল সংক্রমিত লোকদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রাখতে পারি তাহলে আমাদের সকলের জন্য গৃহবন্দীকালীন সময়ের পরের সময়টা আমাদের জন্য বাধাহীন হবে। আমরা কোন সংকোচ ছাড়াই তখন পরবর্তী সময়গুলো ভালোভাবে কাটাতে পারবো। আমাদের আর ভয়-শঙ্কা নিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে হবে না।
এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, এ রকম একটা ব্যবস্থাপনা করার মত আমাদের প্রশাসনের তো এত লোকবল নেই। হ্যাঁ, আমরা জানি আমাদের সীমাবব্ধতা। প্রয়োজন হলে আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, র্যাব, এবং পুলিশসহ সকলে এক সাথে কাজ করবো। সবাই মিলে যদি আমরা চেষ্টা করি তাহলে আমরা এই দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারবো।
এখন কথা আসতে পারে, যদি আমরা পর্যাপ্ত সহায়তা দিতে না পারি? আমরা যদি এ সময়ে অসুস্থ বোধ করি কিন্তু আমরা কোনভাবেই প্রশাসনের কারো কোন সহায়তা পেলাম না। এভাবে চললে তো এই ১৫ দিনে অনেক লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। হতে পারে, আমরা সকল মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারবো না। হয়ত এ সময়ে আমরা আমাদের প্রিয়জনকে হারাবো। আসলে দুর্যোগকালীন সময়ে আমাদের সকলকে ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ত্যাগের বিনিময়ে আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারবো।
এখন কথা আসতে পারে, এই ১৫ দিন কখন থেকে শুরু হবে? আমার মতে, এটা শুরু করতে হবে ২২ মে ২০২০ থেকে এবং যা প্রলম্বিত হবে ৬ জুন পর্যন্ত। সরকার ইতিমধ্যে ৩০ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। আমরা যদি এই ছুটিটা আরো ৬ দিন বাড়াতে পারি এবং সমন্বিতভাবে পালন করি তাহলে আমরা এই মহামারীর হাত থেকে রক্ষা পাব। এখন আরেকটা কথা আসতে পারে, এ সময়ে আমরা গৃহবন্দী সময় দিলে তো মাঝে ঈদ আছে, মসজিদের নামাজ আছে আরো বিভিন্ন সামাজিক কাজ-কারবার আছে সেগুলোর কি হবে? আমাদের সকলের এটা উপলব্ধি করা উচিত যে, এটা দুর্যোগকালীন ছুটি, এ সময়ে এইসব ধর্মীয় সামাজিক কাজকর্ম আমাদের বন্ধ রাখতে হবে। এই গৃহবন্দী থাকার কারণে আমরা আমাদের দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারবো।
আরেকটা কথা হয়ত আসতে পারে। অভাবী মানুষের ঘরে এই ১৫ দিনের খাবার না থাকতে পারে। আমরা সবাই জানি যে, আমাদের সকলের ঘরে কিছু না কিছু উদ্বৃত্ত খাবার থাকে। আমরা সবাই যদি অসহায় মানুষগুলোর পাশে বিভিন্ন দান (যেমন যাকাত, ফেতরাসহ অন্যান্য দানের) নিয়ে দাঁড়াতে পারি তাহলে আমরা অভাবী মানুষগুলোর খাবারের অভাব পূরণ করতে পারবো। আর সরকার চাইলে এই ১৫ দিনের জন্য ২০ কেজি চাল, ২ কেজি ডাল, ২ কেজি তেল আর ৪ কেজি আলুর প্যাকেটের ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে আমাদের কারোরই ঘরের বাইরে যেতে হবে না এবং আমরা করোনার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে পারবো।
সবশেষে আরেকটি কথা, যদি এই ১৫ দিনের বন্ধে কোনভাবেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে আমরা কি আরো ১৫ দিনের ছুটি দেবো? আমি বলব, না, এই ছুটি আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো যেতে পারে। যদি আমরা মোট ২২ দিনেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারি তাহলে আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে সকল কিছু খুলে দেবো। যার যার ব্যক্তিগত সুরক্ষা রেখে ও সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে আমরা চলব। এরপরও যদি আমরা মহামারীতে আক্রান্ত হই, তখন বলতে পারবো, আমরা আমাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করেছিলাম। এরপরেও নাহলে আমাদের কি করার আছে?
এই ১৫ থেকে ২২ দিনের ছুটির বিষয়টি সরকার সকল মহলকে সরাসরি গাইডলাইন দিয়ে জানিয়ে দেবে। সকল এলাকায় মাইকিং করে এই ছুটির বিষয়টি সর্বসাধারণকে জানানো হবে। বাংলাদেশের সকল ধর্মীয় উপসানালয় যেমন মসজিদ, মন্দির থেকে মাইকের মাধ্যমে এই ছুটির বিষয়টি সকলকে জানানো হবে। আমরা বিশ্বাস করি সকলের প্রচেষ্টায় আমরা করোনা যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবো।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
বিডি প্রতিদিন/আল আমীন
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        