বাংলার প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা বিরাজ করছে। সুমঙ্গলা হেমন্তের পরিসমাপ্তিতে শীতের আগমন। হেমন্তের যৌবন খুবই অল্প সময়ের। হেমন্ত তার রূপমাধুরীতে রাঙিয়ে দেয় প্রকৃতির প্রতিটি প্রহর। হেমন্তের পরেই শীতের আকাশের আগমন। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এদেশে ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং সেগুলি পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। ঋতুগুলির তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহ একটি থেকে অপরটিতে পৃথক। শীত বাংলা সনের পঞ্চম ঋতু। শীতকাল পৌষ ও মাঘ এই দুই মাসের সমন্বয়ে গঠিত। শীতকাল প্রধানত শুষ্ক। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শীতকাল হলেও বাস্তবে নভেম্বর থেকেই হালকা শীত অনুভূত হয়। শীতের আসল চেহারা ফুটে উঠে হেমন্তের পরে। এ সময় স্নিগ্ধতায় বিমোহিত থাকে মন। প্রকৃতির বুকে আলোড়ন তোলে, শুভ্রতার উৎকৃষ্ট নিঃশ্বাসে জেগে উঠে প্রণয়ের রেখা, বিমোহিত থাকে মন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে বলেছিলেন তার কবিতায়,
এই শরৎ-আলোর কমল-বনে
বাহির হয়ে বিহার করে,
যে ছিল মোর মনে মনে।
তারি সোনার কাঁকন বাজে,
আজি প্রভাত কিরণমাঝে, হাওয়ায় কাঁপে আঁচলখানি,
ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে।
স্বচ্ছ নদীর ধারা
বহি চলে কলসংগীতে।
কম্পিত ডালে ডালে
মর্মর-তালে তালে
শিরীষের পাতা ঝরে শীতে।
ও পারে চরের মাঠে
কৃষাণেরা ধান কাটে,
কাস্তে চালায় নতশিরে।
নদীতে উজান-মুখে
মাস্তুল পড়ে ঝুঁকে,
গুণ-টানা তরী চলে ধীরে।
হেমন্তের মতো শীতের প্রতিটি প্রহরেও যে শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত মুগ্ধতার পদধ্বনি। শেষ বিকালে পশ্চিম আকাশ রাঙিয়ে দেয়া সাত রঙের রংধনু। শীতকালে সন্ধ্যার প্রফুল্লতা মানুষের ভেতর জগৎ, প্রকৃতিকে করে তোলে লাস্যময়ী। দেশের দক্ষিণাংশের তুলনায় উত্তরাংশে শীতের তীব্রতা বেশি হয়ে থাকে। এ ঋতুতে গাছের পাতা ঝরতে থাকে। আমলকী, জলপাই, মাদার প্রভৃতি কোনো কোনো বৃক্ষ পত্রশূন্য হয়ে যায়। এ সময় শিশির পড়ে। কপি, মুলা, বেগুন, পালংশাক, মটরশুটি ইত্যাদিতে হাট-বাজার পূর্ণ থাকে।
পিঠাবিহীন শীতকাল যেন কল্পনাই করা যায় না। তাই শীতকালকে পিঠার মৌসুমও বলা হয়ে থাকে। শীত আসবে আর পিঠা খাওয়া হবে না, এ চিন্তা করা অমূলকই বটে। এ যেন আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নকশি কাঁকন পিঠা, হৃদয় হরণ পিঠা, নারকেল গুড়ের মেরা পিঠা, কাশ্মীরি ভাপা পিঠা ইত্যাদি বাহারি স্বাদে ও নামে অনন্য বহুমাত্রিক পিঠা। এছাড়াও বহুল প্রচলিত রয়েছে নকশি পিঠা, ঝুড়ি পিঠা, তেজপাতা পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, পাকান পিঠা, পাকড়া পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, ডিমের ঝাল পিঠা, দুধ চিতই পিঠা, দুধ পুলি পিঠা, চকলেট পিঠা, বিস্কিট পিঠা, পুলি পিঠা (ভাঁপা) ও মালাই পিঠা ইত্যাদি।
হেমন্তে যেমন তার সৌন্দর্য ও শুভ্রতায় অনন্য।তার সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে দেয়, শুভ্রতায় মন জুড়িয়ে দেয়। সুশোভিত করে তোলে দেহ-মন সারাক্ষণ। প্রকৃতির রূপলাবণ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। সৌন্দর্যবোধ, চেতনা থাকলেই হেমন্তের প্রকৃতির সৌন্দর্য চোখে পড়ে। তেমনি শীতের শিশিরভেজা ঘাসে স্নিগ্ধতার এক অপরূপ রঙতুলির আঁচড়ে সযত্নে আঁকা সুনিপুণ এক চিত্রকর্ম হয়ে উঠে প্রকৃতি। মানুষের নাগরিক চোখকে স্বস্তি দেয়, দেয় সতেজতা, প্রাণচাঞ্চল্য। ঋতুরাজ বসন্তের যেমন রয়েছে রঙের বা বর্ণের ঐশ্বর্য আর রূপের রাজকীয় অহংকার; শীতেরও রয়েছে তেমন সৌম্য, নির্মল সৌন্দর্য আর শান্ত ভাবমূর্তি। শীতকালীন ফুলগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গাঁদা, ডালিয়া, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, সূর্যমুখী, কসমস, পপি, গাজানিয়া, স্যালভিয়া, ডায়ান্থাস, ক্যালেন্ডুলা, পিটুনিয়া, ডেইজি, ভারবেনা, হেলিক্রিসাম, অ্যান্টিরিনাম, ন্যাস্টারশিয়াম, লুপিন, কারনেশন, প্যানজি এবং অ্যাস্টার ইত্যাদি। যদিও নগরজীবনে হরহামেশা এসব ফুল দেখা যায় না। একঘেয়ে জীবনে পরিপাটি করে এসব ফুলের উপস্থিতি সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেবে বই কমবে না, মনটাও হবে সতেজ। এর সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত।
শরত কিংবা হেমন্ত প্রকৃতি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে যেমন প্রভাব বিস্তার করে, তেমনি বাংলার সাহিত্যে শীতেরও এর উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষণীয়। প্রাচীন কবি, লেখক-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে আধুনিক লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় শীত বন্দনা দেখা যায়। শীত এলে কিছু মৌসুমি ফলও চলে আসে বাজারে, দেখা মেলে বরই, জলপাই, আমলকি, সফেদা, কমলালেবু, আপেল আর ডালিমের।
সাহিত্য-সংস্কৃতি তো আছেই। দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস প্রতি বছরই নিয়ে আসে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বৈচিত্র্যময় পোশাক। শীতের প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত। শীতের সকালে ইচ্ছে হলেই ঘুরতে যাওয়া যেতেই পারে, কেননা শীতকালে বছরের শেষে ও নতুন বছরের শুরুতে হয়ে থাকে, ফলে ছুটির কিছুটা আমেজ বজায় থাকে। এর ফলে নাগরিক জীবনে কর্মব্যস্ততা থেকে একটু হলেও স্বস্তি দেবে।
নাঈমুল রাজ্জাক: লেখক ও গবেষক