সোমবার, ৩০ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

সংসারে টানাটানি

ইকবাল খন্দকার

আমার এক বড়ভাই বললেন, জীবনটা একদম শীতকাল হয়ে গেল রে। আর ভালো লাগে না। কবে যে এই শীতকাল শেষ হবে! আমি অবাক হয়ে বললাম, এসব আপনি কী বলছেন? জীবন শীতকাল হয়ে গেল মানে? গরমের যন্ত্রণায় বাঁচা যাচ্ছে না। আচ্ছা, অতিরিক্ত গরমে আপনার মাথাটাথা বিগড়ে গেল না তো? বড়ভাই বললেন, মাথা তো অবশ্যই বিগড়িয়েছে। তবে সেটা গরমে না। বরং ওই যে বললাম জীবনটা শীতকাল হয়ে গেছে; এই টেনশনে। আমি এবার তাকে শক্ত করে ধরলাম। বললাম জরুরি ভিত্তিতে যেন ব্যাখ্যা দেন জীবন কেন শীতকাল হলো, কীভাবে শীতকাল হলো। এবার বড়ভাই বললেন, এত আয়োজন করে ব্যাখ্যা দেওয়ার কিছু নেই।

ব্যাপার খুবই সহজ। শীতকালে কী হয়? হয়তো অনেক কিছুই হয়, তবে আমার জীবনে একটা কাজই হয়েছে। সেটা হচ্ছে টানাটানি। কম্বল নিয়ে টানাটানি। ছোটবেলায় কম্বল নিয়ে টানাটানি করেছি ভাই-বোনদের সঙ্গে, আর বড়বেলায় এসে টানাটানি করি বউয়ের সঙ্গে। বউ টানে কম্বলের একমাথা ধরে, আমি টানি আরেক মাথা ধরে। এ নিয়ে রাত-বিরাতে বিশাল ক্যাচাল হয়। তো এই যে টানাটানি, আগে এই টানাটানি শুধু শীতকালে ছিল। তাও কম্বলকেন্দ্রিক। আর এখন এটা বারোমাসি এবং সবকিছু কেন্দ্রিক। মানে পুরো সংসারেই টানাটানি লেগে আছে। এইটা কিনতে গেলে ওইটা কেনার টাকা থাকে না, উফ, কী যে একটা অবস্থা! অবস্থা তো না, দুরবস্থা। আমি বললাম, চিন্তা করবেন না। শিগগিরই আপনার জীবনের শীতকাল কেটে যাবে। বড়ভাই বললেন, শুধু আমার জীবনের শীতকাল? কেন, তোর সংসারে কোনো টানাটানি নেই? আমি বললাম, না, নেই। আমার টানাটানির দরকার পড়ে না। বুদ্ধি করে আরও অনেক আগেই কম্বল কেটে দুই টুকরো বানিয়ে নিয়েছি তো! আমার আরেক বড়ভাই বললেন, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে যেভাবে টানাটানি করে সংসার চালাতে হচ্ছে, তাতে ছাত্রজীবনের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, কেন, ছাত্রজীবনে পাশের জনের কাছ থেকে নকল টানাটানি করে পরীক্ষা দিতেন নাকি? বড়ভাই হালকা হেসে বললেন, ব্যাপারটা ঠিক এমন না। আবার খানিকটা এমনও। তবে সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। বরং পরীক্ষা-পরবর্তী রেজাল্ট প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। আমি পাস করেছিলাম কোনোরকমে। তেত্রিশ পেয়ে পেয়ে। দু-এক সাবজেক্টে তো একত্রিশ, বত্রিশও পেয়েছিলাম। যারা খাতা দেখেছিল, তারা দয়া করে এক-দুই নম্বর দিয়ে দিয়েছে। তো আমার এই টানাটানির পাশ নিয়ে এলাকার লোকজন নানান কথা বলত। এর মধ্যে একটা কথা বেশ মার্কেট পেয়েছিল। সেটা হচ্ছে, টিটিএমপি। মানে টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাস। আমি বললাম, ফাইন। কিন্তু এখন সেটা কেন মনে পড়ল? বড়ভাই বললেন, মনে পড়ল এ জন্য যে, কারণ এখন আমি টিটিএসসি। আমি জানতে চাইলাম, টিটিএসসি কী জিনিস। টিএসসির নতুন কোনো শাখা নাকি। বড়ভাই বললেন, আরে না। টিটিএসসি মানে হচ্ছে, টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছি।

আমার এক ছোটভাই বলল, কী যে একটা বিপদে পড়েছি। আসলে আমার বড়ভাই যে এভাবে আমার ওপর প্রতিশোধ নেবে, বুঝতে পারিনি। আমি জানতে চাইলাম কীভাবে তার ওপর তার বড়ভাই প্রতিশোধ নিচ্ছে। ছোটভাই বলল, আর বলবেন না। বড়ভাই প্রেম করত। তো সে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফ্যামিলি থেকে সবাই বলছিল, এখনই বিয়ে করা যাবে না। কারণ, তোমার ছোট ভাই-বোন আছে। আগে তারা লেখাপড়া শেষ করুক। বিশেষ করে ছোটবোনদের আগে বিয়ে দাও, তারপর নিজের বিয়ে। আর তাদের কথার সঙ্গে আমিও তখন তাল মিলিয়েছিলাম। বড়ভাই এখন তাই আমার ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমাকে বিয়ে করতে দিচ্ছে না। গড়িমসি করছে। আমি বললাম, তোকে বিয়ে করতে না দেওয়ার কী আছে? তুই তো সবার ছোট। অতএব বাড়তি কোনো দায়িত্ব নেই। আচ্ছা, এই যে তুই বললি তোকে বিয়ে করতে দিচ্ছে না, গড়িমসি করছে; কী বলে গড়িমসি করছে? মানে তার যুক্তিটা কী? ছোটভাই বলল, তার কথা হচ্ছে, এখন বিয়ে করা যাবে না। জিনিসপত্রের যা দাম। কিছুদিন পরে বিয়ে কর। জিনিসপত্রের দাম একটু কমুক। আমি বললাম, তাহলে চিরকুমার থাকার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে নে। কারণ, জিনিসপত্রের দামও কোনোদিন কমবে না, তোর বিয়েও করা হবে না।

আমার এক প্রতিবেশী বললেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে সংসারে টানাটানি লাগার কারণে আর কারও কোনো সুবিধা হোক বা না হোক, তেলাপোকা আর ইঁদুুরের কপাল খুলে গেছে। আমি জানতে চাইলাম, কীভাবে? প্রতিবেশী বললেন, কীভাবে আবার? আগে একবারেই কয়েকটা আপেল কেটে ফেললাম। কয়েকটা পিঁয়াজ কেটে ফেললাম, আলু কেটে ফেলতাম। আর এখন কিপ্টেমি করি। অর্ধেকটা কেটে খাই বা রান্না করি, বাকি অর্ধেকটা পরেরবারের জন্য রেখে দিই। ব্যস, এই সুযোগে এই কাটা জিনিসটা ইঁদুর আর তেলাপোকারা ‘ইয়াম’ ‘ইয়াম’ করে খায়। বলতে পারেন বাসায় ‘খাদ্য উৎসব’ চলছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর