একটি গাছ ছিল সেই গ্রামে। গ্রামের নাম ভাটপাড়া। সেই গ্রামে একটি বিশাল প্রাচীন বৃক্ষ তার নরম সবুজ ভেলভেটের মতো পাতায় ভরা শাখাগুলো নিয়ে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছিল। দিনাজপুর সদর থেকে মাত্র মাইল খানেক দূরে ভাটপাড়া গ্রামের এক ধানি জমিতে জন্মেছিল গাছটি। শহরের কর্তাব্যক্তি কিংবা বনরক্ষকদের কারও চোখে পড়েনি উন্মূল হওয়ার আগপর্যন্ত। এই গাছের শরীর পেঁচানো থাকত মন্ত্রঃপূত সুতোয়। তেলসিন্দুরে ধূপধুনোয় ওই গাছটি থাকত পূতপবিত্র। গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে উঠত ধূপের সুবাসে। ভাদ্র-আশ্বিনের পূর্ণিমার তিথিতে এই গাছের ডাল নিয়ে উৎসব করে এ দেশেরই একটি জনগোষ্ঠী। গাছটির মতোই তারাও প্রায় বিলুপ্তির পথে। ভাটপাড়া গ্রামের এক মুসলমান কৃষকের খেতে প্রকাণ্ড হয়ে বেড়ে উঠেছিল যে গাছটি, একদিন সে লুটিয়ে পড়ে কুঠারের নির্মম আঘাতে। একটি গাছের মৃত্যু এ দেশে তেমন কিছু নয়। অনেকেই দেখে কিন্তু কেউ ভাবে না। তবে ভাটপাড়া গ্রামের সেই গাছটির ঢলে পড়া, মাটিতে নুয়ে পড়া দেখেছিল বহুসংখ্যক অসহায় মানুষ। তাদের করবার কিছু ছিল না। গাছটি তাদের আপন হলে কী হবে, ওই জমি তো তাদের নয়। তবে ওই গাছটির সঙ্গে রয়েছে তাদের আদিকালের আত্দার সম্পর্ক। গাছটি বাংলাদেশের ওরাওঁদের কাছে কারাম বৃক্ষ নামে পরিচিত। ভাটপাড়া এবং আশপাশে এটিই ছিল একমাত্র কারাম গাছ যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওরাওঁ জাতিসত্তার ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক। ওরাওঁরা বৃক্ষটিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। গাছকে জীবনের অন্যতম অবলম্বন মনে করে ওরাওঁরা। প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠেছে বলেই জীবনের প্রতীক বৃক্ষকে বন্দনা করে তারা। বন কেটে উজাড় করে বনখেকোরা আর কত না আপন জেনে ওরাওঁরা করে বৃক্ষবন্দনা। পরিবেশবান্ধব বলেই দীর্ঘকাল ধরে ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর কাছে সমাদৃত হয়ে আসছে বৃক্ষপূজা। ভাটপাড়ার যে শস্যখেতে গাছটি জন্মেছিল, তার মালিক নিজের প্রয়োজনে গাছটি কেটে ফেলেছিল। কিন্তু সে ভাবতেও পারেনি একটি কাটা বৃক্ষের সঙ্গে কিভাবে একটি জাতিসত্তার নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। ওরাওঁদের সর্বপ্রাণবাদী আত্দার ক্রন্দনধ্বনি বুকের গহীনেই জমা থাকল। কেউ জানল না। স্থানীয় প্রশাসন চাইলে গাছের মালিককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে কারাম গাছটির অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারত। গাছটি নেই বলে প্রত্যেক বছর পূর্ণিমার জোসনা রাতে বাড়ির কাছে যে গাছটির অর্চনা তারা করত, এখন তা পারে না। যেতে হয় অনেক দূরের আরেকটি কারাম গাছের কাছে। দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের পাশেই রয়েছে আরেকটি বিশাল কারাম গাছ। গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি সরেজমিন দেখেছি, কারাম নামের এই পবিত্র বৃক্ষটি যে দিনাজপুর সরকারি কলেজের ভিতরেই আছে তা অনেকেই জানেন না। শহরের কর্তাব্যক্তিরা খোঁজও রাখেননি, এই কারাম গাছের শাখা নিয়ে ওরাওঁরা তাদের সবচেয়ে বড় কারাম উৎসব পালন করে। কারাম গাছ এবং কারাম পূজা নিয়ে একটি কিংবদন্তি আদিকাল থেকে চলে আসছে ওরাওঁ সমাজে। এই কারাম গাছ ওরাওঁদের রক্ষাকর্তা এবং পালনকর্তা। কারাম উৎসবের সকল পর্যায়ে নৃত্য, গীত ও আখ্যানে ওরাওঁরা তাদের এই প্রত্নবিশ্বাসকেই তুলে ধরে অসীম আকুতিতে। কারাম গাছটি তাদের কাছে একটি বৃক্ষ নয়, একটি জাতির অস্তিত্বের অংশরূপে গণ্য। ভাদ্র মাসের একাদশী শুক্লাপক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ওরাওঁদের এই কারাম উৎসব। ওরাওঁদের কারামচান্দের ভরাপূর্ণিমায় এই উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতার সূত্রপাত। ওরাওঁরা গোত্র ও সমাজ ভেদে দশকারাম ও নিজকারামের পূজা করে। দশকারামের গল্পটি হলো, অতীতে ধরম ও করম নামে দুই ভাই ছিল। ধরম থাকত ধর্মচর্চা নিয়ে আর করম থাকত কাজ-কর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। একদিন কর্মক্লান্ত ভাই করম বাড়িতে ফিরে দেখে ধরম একটি গাছের ডাল সামনে রেখে নৃত্যগীত উৎসবে মেতে আছে। ক্রুদ্ধ করম তার অলস ভাই ধরমের কাছ থেকে গাছটির ডাল এবং পূজার উপকরণগুলো নিয়ে ফেলে দেয়। ভাইয়ের এই কাজে ধরমের খুব কষ্ট হয়। কিন্তু কিছু বলে না। দেখতে দেখতে তাদের ধনসম্পদ শেষ হয়ে যায়। তারা অভাবে পড়ে। করম বুঝতে পারে ধরমের পূজায় বাধা দেওয়ার পর এই বিপত্তির শুরু হয়। দুই ভাই মিলে সেই ফেলে দেওয়া গাছটি খুঁজতে শুরু করে। নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক কষ্টের পর তারা দেখে নদীতে গাছের ডাল ভেসে যাচ্ছে। ধরম করম দুই ভাই নদী সাঁতরে সেই গাছের ডাল তুলে ঘরে নিয়ে আসে। তারপর তিনদিন উপোস থেকে বাড়ির উঠোনে সেই ডাল পুঁতে পূজা চালু করে। তারা বুঝতে পারে, কর্মহীন ধর্ম যেমন কাজে আসে না তেমনি ধর্মহীন কর্মও কোনো সুখ আনে না। এই গল্পের আরেকটি রূপ পাওয়া যায়। ওরাওঁদের আদি মানব-মানবী ভাইয়া ও বহিন এক বিশাল প্রান্তরে তাদের গরু চরাতে গিয়েছিল। হঠাৎ মহাপ্রলয় শুরু হয়ে যায়। সেই বিজন প্রান্তরে কোথায় তারা আশ্রয় পাবে? তখন দুই ভাই-বোনকে সেই প্রান্তরের একটি বিশাল বৃক্ষ আশ্রয় দেয়। এরপর ভাইয়া বহিন সেই গাছের ডাল নিয়ে এসে নিজের গোত্রে পূজার চালু করে। সেই থেকে অদ্যাবধি ওরাওঁরা গভীর বংশ ও যুগ পরম্পরায় তা পালন করে আসছে।
দিনাজপুরের ভাটপাড়া গ্রামে সুরেশ তিগ্যা একজন শ্রমজীবী ওরাওঁ, শহরে তিনি রিকশা চালান। তার মতো আরও বহু শ্রমজীবী ওরাওঁ সম্প্রদায় বসবাস করেন এই ভাটপাড়া গ্রামে। আশ্বিনের পূর্ণিমায় সুরেশের পাড়ায় আয়োজন করা হয় কারাম পূজার। পূজার রাতে আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছিল। ওরাওঁ গ্রামের বিস্তীর্ণ সবুজ ধানের প্রান্তরে জোছনার লুটোপুটি। বাড়ির উঠোনে কারাম বৃক্ষের ডাল পুঁতে তার চারপাশ ঘিরে সে রাতে নেচেছিল ওরাওঁ নরনারী। ধূপধুনোর পাশাপাশি পচানির ঝিম ধরা গন্ধে চারপাশটা যেন মাতাল হয়ে উঠেছিল। এই উৎসবে প্রায় সব ওরাওঁ নরনারী নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করেন। উঠোনের মধ্যখানে কারাম শাখা পুঁতে তার চারপাশে তারা নাচে-গায়। আমরা বসেছিলাম সুরেশের বাড়ির বাঁশঝাড়ের নিচে নিকোনো মাটির উপর মোড়া পেতে। মাঝে-মধ্যে চমৎকার করে কথা বলা ওরাওঁ নারী শিবানী এসে খোঁজ নিয়ে যান আমাদের কিছু লাগবে কিনা। আমাদের মাথার ওপর আশ্বিনের চাঁদ কী ভীষণ সুন্দর হয়ে উঠেছে। নৃত্যের আসরে তখন প্রায় শ'খানেক ওরাওঁ নরনারী। রাত ছুঁয়েছে মধ্যরাতের শরীর। গীতোয়ার (মূল গায়েন) নেচে নেচে গান গাইছিল, মান্দারিয়ার (বাদক) ঢোলের তালে। ঢোলের তাল ও গানের সুরে সুরে নাচছিল ওরাওঁ নরনারী। বয়সের কোনো বাধা নেই। সবাই নাচে গান গায় কারাম বৃক্ষের সামনে। এই নাচের মধ্যে ফুটে ওঠে একটি জাতির জীবনের বোধ-বিশ্বাস সুরে, ছন্দে ও নৃত্যের তালে তালে। উঠোনে পোঁতা কারামের ডাল তখন আর বৃক্ষশাখা থাকে না। যেন জীবিত, জীবন্ত এবং প্রাণময় সত্তার প্রতীক হয়ে ওঠে। কারাম গাছের কেটে আনা তিনটি ডালকে সুতোয় জড়িয়ে উঠোনে নানারূপ পূজার উপকরণ দিয়ে যখন পূজা করা হয়, তখন গাছেরও যে প্রাণ আছে এই ধারণাটা মানুষের কাছে বড় বেশি নিবিড় হয়ে ওঠে। গাছটি যেন বলতে চায়, 'মানুষেরা, তোমরা দেখ, আমারও জীবন আছে।' এই বোধটি প্রত্যক্ষ করেছি যখন ওরাওঁরা দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে কারামের ডাল সংগ্রহ করতে গিয়েছিল দিনাজপুর সরকারি কলেজের খালপাড়ে। সেই পথযাত্রায় আমিও ছিলাম। আমিও অংশীদার হয়েছিলাম যেন, সেই অতীতকালের ছোট নাগপুর থেকে ওরাওঁদের অবিরাম স্থান বদলের মিছিলে। দিনাজপুর সরকারি কলেজের সেই কারাম বৃক্ষটির কাছে গিয়ে ধূপধুনো এবং অনেক প্রার্থনার পর পুরোহিত গাছটির কাছে শাখা কাটার অনুমতি চাওয়ার পর প্রশান্ত তিগ্যার নামের কিশোর উপসিয়া ডাল সংগ্রহের জন্য গাছে উঠে। আমার কাছে তখন কেবলই মনে হতে থাকে, ভাটপাড়া গ্রামের ওরাওঁ পাড়ার শস্যক্ষেতে যে গাছটি জন্মেছিল, আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল একটি জাতিসত্তার যত্নে ও মমতায়, তার কর্তনের সঙ্গে আমারও যেন একটা সম্পর্ক রয়েছে। কারণ ওই গাছটিকে আমি কিংবা আমরা বাঁচাতে পারিনি। জানি না এই কলেজের কারাম গাছটিও বৃক্ষলোভী নিষ্ঠুর হন্তারকের হাত থেকে রক্ষা পাবে কিনা।
বাংলাদেশে ওরাওঁ নৃগোষ্ঠীর জনসংখ্যা খুব বেশি নেই। বর্তমানে এদের অধিকাংশই রাজশাহী বিভাগে বসবাস করে। তবে ঢাকা ও সিলেট অঞ্চলেও এদের অস্তিত্ব রয়েছে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে বসবাসরত ওরাওঁ জাতিসত্তার লোকসংখ্যা ৮৫ হাজার ৪১ জন। এ দেশের এই ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর রয়েছে সহস্র বছরের ইতিহাস। বলা যেতে পারে, ভারত উপমহাদেশে আর্য সভ্যতা বিকাশের আগেও তাদের অস্তিত্ব ছিল। তাদের শারীরিক গঠন দেখে নৃতাত্তি্বকরা এদের দ্রাবিড়ীয় বলেছেন। ভাষাবৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তাদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে 'কুরুখ' ভাষা। দ্রাবিড় ভাষায় 'কুরুখ' শব্দের অর্থ মানুষ। কুরুখের পাশাপাশি তারা 'সাদরী' ভাষায়ও কথা বলে। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, কুরুখ ভাষার একটি মিশ্ররূপ এই সাদরী ভাষা। আর্যদের অনার্য দ্রাবিড় বিতাড়নের কাল থেকে অবিরাম বদলে চলেছে ওরাওঁদের সংস্কৃতি ও ভাষা। খ্রিস্টপূর্বাব্দকালে ওরাওঁরা ভারতের কর্নাটক থেকে স্থানান্তরিত হতে হতে ভারতের ছোট নাগপুর, রাঁচি, রাজমহল এলাকায় স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুলেছিল। ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন, খ্রিস্টপূর্ব অব্দে আর্যদের আক্রমণে পরাজিত হয়ে তারা তাদের ভূখণ্ড ছেড়ে অনিশ্চয়তার পথে পাড়ি জমিয়েছিল। বহুকালের পথপরিক্রমায়ও তারা স্থায়ী ভূখণ্ড নিজেদের করে পায়নি। পার হয়ে গেছে অনেক বছর। সময়ের ধুলো জমেছে ওরাওঁদের ইতিহাসের চারপাশে। তারপর মোগল এবং অবশেষে ব্রিটিশ শক্তির তাঁবেদার জমিদার ভূস্বামীদের অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্য ওরাওঁরা আবার স্থানান্তরিত হতে হতে এদেরই একটি অংশ বাংলাদেশে এসে বসতি স্থাপন করে। তারপর থেকে আজো তাদের কষ্টের অভিযাত্রা শেষ হয়নি। তবু তারা টিকে আছে। তবুও তারা আনন্দে, উৎসবে, নৃত্য, গীতে মেতে ওঠে কারাম উৎসবে পূর্বপুরুষের গৌরবময় স্মৃতিচারণায়। তাদের উৎসবের আখ্যান ও গানে উঠে আসে পূর্ব বাসভূমি নাগপুর রাজমহলের কথা।
ঐতিহ্যগতভাবে ওরাওঁরা উৎসবমুখর ও বিনয়ী জাতিসত্তা। কৃষি তাদের প্রধান অবলম্বন। কৃষিজীবী ওরাওঁরা ষড়ঋতুর বিচিত্র রূপকে আবাহন করে নৃত্য ও গানে। জনজীবনের সুখ চেয়ে তারা ধার্মেসের (ঈশ্বর) কাছে প্রার্থনা করে। ধর্মীয় বিশ্বাসে ওরাওঁরা একেশ্বরবাদী। তবে তাদের মধ্যে সর্বপ্রাণবাদী ধর্মবিশ্বাসেরও প্রচলন রয়েছে। অন্য মানুষের মতো ওরাওঁরা নানাবিধ বিশ্বাস, সংস্কার ও কুসংস্কারের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে। নানা বিপত্তির মধ্যেও তারা ধরে রাখে তাদের সংস্কৃতি। তাদের গোত্রচেতনা, মানবিক মৌল প্রবণতা, পারস্পরিক নির্ভরশীলতার মধ্য দিয়ে সুপ্রাচীন কাল থেকে যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা এখনো ওরাওঁ সমাজে টিকে আছে। জানি না নিষ্ঠুর সময় এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আগ্রাসী হাত আর কতদিন এই সংস্কৃতিকে টিকে থাকতে দেবে! ভাটপাড়ায় সেই মধ্যরাতে বসে বসে আমার এটিও মনে হয়েছে যে, কৃষি না বাঁচলে ওরাওঁদের সংস্কৃতি কিংবা উৎসব কোনোটাই বাঁচবে না। কারণ ওরাওঁদের মধ্যে যত উৎসব, পার্বণ রয়েছে তার সবই কৃষিকেন্দ্রিক। তাদেরও রয়েছে বার মাসে তের উৎসব-পার্বণ।
ওরাওঁদের অন্যতম প্রধান উৎসব কারাম। এ ছাড়া বসন্তকালে তারা আয়োজন করে ফাগুয়া উৎসবের। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে মাটি চৌচির হতে থাকলে ওরাওঁরা ফসলের প্রার্থনায় বেদনার্ত গান গায় নৃত্যের তালে তালে। ফাগুয়ার পাশাপাশি তাদের রয়েছে নববর্ষের 'সারহুল' উৎসব। তাদের আছে 'সোহরাই' উৎসব। তাদের এসব উৎসবের সঙ্গে প্রতিবেশী সাঁওতাল কিংবা মালপাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর মিল আছে। এরা সবাই, এই নিরন্ন অভাবী জনগোষ্ঠী সামাজিক কিংবা ধর্মীয় যে কোনো উৎসবে নৃত্যগীতে তাদের জনজীবনে সুখ আবাহন করে। কারাম উৎসবে, কারাম বৃক্ষের ডাল ঘিরে তারা নেচে নেচে দেবতার কাছে বাস্তব জীবনের সেই সুখই তো চায়; ব্যক্তির সুখ, জনজীবনের সুখ, জাতিসত্তার সুখ। তারা মনে করে, ধ্বংসের উন্মত্ততায় মেতে ওঠা পৃথিবী ও মানব জাতিকে রক্ষা করবে কারাম গাছ। কারাম উৎসবের প্রতিটি পর্বের নৃত্য-গীত ও আখ্যানে এই ভাবনা কাজ করে ওরাওঁদের মধ্যে। আমি দেখেছি কারাম গাছের ডাল কাটা থেকে শুরু করে পর দিন সকালে দূরের পুকুরে সেই ডাল বিসর্জন দিতে গিয়েও ওরাওঁরা নৃত্য ও সংগীতে মাতোয়ারা থাকে। কারাম উৎসবের প্রতিটি অংশেই নৃত্যগীত ও ধর্মীয় আচরণের সমন্বিত প্রকাশ ঘটেছে। এই ধর্মীয় আচরণকে আমরা 'কৃত্য' বলতে পারি। মাদল, নাকারা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের সুগম্ভীর নিনাদ গ্রাম থেকে গ্রামান্তে ছড়িয়ে দেয় কারামের আগমনী সুর। মূল কারামের দিন বিকেল বেলা উপবাসী ছেলেরা নাচগান করতে করতে কারাম গাছের কাছে যায়। তারা নতুন সুতা, সিন্দুর, ধূপ প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে যায়। পুরোহিত মন্ত্র পাঠ করে কারাম গাছটিকে সাত পাকে বেঁধে ফেলে। তারা বলে এর মাধ্যমে দেবতাকে কাপড় পড়ানো হলো। গাছের ডাল কেটে বাড়িতে ফিরে আসলে বাড়ির তরুণীরা তাদের ওপর পবিত্র পানি ছিটিয়ে দেয় এবং হাতের ডাল তিনটি গ্রহণ করে। মেয়েরা নাচতে নাচতে যে স্থানে ডালটি পোঁতা হবে সে জায়গায় চলে আসে। ডাল পোঁতা পর্যন্ত নাচগান চলতেই থাকে। সারা রাত চলে নৃত্যগীত ও হাড়িয়া পান। কারামের পরের দিনকে ওরাওঁরা বলে ভাসান। এই ভাসানের সঙ্গে বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত ভেলা ভাসান কিংবা হিন্দুদের দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভাসানের দিন ভোরবেলা কারাম গাছের ডাল তিনটি তুলে ওরাওঁরা নৃত্যগীত সহকারে বাড়ি বাড়ি পরিভ্রমণ করে। তারপর সবাই মিলে কাছের কোনো নদী কিংবা পুকুরে কারাম ডাল বিসর্জন দিতে যায়। আশ্বিনের ভোরে আমিও ওরাওঁদের এই বিসর্জনে সঙ্গী হই। অাঁকাবাঁকা পথে ওরাওঁ নরনারী ঢোলের বাদনে ছুটে চলে বিসর্জন ঘাটের দিকে। আমিও চলি। আমার কাছে এই ভাবনাটি খুব প্রবল হয়ে ওঠে যে, আমাদের পাশে একান্তই আমাদের আপনজন হিসেবে যে জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তাদের কত কিছুই আমরা জানি না। বাঙালির আগ্রাসী প্রভাব এই নিরন্ন অথচ সংস্কৃতিবান ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবন-জীবিকা এবং সংস্কৃতিকে বিপণ্ন করে তুলছে। কিন্তু এদের বিকাশের জন্য, টিকে থাকার জন্য কোনো প্রকার চেষ্টা আমরা করছি না। কারাম বৃক্ষের বিসর্জনের মতোই ক্রমাগত ওরাওঁরাও ভেসে চলেছে ঠিকানাবিহীন কোনো অজানায়।
ভাটপাড়ায় ওরাওঁ জনগোষ্ঠী একদিন নৃত্য, গীত ও আখ্যান পরিবেশনার আনন্দে মুখরিত ছিল। অভাবে, দারিদ্র্যে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভবিষ্যতে হয়তো থাকবে না। এই ভাবনা ওরাওঁদের মতো আমাকেও প্রবলভাবে তাড়িত করে। কারাম উৎসবে ওরাওঁরা তবু গান গায়, নাচে, হাড়িয়া পান করে। প্রতি বছরই তারা এভাবে গান গেয়ে গেয়ে, নেচে নেচে কারাম গাছের বন্দনা করে। যে গাছটি তাদের জীবনে এত নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে, তার মসৃণ গোল বড় পাতাটিতে কি লেখা আছে ওরাওঁদের ভাগ্যলেখা? কেউ কি তা পড়তে পেরেছে? আমি জানি না। সেই আশ্বিনের চাঁদ ওঠা মধ্যরাতে ওরাওঁ নারী-পুরুষের নাচ দেখেছি। দেখেছি আর ভেবেছি, ভাবতে ভাবতে দেখেছি, অসহায় অনেক ওরাওঁ দাঁড়িয়ে আছে ভাটপাড়া গ্রামে আর তাদের সামনে আকাশ উঁচু মাথার কারাম বৃক্ষটি ঢলে পড়ছে মাটিতে আমাদেরই নিষ্ঠুর কুঠারের আঘাতে। একটি গাছ শেকড় বিচ্ছিন্ন মাটিতে লুটায় অনেক মানুষ অক্ষম ক্রোধে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। একটি জনগোষ্ঠীর বিশ্বাসকে, সংস্কৃতিকে এভাবে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। ওরাওঁদের শেষ কারাম গাছটিও কি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? আমার মনেও গুনগুন করে কারাম উৎসবে সমবেত ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর নৃত্যগীতের সুর, 'এত্তে দিনা রাহালে কারাম জাঙ্গাল ঝুড়ে রাহালে/আইঝেতো আলে কারাম কাইলেতো যাবে কারাম/সাত সমদ্দুর লঙ্কা পার যাবে।'
আমরা কি পারি না ওরাওঁ নৃগোষ্ঠী এবং তাদের কারাম বৃক্ষটিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি জোগাতে?