শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ০০:০০ টা
গল্প

লুনাটিক

জয়া ফারহানা

লুনাটিক

অলংকরণ : আহমেদ তারেক

খুন করার পর মাথা থেকে একটি দুর্বহ ভার নেমে যায়। পেশাদার খুনিদের কী হয়, জানি না। কিন্তু যে খুনের কারণ তীব্র অভিমান, সেই খুনের পর ও রকমই একটা ফিলিংস আসে। অন্তত কয়েকশ' বার নানা ইঙ্গিতে আমি আমার বন্ধু-স্বজন, পরিচিতজনদের বোঝাতে চেয়েছি, আমি একটা খুন করতে যাচ্ছি। সবাই ভেবেছে আমার বোধহয় ডিসেন্সি জ্ঞানের খুব অভাব। নয়তো অন্তত ফুর্তির জায়গায় এসে লোকে ওরকম কথা বলে না। আমি বলেছিলাম, তার কারণ আমি চেয়েছিলাম অন্তত কেউ একজন আমার এই অবসেশন থেকে আমাকে বাঁচাক। জানি আপনারা ভাবছেন ব্যাটা তো লায়েক শেয়ানা। বুঝতে পারছি সমস্যা, অথচ কেন ট্রিটমেন্টে গেলাম না? বিশ্বাস করুন গিয়েছিলাম, ওষুধও নিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর আমার অবসাদটা আরও বেড়ে গেল।

মাংসে ঝাল কম হয়েছে কিংবা স্যুপে লবণ হয়নি কেন এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে রেস্টুরেন্টে আমি এমন সব কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটাতে থাকলাম, বন্ধুরা পর্যন্ত (যাদের জন্য আমি জীবন পর্যন্ত বাজি রাখতে পারতাম) তারাও আমাকে ধীরে ধীরে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। এরই মধ্য তিরিশে এসে কেইবা বন্ধুর জন্য খরচা করবে, সময় কিংবা পয়সা। সবাই এখন ঘোর সংসারি, ঘোর কর্মজীবী। আর আমি ৩৩ বছরের এক অভিমানী রাজপুত্র ভাবতাম কবিতা লিখতে পারি বলে সবাই উপযাজক হয়ে আমার কাছে আসবে। কিন্তু বাস্তবে তেমন হলো না। দেখা গেল, আমার পোশাকই সবচেয়ে মলিন, কারও বিয়েতে আমিই উপহার ছাড়া যাই (জনান্তিকে বলি তোর জন্য কিছু নতুন শব্দ নিয়ে এসেছি, আমি কবি, শব্দ ছাড়া আমি আর কী উপহার দিতে পারি?) এসব সবাই উটকো রসিকতা ভাবতে শুরু করল। ভদকার চার পেগ পেটে পড়তেই মাহবুব একদিন বলেই ফেলল, তুই ভুল করেই নিজেকে আলাদা কিছু ভাবছিস, কবিতার প্রতিভা তোর মধ্যে নেই। একদিন ৪০ পেরিয়ে গেলে দেখবি তুই ভুলপথে হেঁটেছিস তখন আর কিছু করতে পারবি না। ফুট্টুস। আমি কিন্তু তোর লেখার মধ্যে প্রতিভা-টতিভা কিছু পাইনি। সত্যি বলছি।

অজয় ওকে থামিয়ে বলল, যার যেমন ইচ্ছে তাকে সেভাবে বাঁচতে দে না। এক দল কবিতা লিখবে, একদল লিখবে না, একদল মদ খাবে, একদল খাবে না, কেউ ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে, কেউ করবে না- এতে এত বাহাসের কী হলো! এই যে কামরান সিনেমা বানাচ্ছে, অনি গান করছে, পাপড়ি রিসার্চ করছে... কারও কোনো দোষ হলো না, কেবল ও লেখালেখি করে, সেটিই তোদের কাছে পৃথিবীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে? আমি অন্যদিকে মুখটা ফিরিয়ে চোখ মুছলাম। আমার পয়সা আর প্রতিভা নেই বলে আমার বন্ধুরা এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে! তারপরও আমি ওদের মতো চনমনে জীবন চেয়েছিলাম। অজিত দা সেই যে নামি পত্রিকার জাঁদরেল সাহিত্য সম্পাদক আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেলল, 'লেখা ছাপা হলে তো পত্রিকাতেই দেখতে পাবেন, রোজ অফিসে আসার দরকার কী?' আমি তবু বুঝতে দেইনি আমি অপমানিত হয়েছি। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আস্তে ধীরে উঠে এসেছি, পাছে চা না খাওয়াটাকে অহংকার ভেবে বসে, তাই তুমুল অনীহা নিয়েও আমি চা পান করেছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল চা নয়, গলা দিয়ে বিষ ঢোকাচ্ছি, আমি বিষ পান করছি, যদিও সেদিন আমার পেটে তীব্র খিদে, তবু একটুও খাওয়ার ইচ্ছে হয়নি আমার। লেখার জন্য এরকম আরও কত তীব্র অপমানের মধ্য দিয়ে যে গেছি আমি। তবু আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। সবাইকে বলেছি, আমার গন্তব্যহীন, উদ্দেশ্যহীন জীবনের কথা, অন্তত একজন যদি কেউ আমাকে বাঁচতে সাহায্য করে। আমি বড় বড় সাহিত্যিকদের পায়ের কাছে কুকুরের মতো বসে থাকতাম। একদিন জনৈক বিখ্যাত সাহিত্যিক বললেন, পয়সার লোভটা বড় সাংঘাতিক বুঝলে, সবাই ওই লোভ সামলাতে পারে না। এখনকার ইয়াং ব্লাড টাকার লোভে হেলাফেলা করে লিখছে। বিশ্বাস করুন, আমার তুমুল অভাব সত্ত্বেও আমি পয়সার লোভ করিনি। তীব্র ধ্যানজ্ঞানে সাহিত্যের সাধনা করতে চেয়েছি, কিন্তু খবরের কাগজের সাহিত্য সম্পাদকরা এত নিষ্ঠুর, তারা কেবল বিখ্যাত লেখকদেরই লেখা ছাপাতে চান অথবা ক্ষমতাবান কারও ছাপার অযোগ্য লেখাও ছেপে দেন, তাদের যত রাগ, যত হম্বি-তম্বি সব ভুখা-নাঙ্গা তরুণ সাহিত্যিকদের জন্য। দুচারটে টাকা পাওয়ার আশায় লিখলেও আমি কোনো দিন তা প্রকাশ করিনি, পাছে তারা আমার লেখাটা বাদ দিয়ে দেন কিংবা আমাকে পয়সার লোভী ভেবে বসেন, অথচ আমার চেয়ে টাকার প্রয়োজন আর কার ছিল? শুধু পয়সা নেই বলে জয়ীতা আমাকে ছেড়ে গেল। অথচ জয়ীতার জন্য আমি হফম্যানের গল্পের নায়কের মতো আমার ছায়া পর্যন্ত বিক্রি করতে রাজি ছিলাম। বুকের মধ্যে ভালোবাসার তীব্র আগুন নিয়ে কামনা বাসনাকে নিভিয়ে রেখেছিলাম। পাছে জয়ীতা আমাকে শরীর খেকো ভাবে অথচ আপনারা জানেন, ভালোবাসলে, ভালোবাসার মানুষটিকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য কী অদম্য আবেগ কাজ করে। তবু আমি সংযত থেকেছি। আর আমার এই সাত্তি্বক সংযমের মূল্য জয়ীতা কীভাবে শোধ করেছে সে গল্প আপনাদের বলছি। তারপর আপনারাই সিদ্ধান্ত নেবেন আমার খুন করতে চাওয়াটা। অপরাধ ছিল কিনা।

জয়ীতাকে আমি যেভাবে ভালোবেসেছি পৃথিবীর আর কোনো পুরুষ আর কোনো নারীকে সেভাবে ভালোবাসেনি। জানি আপনারা বলবেন, ওরকম ছেলেমানুষি ভাবনা সবাই ভাবে। তার সম্পূর্ণ সত্তার প্রতি অতি আকুল আকুতি থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো আমি ছুঁয়েও দেখিনি। ভেবেছি আমি তার যোগ্য হয়ে উঠলেই কেবল...

এক দুপুরে আমি জয়ীতার ফ্ল্যাটে গেছি... বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। ওরা এতটাই মগ্ন-মত্ত ছিল যে, বাইরের দরজাটা পাকাপাকি বন্ধ করার কথা কারও মাথায়ও আসেনি। লোভী একটা শরীর জয়ীতার নাভিতে জিভ ছুঁয়ে দিল। সেই প্রথম আমি তার মসৃণ নাভি দেখলাম। ইনফ্যাক্ট সেই প্রথম আমি কোনো নারীরও নাভি দেখলাম। আমি দূর থেকে দেখলাম জয়ীতা তপ্ত হচ্ছে। তপ্ত শরীর বোধহয় দূর থেকেও চেনা যায়। সেই অন্ধকার মূর্তি জয়ীতার উরুতে, পায়ের নিচে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। আর জয়ীতা মাখনের মতো গলে যেতে যেতে বলছে যাহ কী অসভ্যতা করছেন...। একটি দশাসই শরীর বিছানায়... জয়ীতাকে শুইয়ে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল ওর ঠোঁট। টেনে ছিঁড়ে ফেলল ওর ব্লাউজ, ব্রা। কেঁপে কেঁপে ওঠা জয়ীতার উদ্ধত স্তনে তৃষ্ণার্ত সেই মানুষটি অবিরাম পান করে গেল আর আমি জয়ীতার শরীরকে বিশ্বাস করুন, আমি জয়ীতার শরীরকে উপাসনা ঘরের মতো পবিত্র জেনে কেবল বুভুক্ষের মতো অপেক্ষা করে গেছি... সেই আমি দেখলাম কী আহ্লাদে, কী আনন্দে, কী মত্ততায় সম্ভোগে লিপ্ত জয়ীতা... লোকটির দুই হাঁটু চেপে ধরেছে জয়ীতার মাখনের মতো পা। আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। বিবর্ণ-বিমর্ষ আমাকে মনে হলো বোবা। রাস্তায় মাহবুব দাঁড়িয়ে ছিল ব্যর্থতার আঘাত কী সাংঘাতিক। মাহাবুব যখনই বলল আমাকে কী রে মুখটা অমন পোড়া বেগুনের মতো করে রেখেছিস কেন? পকেটে পয়সা নেই? আমি তবু বোবা হয়ে থাকলাম অথচ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, হ্যাঁ আমি পোড়া বেগুন। আমি বেঁটে, আমি কালো, আমি রোগা, আমার পয়সা নেই আর জয়ীতা যাকে শরীর দিয়েছে সেই ছেলেটা নায়কের মতো দেখতে, অর্থবান, বলিষ্ঠ... তো আমি কী করব ঈশ্বর কেন আমাকে এত নিঃস্ব করে পৃথিবীতে পাঠালেন? পিস্তল কিংবা ছুরি বসিয়ে দিতে মনে হচ্ছিল জয়ীতার বুকে। তার বদলে আমি উৎকট রকমভাবে চুপ হয়ে গেলাম। মাহবুব বলল, ভাগ শালা সামান্য মেয়ে মানুষের জন্য যে এই হাল করে, সে আমার বন্ধুই না। শোন সুনীল বাবু কী বলেছে...। আমি এলোমেলো পা ফেলে মাহবুবের সঙ্গে হাঁটতে থাকলাম কিন্তু বুকের ভেতরটা হু হু করছে... মনে হলো মুহূর্তের মধ্যে আমার সমস্ত পৃথিবী ফাঁকা হয়ে গেল। অথচ পৃথিবী যেমন ছিল ঠিক তেমনিই আছে... মাঝখান থেকে আমার জীবনটাই কেবল সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আর কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই। প্রকৃতি, পৃথিবী সব কিছুর বিরুদ্ধে আমার তখন তীব্রস্বরে নালিশ জানাতে ইচ্ছে করল... মাহবুব বলল তোকে একটু আগে সুনীলের কথা বলছিলাম না... শোন সুনীলের থিওরি। সন্ধ্যের দিকে যদি বিষম মন খারাপ লাগে, যদি মনে হয় হেরে গেছি, পৃথিবীতে আমি একা... তাহলে বুঝবি দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। খেলেই চাঙ্গা লাগবে। নিজেকে মনে হবে বিশ্ববিজয়ী। নিজেকে যখন ব্যর্থপ্রেমিক মনে হবে, তখন বুঝবি জুতোর পেরেক উঠেছে, হাঁটার সময় পায়ে ফুটছে কিন্তু টের পাচ্ছিস না। জীবনে কিছুই করা হলো না এ ধরনের উটকো মন খারাপ হলে বুঝবি নিশ্চিত হজমের গণ্ডগোল হয়েছে। সেই মাহবুব, আমার পাঠশালা বেলার বন্ধু মাহবুবও একদিন জয়ীতার সঙ্গে...। জয়ীতা কি এতই শরীরসর্বস্ব ছিল? মেয়েরা কি শরীরের ওপর ডাকাতের মতো হামলেপড়া পুরুষ পছন্দ করে? শরীরের ব্যাপারে মনোযোগ না দেখালে কি তাদের শরীর অপমানিত হয় ভাবে? সব মেয়েমানুষের মধ্যেই কি একজন কুসুম লুকিয়ে আছে? 'শরীর শরীর... তোমার মন নাই কুসুম?' আমি কখনো ডেসপ্যারেট হতে পারেনি, সেই দোষেই আমাকে ছেড়ে গেল জয়ীতা! নাকি নর্থ আমেরিকার পেট্রো ডলারের কাছে হেরে গেলাম আমি। জয়ীতার চোখে-মুখে তখন ফরেন অফিসের ভাইস কনসালের স্ত্রীর ঝুঁকিহীন নিরুপদ্রব জীবনের স্বপ্ন।

একজন অকিঞ্চিৎকর টিউশন মাস্টার, একজন আদ্যোপান্ত ব্যর্থ সাহিত্যিকের সাধ্য কী জয়ীতাকে ঝুঁকিহীন নিরুপদ্রব জীবনের স্বপ্ন থেকে ফিরিয়ে আনে? আমার পোশাকের শ্রী ছাদ দিন দিন মলিন থেকে মলিনতর হতে থাকল। পরিচিত সবাই তখন আমাকে নিছক করুণার চোখে দেখে। কারও সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলেও মুখ ফিরিয়ে নেয় সম্ভবত চিনতে পারে না। আমার চেহারা কি এতটাই বদলে গেছে! নাকি আমি তখন মুক্ত কচ্ছপের চারুদত্ত জুয়ায় হেরে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার মধ্যেই যার সুখ! কিন্তু আপনারাই বলেন, শুধু নিজের জন্য কেউ কি বাঁচতে পারে! নিজেকে ভালোবাসা তো তুলোর বীজের মতো... নিমেষেই ফুট্টুস... কিংবা ছেলেবেলায় হারিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো... কিংবা হাওয়াবাজি... জলের রংয়ের মতো। যাকে বলে বিমূর্ত! সবাই আমার কাছ থেকে একে একে সরে গেল... বন্ধুতা, জয়ীতা, কবিতা... সব... সব। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচি বলুন তো! নিছক ছাপোষা কেরানিও তো সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার আগে আলু-বেগুন অথবা কুমড়ো কেনে হয়তো বাচ্চাদের জন্য চকোলেট কিংবা খেলনা কেনে... কারণ তারা তাদের গন্তব্য জানে... অন্তত পথটা তো জানে।

এসবের কিছুই আমার জানা নেই। পৃথিবীতে কোথাও কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই... কেউ আমাকে তার জীবনের জন্য হার্মফুলও ভাবছে না! কী রকম একটা হার্মফুল অবস্থা! কেউ যদি আমার নামে থানায় একটা ডায়েরিও করে রাখত তবুও নিজেকে খানিকটা অস্তিত্বমান ভাবতাম। আমার কি উচিত না অন্তত একটা খুন করে নিজের অস্তিত্বকে জানান দেওয়া। কী অদ্ভুত! ৩৩ বছরের এক যুবকের জীবন সম্পূর্ণ অর্থহীন! এ কথাটা আমি যার সঙ্গেই একটু অন্তরঙ্গভাবে বলার সুযোগ পাই তাকেই বোঝাবার চেষ্টা করি। ওদের বলি আমার মাথায় দুর্বহ ভার। ভীষণ ব্যথা, একটা খুন না করা পর্যন্ত এ ব্যথা কমবে না। ওরা আমাকে প্যারাসিটামল খাবার পরামর্শ দেয়। আমি বলি, কবিরা ভুল প্রেসক্রিপশন নেয় না। ওরা বলে তুমি কবি নও লেখকও না। লুনাটিক।

 

সর্বশেষ খবর