শুক্রবার, ২ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ স্মরণে

ড. নুরুন নবী

মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ স্মরণে

১৯৭১, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন নিরীহ বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করে, বাঙালিরা যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেছিল। সেই মোতাবেক আমরা টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করি। আমাদের বাহিনীতে ছিল ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী। এ ছাড়াও ছিল পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সৈনিক, নাবিক, বৈমানিক, পুলিশ এবং ইপিআর সদস্যরা।

কবি রফিক আজাদ ছিলেন একজন পেশাজীবী। তিনি যুদ্ধের আগে টাঙ্গাইলের কাগমারী কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি তখন বাংলাদেশের উদীয়মান এবং এক নতুন ধারার কবি। কলম এবং ক্লাসরুম ছেড়ে দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে তিনি হয়েছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা।

রফিক আজাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন টাঙ্গাইলে। মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল ভারতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র-গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে টাঙ্গাইলে নিয়ে আসা। প্রথমবার প্রচুর অস্ত্র, গোলা-বারুদ নিয়ে আসার পর আমি মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরে আসি। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরটি ছিল সখীপুর পাহাড়ের এক দুর্গম জঙ্গলে। সদর দফতরে পৌঁছামাত্র আনওয়ারুল আলম শহীদ ভাই আমাকে দুহাতে শূন্যে তুলে আনন্দে নাচতে লাগলেন। ভারত থেকে অস্ত্র আনার মিশন আশাতীতভাবে সফল হওয়ায় এ আনন্দ। শহীদ ভাইয়ের হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা আনন্দে নাচতে লাগলেন। তিনি ছিলেন কবি রফিক আজাদ। তিনি সবার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, অস্ত্র ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা অকেজো, নবী ভারত থেকে অস্ত্র এনেছে, আমরা এবার শত্রুর সঙ্গে সার্থকভাবে যুদ্ধ করে জয় লাভ করতে পারব। তিনি এবং শহীদ ভাই বললেন, নবীর এই অসাধ্য কাজ সাহসের সঙ্গে সাধন করার ফলে জয় আমাদের নিশ্চিত। সদর দফতরে আরও পরিচয় হয় কবি মাহবুব সাদিক, ফারুক আহমেদ, সৈয়দ নুরু প্রমুখ।

স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে তিনি এবং কবি মাহবুব সাদিক কোমরে বেল্ট এবং মাথায় টুপিসহ সামরিক পোশাকে কবিতা আবৃত্তি করেন। মুক্তিযোদ্ধা পোশাকে দুই কবির ছবি পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো হয়। কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধা  শিরোনামের ছবিটি সেই সময় জনগণের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

কবি রফিক আজাদ দ্বিতীয়বার জাতীয়ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তাঁর সেই বিখ্যাত ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাব’ কবিতার জন্য। এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের প্রগতিশীল মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু সরকার মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সরকারের একটি বিশেষ মহল অতীব ক্ষুব্ধ হয়ে কবিকে গ্রেফতার প্রক্রিয়া শুরু করে। পুলিশ এবং গোয়েন্দারা তাঁকে খুঁজতে থাকে। কবি পরিবারের সদস্যরা চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু কবি রফিক আজাদ মোটেই চিন্তিত ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধের সেই অকুতোভয় সংকল্প নিয়ে কবি নিশ্চিন্ত থাকলেন। আনওয়ারুল আলম শহীদ সেই সময় রক্ষীবাহিনীর ডেপুটি ডিরেক্টর। সহযোদ্ধা রফিক আজাদকে বাঁচাতে হবে। শহীদ ভাই এবং আমি এক রাতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর বাসায় উপস্থিত হলাম। তিনি সবে ডিনার শেষ করেছেন। আমরা দুজনে বঙ্গবন্ধুর স্নেহের পাত্র। চাকরির সূত্রে শহীদ ভাই আরও কাছের মানুষ। দেখমাত্র তিনি আমাদের কাছে ডাকলেন।

 

রফিক আজাদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন টাঙ্গাইলে। মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল ভারতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর জন্য অস্ত্র-গোলা-বারুদ সংগ্রহ করে টাঙ্গাইলে নিয়ে আসা। প্রথমবার প্রচুর অস্ত্র, গোলা-বারুদ নিয়ে আসার পর আমি মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরে আসি। টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরটি ছিল সখীপুর পাহাড়ের এক দুর্গম জঙ্গলে। সদর দফতরে পৌঁছামাত্র আনওয়ারুল আলম শহীদ ভাই আমাকে দুই হাতে শূন্যে তুলে আনন্দে নাচতে লাগলেন। ভারত থেকে অস্ত্র আনার মিশন আশাতীতভাবে সফল হওয়ায় এ আনন্দ। শহীদ ভাইয়ের হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা  আনন্দে নাচতে লাগলেন।

 

ইতিপূর্বে রফিক আজাদের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর কানভারী করা হয়েছিল। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বললাম, কবি রফিক আজাদ আমাদের সহযোদ্ধা। আমরা একসঙ্গে নয় মাস পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। তিনি একজন উঁচুমানের কবি। তিনি সরকারবিরোধী লোক নয়। তিনি জনগণের কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছেন তাঁর কবিতায়। বঙ্গবন্ধু বললেন, তোরা যা বললি, সেসব উল্লেখ করে আমাকে একটি চিঠি দিতে বলবি। ওর কিছু হবে না। এভাবে কবি সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলেন।

কবি রফিক আজাদের সঙ্গে শেষ দেখা হয় ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর কানাডার টরেন্টো শহরে, আমার লেখা ‘আমেরিকায় জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে। টরেন্টো নিবাসী কবি দেলওয়ার এলাহি ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের আয়োজক। তিনি জানালেন কবি রফিক আজাদ এবং কবি আসাদ চৌধুরী আমার গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন। আমি আনন্দে আত্মহারা। সম্মানিত বোধ করলাম। অনেকদিন পর ফোনে কবি রফিক আজাদের সঙ্গে কথা বললাম। দেখা হয়েছিল ২০০৪ হিউস্টনে বাংলাদেশ সম্মেলনে। সেই সম্মলনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুও এসেছিলেন। আমরা তিনজন খুব মজার আড্ডা দিয়েছিলাম।। প্রায় একযুগ পর আবার দেখা হবে টরেন্টোতে, সেই মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকলাম।

১৮ অক্টোবর কবি দেলওয়ার এলাহির বাসায় কবি রফিক আজাদ, কবি আসাদ চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী ড. দিলারা হাফিজ, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে সাইফ ইমাম জামি, মুক্তিযোদ্ধা লেখক তাজুল মোহাম্মাদ প্রমুখ আমন্ত্রিত। আমি এবং আমার স্ত্রী ড. জিনাত নবী আগেই সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কবি রফিক আজাদ কক্ষে প্রবেশ করেই আমার সঙ্গে মুখোমুখি হন। আমরা উষ্ণ আলিঙ্গনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। ছাড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না। অন্যরা আমাকে স্মরণ করে দিলেন, আমাদের একটু সুযোগ দেন কবির সঙ্গে একটু কোলাকুলি করি। এভাবে সে দিন অনেক দিনের বিচ্ছেদের সমাপ্তি হয়েছিল। আমরা দুজনে পুরনো দিনের অনেক কথাই স্মরণ করলাম। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করলাম। আমরা দুজন বিশ্বের দুই প্রান্তে বসবাসের অভিজ্ঞতা বিনিময় করলাম।

সে দিন বিকেলে আমার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কবি রফিক আজাদ সভাপতিত্ব করলেন। কবি আসাদ চৌধুরী, ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন, সাইফ ইমাম, তাজুল মোহাম্মাদ, সালমা বানী প্রমুখ আলোচনায় অংশগ্রহণ করলেন। দেলওয়ার এলাহি পরিচালনা করলেন। কবি রফিক আজাদ সভাপতির ভাষণে বললেন, স্বাস্থ্যগত কারণে প্রায় এক বছর কোনো অনুষ্ঠানে যাননি, লিখতে-পড়তে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু একাত্তরের সহযোদ্ধা ড. নুরুন নবীর অনুষ্ঠানে না এসে পারলাম না। তিনি আরও বললেন, এ ছাড়াও বইটি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ওপর লেখা। তিনি বইটির প্রশংসা করলেন এবং আমাকে ধন্যবাদ জানালেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ওপর সময়োপযোগী বইটি লেখার জন্য। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। অনুষ্ঠান শেষে সে দিন রাতে লেখক সালমা বানীর গৃহে ডিনার এবং আড্ডার আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে অনেক আড্ডা হলো। কিন্তু একটা বিষয় খুব কাছে থেকে লক্ষ্য করলাম, কবি রফিক আজাদের স্বাস্থ্য ভীষণ খারাপ। হার্ট, লাংক, ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগে তিনি আক্রান্ত। তাঁর দুই ছেলে এবং দিলারা ভাবি কবি রফিক আজাদের খুব যত্ন করছিলেন। কী খাওয়া উচিত, কী উচিত নয়, তা নিবিড়ভাবে তদারকি করছিলেন।

কবি রফিক আজাদের স্বাস্থ্য নিয়ে শঙ্কিত হলাম। মনে দুশ্চিন্তা নিয়ে বিদায় নিলাম। সেই বিদায় যে মাত্র কয়েক মাস পরে শেষ বিদায় হবে সেটা সেদিন কল্পনাও করতে পারিনি।

রফিক আজাদের কাব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য অথবা পর্যালোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি যে কত উঁচু মাপের মানুষ ছিলেন, তা আমি জানি।

কবি রফিক আজাদ তাঁর মাতৃভূমিকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন প্রকৃতিকে। আরও ভালোবাসতেন মানব সম্প্রদায়কে। দেশের গাছপালা, নদ-নদী, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, লালন, হাসন রাজা ও রবীন্দ্রনাথের গানে তিনি আন্দোলিত হতেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের গুরুত্ব দিতেন, মূল্যায়ন করতেন। তাঁর জীবনের সব কিছু পাওয়ার জন্য তিনি সবার কাছে নিজেকে ঋণী মনে করতেন। তাঁর এই জীবন দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর একটি কবিতায় ‘ঋণ খেলাপির মনস্তাপ’।

কবি রফিক আজাদ এই পৃথিবী ও তাঁর জন্মভূমির সবার কাছে, সব কিছুর কাছে নিজকে ঋণী মনে করতেন। কিন্তু কবি রফিক আজাদ জানতেন না, তিনি বাংলা ভাষা সাহিত্য তথা আমাদের কী দিয়ে গেছেন। আমরা তাঁর কাছে ঋণখেলাপি।

মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে একান্ত প্রার্থনা-মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদের বিদেহী আত্মা শান্তিতে রাখুন।

সর্বশেষ খবর