দুপুরের পর শিউলি গিয়েছিল স্নান করতে। সোনাতলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম ইছামতি। গ্রীষ্মে অতিশীর্ণ চেহারা নদীর। গলাজল ভেঙে এপার ওপার করা যায়। বর্ষায়ও নদী মনে হয় না। মনে হয় মাঝারি ধরনের খাল।
এখন বৈশাখ মাসের শেষদিক। গরম পড়েছে বেজায়। শিউলি থাকে ভাইয়ের সংসারে। ভাই গৌতম সাহা রামকৃষ্ণপুর বাজারে পাইকারি মালের দোকান চালায়। মা বাপ গত হয়েছেন অনেক দিন। সংসারে দুটি মাত্র ভাইবোনই ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর গৌতম দোকান চালাতে শুরু করে। তার কিছুদিন আগে বিয়ে করেছে। সংসারে তৃতীয় একজন এসেছে। তার নাম প্রতিমা। নাম প্রতিমা হলে কী হবে, মানুষটা বেশ রাগী আর দজ্জাল। সংসারে এসেই ননদিনীটিকে জ্বালাতে শুরু করল। শিউলি তখন ক্লাস ফাইভের ছাত্রী। ওইটুকু মেয়েকে দিয়েই সংসারের সব কাজ করাতে লাগল। ভাইটা মেনীমুখো। বউকে যমের মতো ভয় পায়। তার কথায় ওঠে বসে। ছোট বোনটির দুর্দশা তাকিয়েও দেখে না। বোন কোনো অভিযোগ করলে কানে তোলে না। উলটো তাকেই বকাঝকা করে। সংসারের কাজ এই ভাবে করতে হয় বলে ক্লাস সিক্সে ওঠার পর আর স্কুলে যাওয়া হলো না শিউলির। বলতে গেলে ভাইয়ের সংসারে সে ঝি হয়ে গেল। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি। রাতের বেলার সব কাজ শেষ করে শুতে শুতে হয় অনেক রাত। এত কিছুর পরও সহজে শিউলির ঘুম আসে না। নিজের অবস্থার কথা ভেবে চোখের জলে বালিশ ভেজে। বহুবার ইচ্ছে হয়েছে সংসার ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু কোথায় যাবে? এমন কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই যাদের কাছে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারে!
কী আর করা! এই কষ্টের জীবনটা মেনে নিয়েই দিন কাটছিল শিউলির। এক সময় ফর্সা সুন্দর চেহারার মিষ্টি মেয়ে ছিল। লম্বাও বেশ। এখন সেই শিউলি আর নেই। দেখতে বাড়ির কাজের ঝিয়েদের মতোই লাগে।
পাঁচ বছর আগে দাদার ছেলে অর্জুন জন্মেছে। সে প্রাইমারি স্কুলে যাচ্ছে। প্রতিমা ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। অন্য কোনো দিকে তাকিয়ে দেখে না। তবে অর্জুনটা পিসিকে পছন্দ করে। তাকে ডাকে, ‘পিসিমণি।’ সময় সুযোগ পেয়েই পিসিমণির কাছে আসে। গল্প শুনতে চায়। তাতে অবশ্য প্রতিমা কিছু মনে করে না। ছেলেকে কিছুই বলে না। ছেলে যা চাইবে তাই হবে।
পাতালপুরির গল্প বলতে শিউলির খুব ভালো লাগে। অর্জুনও শুনতে পছন্দ করে। এজন্য ওরকম গল্পই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অর্জুনকে সে শোনায়। পিসিমণির মুখোমুখি শুয়ে, বা কোলে বসে মুগ্ধ হয়ে সেসব গল্প অর্জুন শোনে।
সংসারের কাজ সেরে স্নানে যেতে শিউলির দুপুর পার হয়ে যায়। পাড়ার বউঝিরা অনেক আগেই স্নান সেরে যে যার বাড়িতে ফেরে। গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে ফেলে। কেউ কেউ ভাতঘুমে ডুবে যায়। শিউলি স্নান করে একা একা। তবে আজ তার সঙ্গে মৃধাবাড়ির ছোটবউ আরতি আর হরিপদ স্যারের মেয়ে সন্ধ্যা ছিল। গলাজলে নেমে স্নান করছে তিনজন। রোজই তাই করে। ছোটবেলা থেকেই করে আসছে। তবে আজ এক অদ্ভুত কাণ্ড হলো। ওইটুকু জলেই ডুবে গেল শিউলি। গেল তো গেলই! কোনো হদিস নেই।
আরতি আর সন্ধ্যা ভেবেছিল শিউলি বুঝি ডুব দিয়ে অন্য কোনো দিকে চলে গেছে। ওদের সঙ্গে মজা করছে। এমন তো অনেকেই করে। শিউলিও আগে করেছে। ওরা দুজন নদীর এদিক ওদিক খুঁজল শিউলিকে। গলাজলে হেঁটে হেঁটে খুঁজল। সাঁতরে সাঁতরে খুঁজল। ডুব দিয়ে দিয়ে খুঁজল। না, নেই। কোথাও নেই শিউলি। তার পরই ওরা চিৎকার করতে করতে পাড়ে উঠল। ‘শিউলি ডুবে গেছে, শিউলি ডুবে গেছে।’ তাদের চিৎকারে পাড়ার লোকজন জড়ো হলো। জাল ফেলে, ডুব দিয়ে দিয়ে পনেরো বিশজন লোক সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজল শিউলিকে। খবর পেয়ে দোকান ফেলে গৌতম এসেছে। সে নেমে গেছে নদীতে। পাগলের মতো বোনকে খুঁজছে। না, মেয়েটিকে পাওয়াই গেল না। গলাজলের ইছামতিতে এভাবে কেউ ডুবে মরতে পারে? তার ওপর যে মেয়ে খুব ভালো সাঁতার জানে! এ কেমন করে হয়? এ তো এক অদ্ভুত কাণ্ড!
গৌতম তার বোনের জন্য খুব কান্নাকাটি করল। বেঁচে থাকতে বোনের দিকে ফিরেও তাকায়নি। ডুবে মরার পর যেন তার জন্য স্নেহ মমতা উথলে উঠল। প্রতিমার অত্যাচারে বোনটি যে তার শেষ হয়ে গিয়েছিল, চাইলে সে বোনটিকে ভালো রাখতে পারতো, তা করেনি। এখন বোন নেই বলে তার নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে।
পিসিমণির জন্য কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলল অর্জুন। ‘পিসিমণি মরে গেছে, এখন আমাকে গল্প শোনাবে কে? পাতালপুরির গল্প কে বলবে আমাকে?’
লোক দেখানো কান্না কাঁদছিল প্রতিমাও। শিউলি ডুবে মরেছে শুনে সে ভিতরে ভিতরে খুশি। যাক সংসারের একটা ঝামেলা গেছে। বেঁচে থাকলে বিয়েথা দিতে হতো। বিরাট একটা খরচের ব্যাপার। সেই খরচটা বেঁচে গেল। মনের আনন্দ ভিতরে চেপে তবু সে বিলাপ করে কান্না জুড়ল। ‘শিউলি রে, ও শিউলি। এই তুই কী করলি রে বোন? এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেলি? ও শিউলি, শিউলি।’
প্রতিমার বিলাপ শুনে বোনের জন্য কাঁদতে কাঁদতে জীবনে এই প্রথম স্ত্রীর ওপর রাগে ক্রোধে ফেটে পড়ল গৌতম। লাফ দিয়ে উঠে বিরাট একটা ধমক দিল প্রতিমাকে। ‘এই, তুই চুপ কর। ডাইনি কোথাকার! তুই আমার বোনের জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছিস। তোর অত্যাচারে আমার বোন শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার তার জন্য আল্লাদ দেখাচ্ছিস? চুপ কর তুই, চুপ কর। তোর ওই পচা মুখে আমার বোনের নাম নিবি না। তুই একটা পিশাচনি, ডাইনি, শাকচুন্নি।’
পাড়ার লোকজন গৌতমের রাগ ক্রোধে ফেটে পড়া দেখে বিস্মিত। পাশের বাড়ির নিতাই তপাদারের বুড়িমা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। খুবই ঠোঁটকাটা বুড়ি। সে ফোকলা মুখে বলল, ‘এখন এত বাহাদুরি দেখাচ্ছিস কেন রে, গৌতম? আগে এই কাজটা করতে পারিসনি? তা হলে তো বোনটা বাঁচতো। ওকে তো তোর বউই মেরেছে! শিউলি তো ডুবে মরেনি। ইচ্ছা করে মরেছে। জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে। এই জন্য তোর ওই বউটা দায়ী। তুইও দায়ী। বেঁচে থাকতে বোনের পক্ষ হয়ে একটা কথা বলিসনি বউকে। এখন তড়পাচ্ছিস। তড়পানি বন্ধ কর। তোর আর তোর বউয়ের এই সব কাণ্ড দেখে লোকে হাসছে।’
বুড়ির কথা শুনে ভিড় করা নারী-পুরুষ সবাই মুখ চেপে হাসতে শুরু করেছে। গৌতম থেমে গেছে। প্রতিমা গেছে হতভম্ব হয়ে।
তখন অর্জুন আবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘পিসিমণি মরে গেছে। আমাকে পাতালপুরির গল্প শোনাবে কে? পিসিমণি ও পিসিমণি, তুমি মরে গেলে কেন?’
নিজেকে সামলাবার জন্য প্রতিমা উঠে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। সেই লোক দেখানো কান্না কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি শোনাব বাবা। আমি তোমাকে পাতালপুরির গল্প শোনাব।’
অর্জুন তার মাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ‘তোমার গল্প আমি শুনব না। তুমি পচা। পিসিমণিকে একদিন চুলের মুঠি ধরে মেরেছ। আমি দেখেছি। তুমি পচা, খারাপ। পিসিমণি, ও পিসিমণি’ বলে কাঁদতে কাঁদতে নদীর দিকে চলে গেল অর্জুন।
তপাদার বুড়ি তখন আবার ধরেছে প্রতিমাকে। ‘দেখছিস, পেটের ছেলেও বলছে তুই পচা, তুই খারাপ। এর থেকে লজ্জার কিছু নেই। তোরও জলে ডুবে মরা উচিত। ডাইনি কোথাকার।’
প্রতিমা এবার রাগে ফুঁসে উঠতে চাইল। কঠিন জবাব দিতে চাইল বুড়ির কথার। শেষ পর্যন্ত সাহস পেল না। এখন বুড়ির কথার প্রতিবাদ করতে গেলে পাড়ার সব মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপর। কারণ শিউলির সঙ্গে সে যা করেছে তা সবাই জানে। মেয়েটার লেখাপড়া বন্ধ করিয়েছে, বাড়ির পুরোদস্তুর ঝি বানিয়ে ছেড়েছে। আর বোন হারিয়ে গৌতমের আজ যে অবস্থা হয়েছে, রান্নাঘরের সামনে পড়ে থাকা চ্যালাকাঠ দিয়ে তাকে পেটাতেও পারে। সুতরাং প্রতিমা মাথা নিচু করে উঠোনের কোণে বসে রইল।
এলাকার লোকজন ভেবেছিল যেহেতু জলে ডুবে মারা গেছে শিউলি, দু-একদিনের মধ্যে নিশ্চয় তার লাশ ভেসে উঠবে। তাদের গ্রামে না হোক পাশের গ্রাম, বা তার পাশের গ্রামের কেউ না কেউ শিউলির লাশ পাবে। এ পাড়ায় খবর দেবে।
না, শিউলির লাশ ভেসে উঠল না। গৌতমের সঙ্গে গ্রামের আরও কেউ কেউ প্রতিদিন দুবেলা খবর নিল। শিউলির লাশ পাওয়াই গেল না। একদিন দুদিন করে অনেকগুলো দিন কেটে গেল।
জগৎ সংসারে কে কার কথা কতদিন মনে রাখে? ধীরে ধীরে শিউলির কথা সবাই ভুলে গেল। ভুলল না শুধু ছোট্ট অর্জুন। রোজই পিসিমণির কথা তার মনে হয়। রোজই পিসিমণির জন্য সে নির্জন দুপুরে কিংবা শেষ বিকেলের দিকে বাড়ির পাশের নদীতীরে গিয়ে দাঁড়ায়। ‘পিসিমণি, পিসিমণি’ বলে ডাকে আর নিঃশব্দে কাঁদে। ‘পিসিমণি ও পিসিমণি, পিসিমণি গো, আমাকে ফেলে কেন তুমি চলে গেলে? এভাবে কেন তুমি মরে গেলে? ও পিসিমণি...।’ রাতে মাঝে মাঝে পিসিমণিকে সে স্বপ্নেও দেখে। একটাই স্বপ্ন। সে শুয়ে আছে পিসিমণির বুকের কাছে আর পিসিমণি তাকে পাতালপুরির গল্প বলছে। গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ছে অর্জুন।
শিউলি ফিরে এলো দুই বছর চার মাস পর।
দুই
গভীর রাত। শুক্লপক্ষের চাঁদ আকাশে। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে কে যেন তিনবার ডাকল। ‘অর্জুন, অর্জুন রে, ও অর্জুন।’ পিসিমণি ডুবে মরার পর থেকে অর্জুন ঘুমায় প্রতিমার কাছে। বড় ঘরে পাশাপাশি দুটো খাট। একটায় শোয় গৌতম। অন্যটায় প্রতিমা আর অর্জুন।
কেউ ডাকটা শুনতে পেল না। শুনল অর্জুন। সেই ডাকে ঘুম ভাঙল তার। গলাটাও চিনে ফেলল। দিশেহারা ভঙ্গিতে উঠে বসল সে। মাকে ধাক্কাতে লাগল। ‘মা, ওমা, ওঠো। তাড়াতাড়ি ওঠো। পিসিমণি এসেছে।’
অর্জুনের ডাকাডাকি আর ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙল প্রতিমার। বিরক্তির গলায় বলল, ‘কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?’
‘পিসিমণি এসেছে মা। পিসিমণি এসেছে। আমাকে তিনবার ডেকেছে। আমি স্পষ্ট শুনেছি পিসিমণির গলা।’
গৌতমের ঘুম খুব পাতলা। তারও ঘুম ভেঙেছে। সে কিছু একটা বলতে যাবার আগেই ছেলেকে ধমক দিল প্রতিমা। ‘কী বলছিস তুই, পাগল কোথাকার? পিসিমণি আসবে কোত্থেকে? সে তো দু-আড়াই বছর আগে নদীতে ডুবে মরেছে।’
‘কিন্তু পিসিমণি আমাকে এইমাত্র ডেকেছে। একবার না। তিনবার।’
গৌতম পাশের খাট থেকে বলল, ‘তুমি স্বপ্ন দেখেছ, বাবা। পিসিমণির কথা ভাবো তো, এজন্য স্বপ্ন দেখেছ। স্বপ্নে তার ডাকও শুনেছ। ও কিছু না। শুয়ে পড়ো বাবা, শুয়ে পড়ো।’
ঠিক এ সময় আবার সেই ডাক। ‘অর্জুন, অর্জুন রে, দরজা খোল বাবা। দরজা খোল।’
এবার তিনজনেই শুনল শিউলির ডাক। গলা চিনতে কারওই ভুল হলো না। অর্জুন উত্তেজিত গলায় বলল, ‘ওই শোনো, পিসিমণি আমাকে ডাকছে! বাবা, বাবা তুমি শুনেছ? মা, তুমি শুনতে পাওনি?’
[চলবে]