মোরশেদ সাহেব বললেন, “থাক অন্তু। অনেক হয়েছে। এবার থামো। শাস্তি সে পেয়েছে। ভয়ও পেয়েছে। এতদূর থেকে এসেছে। আজকের রাতটা থাক। কাল সকালে চলে যাবে। আর কিছু বলো না।” আজও সকাল থেকে আকাশ মেঘলা ছিল। রোদ ওঠেনি। এইমাত্র মেঘলা ভাব কেটে গেল। পশ্চিম আকাশ থেকে অপূর্ব এক টুকরো আলো এসে ঢুকল মোরশেদ সাহেবের ফ্ল্যাটে। সেই আলোয় ভদ্রলোককে দেবদূতের মতো দেখাচ্ছিল।
অন্তু ভিতরে ভিতরে স্বস্তি বোধ করল। বুঝল কথার প্যাঁচে গফুরকে কব্জা করে ফেলেছে। নিজেকে সে রক্ষা করতে পারবে। রাতটা কোনো রকমে কাটাতে পারলে হয়। তারপর সকালবেলা মা দরজা খুলে দেওয়ার পর বাথরুমের কথা বলে পালাবে।
গফুর অপলক চোখে অন্তুকে দেখছে আর মিটি মিটি হাসছে। “একটা কথা বলি তোমারে। আমার সবকিছুই ভালো। দোষ খালি একটাই। আমার ঘুম বড় কঠিন। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমাই। জাগি না সহজে। তোমার সঙ্গে গল্প করতে করতে ঘুমাইয়া গেলে কিছু মনে কইরো না।”
“না না, ঠিক আছে।”
গফুরের সঙ্গে রাত ১০টার দিকে খেল অন্তু। পোলাও আর মুরগির মাংস। গফুর খুবই তৃপ্তি করে খেল। অন্তু খেল সামান্য। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না।
রাত ১টার দিকে ঘুমিয়ে পড়ল গফুর। এই এতটাক্ষণ সৌদিতে চাকরির গল্প, কীভাবে সৌদিতে গিয়ে টাকা রোজগার করছে ইত্যাদি ইত্যাদি সবিস্তারে বলে গেল। যেন গফুরের কথা খুবই মুগ্ধ হয়ে শুনছে অন্তু এমন ভাব করল। মাথা নাড়ল, হাসল। এক সময় চিৎ হয়ে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল গফুর। অন্তু খাটের কোণে বসেই রইল। গফুর শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইট অফ করে দিয়েছিল। তারপর এমন কান্না পেল! কিন্তু কাঁদল না সে। পাথরের মতো বসে রইল। মরিয়মের ওপর এখন আর অভিমান নেই। ভয়ানক রাগ হয়েছে। মহিলাকে কঠিন একটা শাস্তি সে দেবেই।
ভোররাতের দিকে ঘটল আরেক ঘটনা।
অন্তু টের পেল দরজার তালা যেন শব্দ বাঁচিয়ে কেউ খুলছে। সে নিঃশব্দে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুহূর্তে তালা খুলে আলতো হাতে দরজার কপাট ফাঁক করল কেউ। যা অনুমান করেছিল তাই। দরজা খুলে দিয়েছে দোলন। বাইরে অন্ধকার ফিকে হয়েছে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নিঃশব্দে বেরুল অন্তু। দোলন ফিস ফিস করে বলল, “আমি সারা রাত ঘুমাই নাই। মা’র কোমরে আছিল চাবি। চুরি কইরা আনছি। তুমি পালাও। আমি আবার এই ঘরে তালা দিতাছি। তারপর চাবি মা’র কোমরে রাইখা দিমু।”
বোনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এলো অন্তুর। গভীর মমতায় দোলনের মাথায় মুহূর্তের জন্য হাত রাখল সে। তারপর যতটা নিঃশব্দে সম্ভব পা চালিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
মাঠে নেমে অন্তু টের পেল তার পিছন পিছন কেউ দৌড়ে আসছে। একটু ভয় পেল সে। বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেল? মা দৌড়ে আসছে?
অন্তু দৌড় দিতে গিয়ে ফিরে তাকাল। না, দোলন আসছে। সে দাঁড়াল। দোলন এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আপা, আমিও তোমার সঙ্গে চলে যাব। নাইলে মায় আমারে পিটাইয়া মাইরা ফালাইব। এই বয়সে আমারেও বিয়া দিয়া দিব। আমারে তুমি লইয়া যাও। কোনো বাসায় কামে দিয়া দিও।
বোনটার জন্য এত মায়া হলো অন্তুর! শক্ত করে দোলনের একটা হাত ধরল সে। “চল”।
চাবিটা তখনও দোলনের হাতে। অন্তু হাত ধরার পর চাবি সে ধানখেতে ছুড়ে ফেলল।
তিন
অন্তু আর দোলনকে দেখে মোরশেদ সাহেবের ফ্ল্যাটে সাড়া পড়ে গেল। ঝড়ো কাকের মতো অবস্থা মেয়ে দুটোর। মুখ শুকনো, চোখ বসে গেছে। এক কাপড়ে চলে এসেছে। সঙ্গে কিচ্ছু নেই।
মোরশেদ সাহেব আর জিনাতকে কাঁদতে কাঁদতে ঘটনা বলল অন্তু। তখন মেয়ে দুটোর চারপাশে সুফিয়া, কমলা আর জামান সাহেবও আছেন। শুনে মানুষগুলো হতভম্ব।
মোরশেদ সাহেব পায়চারি করছিলেন। সব শুনে সোফায় বসে পড়লেন। অন্তু গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াল। “খালু, পুলিশের ডিআইজি মাহতাব আঙ্কেল আপনার বন্ধু। তাঁকে দিয়ে নলিতাবাড়ী থানায় একটা ফোন করাবেন। আমি আমার মাকে একদিন হলেও হাজত খাটাতে চাই। সে যে অন্যায় করেছে তার শাস্তি হওয়া দরকার।”
মোরশেদ সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “আগে তুমি ফ্রেশ হও। বোনকে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করো। পরে দেখা যাবে।”
“না, আমার অনুরোধ। আপনি এখনই মাহতাব আঙ্কেলকে ফোন করেন।”
অন্তুর সঙ্গে জিনাতও গলা মিলাল। “আমিও তাই চাই। মরিয়মের একটা বড় রকমের ধাক্কা খাওয়া দরকার। ছি ছি! এটা কোনো মানুষের কাজ? ঠিক আছে, আমিই মাহতাব ভাইকে ফোন করছি।”
“অস্থির হইও না। আমিই করছি।”
মোরশেদ সাহেব ফোন করলেন। মাহতাব সাহেবকে সব বললেন। শুনে তিনি শুধু বললেন, “আমি দেখছি।”
অন্তু তারপর জিনাতকে বলল, “খালাম্মা, দোলনকে আপনাদের কোনো আত্মীয়ের বাসায় কাজে লাগিয়ে দিলে ভালো হয়। ও আর বাড়ি ফিরে যাবে না।”
জিনাত কথা বলবার আগেই মোরশেদ সাহেব বললেন, “কোথাও যেতে হবে না। দোলনও তোমার সঙ্গেই থাকবে। আমি ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব।”
শুনে মেয়ে দুটোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।
চার দিন পরের ঘটনা
মরিয়ম অপরাধীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ডাইনিং স্পেসের সামনে। পায়ের কাছে অন্তুর ব্যাগ। এখন বিকেল। খানিক আগে মরিয়ম এসে ঢুকেছে। তাকে দেখেই দপ করে জ্বলে উঠল অন্তু। “তোমার সাহস হলো কী করে এই বাড়িতে আসার? তুমি মা না, তুমি ডাইনি। লোভী মহিলা। যাও, বেরোও এই বাড়ি থেকে। যাও।”
অন্তুর সঙ্গে দোলনও গলা মিলাল। “এই মুখ তুমি আমাদের দেখাইতে আসছ কেমনে? তোমার লজ্জা করে নাই? মেয়ের সঙ্গে ওই কাজ কইরা আবার তার সামনে আসছ?”
ওদের কথাবার্তা শুনে জিনাত বেরিয়ে এলেন বেডরুম থেকে। মোরশেদ সাহেব এলেন। কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কমলা আর সুফিয়া।
জিনাত আর মোরশেদ সাহেবকে দেখে অন্তু বলল, “পুলিশ ডাকুন খালু। এই মহিলাকে ধরিয়ে দিন।”
এবার হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল মরিয়ম। “পুলিশ আমারে ধইরা লইয়া গেছিল। নালিতাবাড়ী থানায় সকাল থিকা সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকাইয়া রাখছিল। বলছে তগো কাছে আইসা মাফ চাইতে। আমি মাফ চাইতে আসছি। আমার ভুল হইয়া গেছে মা। আমারে মাফ কইরা দে। আমি তোর ব্যাগ লইয়া আইছি, মোবাইল লইয়া আইছি। সাহেবের পঞ্চাশ হাজার টাকাও লইয়া আইছি।”
অন্তু বলল, “সব রেখে বেরিয়ে যাও। আর কোনো দিন যেন তোমার চেহারা না দেখি। তুমি আমাদের মা না। যাও, যাও।”
মোরশেদ সাহেব এবং জিনাত অবাক হয়ে অন্তুকে দেখছিলেন। নরম নিরীহ মেয়েটি কী রকম দপ দপ করে জ্বলছে। কতটা দুঃখ পেলে মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে এ আচরণ করতে পারে!
তার পরই মারমুখো ভঙ্গিতে মরিয়মের দিকে এগিয়ে গেল অন্তু। “তুমি বেরুবে নাকি ধাক্কা মেরে বের করব?”
মোরশেদ সাহেব বললেন, “থাক অন্তু। অনেক হয়েছে। এবার থামো। শাস্তি সে পেয়েছে। ভয়ও পেয়েছে। এতদূর থেকে এসেছে। আজকের রাতটা থাক। কাল সকালে চলে যাবে। আর কিছু বলো না।”
আজও সকাল থেকে আকাশ মেঘলা ছিল। রোদ ওঠেনি। এইমাত্র মেঘলা ভাব কেটে গেল। পশ্চিম আকাশ থেকে অপূর্ব এক টুকরো আলো এসে ঢুকল মোরশেদ সাহেবের ফ্ল্যাটে। সেই আলোয় ভদ্রলোককে দেবদূতের মতো দেখাচ্ছিল।