শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

রুদ্র-বাহিনী

মোস্তফা কামাল

রুদ্র-বাহিনী

ঘর থেকে বের হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। তার দৃষ্টি স্থির। চোখের সামনে সে যা দেখছে তা অবিশ্বাস্য।

রুদ্রর পুরো নাম রুদ্র মোহাম্মদ। ঢাকা শহরের সেগুনবাগিচা এলাকায় তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। গ্রামের বাড়ি বরিশালে। কিন্তু নিজের চোখে নিজেদের বাড়ি কখনো দেখা হয়নি। বাবার কাছে গ্রামের বাড়ির গল্প শুনে শুনে যতটা সে আন্দাজ করতে পেরেছে সেটাই তার মাথায় আছে। মাঝে মধ্যে কল্পনায় সে গ্রামটাকে দেখে। কখনো কখনো মাকে জিজ্ঞাসা করে, মা তুমি বলো না! আমাদের গ্রামটা কেমন? কীভাবে যেতে হয়?

রুদ্রর মা রাহেলা দিলশাত বিয়ের পর একবারই গ্রামে গিয়েছিলেন। নতুন বউয়ের গ্রাম দেখা যাকে বলে! সেটাও তার কাছে স্মৃতি হয়ে আছে। তিনিও মাঝেমধ্যে ছেলের কাছে গ্রামের গল্প করেছেন। কাঁচাপাকা বাড়ি। বাড়ির তিনদিকে তিনটি পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। বাড়ির সামনে খেলার মাঠ। তার সামনে পাকা মসজিদ ঘর। রুদ্র বড় হওয়ার পর সেই গল্পও আর বলা হয় না।

রুদ্র কয়েকবার ওর বাবার কাছে গ্রামে যাওয়ার আবদার করেছিল। কিন্তু নাসির মোহাম্মদ কেন জানি খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। রুদ্র গ্রামে যাওয়ার কথা বললেই তিনি বলতেন, গ্রামে কেউ থাকে নাকি! ঘরবাড়ি কী অবস্থায় আছে তাও জানি না। এভাবে কি যাওয়া যায়! যেতে হলে আগে আমাকে গিয়ে সব ঠিকঠাক করতে হবে। সেটা করার সময় কোথায়! তারপরও তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন; এক সময় সবাইকে নিয়ে গ্রামে যাবেন। কে জানত, তাকে অসময়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে!

মৃত্যুর পর নাসির মোহাম্মদের কবর কোথায় হবে সে বিষয়ে তিনি কিছুই বলে যাননি। অবশ্য ওই বয়সে বলার কথাও না। পঞ্চাশ-একান্ন বছর বয়সে কি কোনো মানুষ মৃত্যুর কথা ভাবে! হয়তো কেউ কেউ ভাবে। নাসির মোহাম্মদ কখনো ভাবেননি। হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেলেন। তার কবর হলো আজিমপুর গোরস্থানে। প্রথম দিকে রাহেলা দিলশাত ছেলেকে নিয়ে প্রতি শুক্রবার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে জিয়ারত করতেন। রুদ্র তার বাবার জন্য দোয়া করত। এখন আর যাওয়া যায় না। রুদ্রর মাও এখন আর যান না। ছেলেকেও যাওয়ার জন্য বলেন না। হয়তো সংসারের বোঝা বহন করতে গিয়ে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে তার।

রুদ্র ঢাকা শহর দেখছে। গত রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও সাজানো গোছানো ছিমছাম শহর দেখেছিল সে। সেই শহর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। টর্নেডোর আঘাতে যেমন ল-ভ- হয়; তেমনি একটি শহরের ধ্বংসস্তূূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। এমন দৃশ্য দেখার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। তার বুক ধুকফুক করছে। ভীষণ অস্থির লাগছে। তার চোখ বুজে আসছে। বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠছে। কেন এমন হলো! কীভাবে হলো? কিছুই বুঝতে পারে না সে।

রুদ্র নিজের অজান্তেই সামনের দিকে পা ফেলে। একপা ফেলে আবার স্থির হয়ে দাঁড়ায়। হঠাৎ ক্ষতবিক্ষত কিছু মরদেহ দেখে আঁতকে ওঠে সে! না না! সে তাকাতেই পারছে না। দুই চোখ দুই হাত দিয়ে বন্ধ করে রাখে। মনে মনে বলে, উহ! এসব দেখা যায় না। আমি কি আবার নিজের বাড়িতে ফিরে যাব? নাকি সামনে এগোবো?

মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। তার ভয় লাগছে। এমন ধ্বংসযজ্ঞ জীবনে কোথাও দেখেনি। কল্পনাও করেনি। কোনো কোনো দোতলা-তিনতলা বাড়ি ধসে পড়ে আছে। কোথাও ধসে পড়েছে বাড়ির দেয়াল। আবার কোনো কোনো বাড়ির সামনে লাশ পড়ে আছে। পিচঢালা রাস্তায় জমাট বেঁধে আছে ছোপ ছোপ রক্ত। তার পা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করে উঠছে।

রুদ্রকে দূর থেকে দেখতে পায় তার প্রতিবেশী জসিম উদ্দিনকে। সে তার কাছে এগিয়ে যায়। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে জানতে চায়, কোথায় যাও রুদ্র?

জসিম ভাই, এসব আমি কী দেখছি! আমি ঠিক দেখছি তো!

রুদ্র থরথর করে কাঁপছে। জসিম উদ্দিন রুদ্রর কাঁধে হাত রাখলো। তারপর বলল, পাকিস্তানি হায়েনারা রাতের আঁধারে ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা চালিয়েছে। আকাশ থেকে শত শত বোমা ফেলেছে। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ইপিআর হেডকোয়ার্টারসহ ঢাকার প্রধান প্রধান এলাকায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে।

জসিম উদ্দিন যা বলছে তা রুদ্র বিশ্বাসই করতে পারছে না। সে মনে মনে ভাবে, এটা কী করে সম্ভব? গতকালও তো আলোচনা চলেছিল। সেই আলোচনা কি ভেঙে গেছে! ইয়াহিয়ার মনে তাহলে এটাই ছিল!

রুদ্র কিছু বলার আগেই জসিম উদ্দিন বলল, তুমি কি জানো, বঙ্গবন্ধুকে গত রাতেই গ্রেফতার করেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী? তাঁকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। তারপরই ঢাকার ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালায় হায়েনারা।

তাহলে আলোচনায় কেন বসলো? লোক দেখানো এই আলোচনার কি কোনো দরকার ছিল?

আরে বাবা! এসব ইয়াহিয়ার ভাঁওতাবাজি! সে তো আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করেছে। গতকালই (২৪ মার্চ) আলোচনা ভেঙে গেছে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিশেষ ফ্লাইটে পাকিস্তান চলে গেছে। তারপর তারা অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিকে দমাতে চেয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ ঢাকাকে স্তব্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে।

এখন উপায়!

এখন আর ঢাকায় থাকা নিরাপদ না!

তাই? আবারও হামলা করবে?

করতে পারে।

এখন কি করব?

তুমি বাসায় যাও। তোমার মা কোথায়?

বাসায়।

তাকে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও।

তাই? সত্যি বলছো?

হুম। তুমি আজকের মধ্যেই ঢাকা ছেড়ে চলে যাও। গ্রামে তোমাদের বাড়ি আছে না?

আছে।

তাহলে সেখানেই বলে চলে যাও।

তুমি কী করবে? তুমি কোথায় থাকবে?

আমিও চলে যাবো।

কোথায় যাবে?

গ্রামে।

আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বাসায় যাই। মাকে গিয়ে বলি।

নিরাপদে থেকো। আমি গেলাম। খালাম্মাকে আমার সালাম দিও।

আচ্ছা।

রুদ্র বাসার উদ্দেশে রওনা হয়। এদিকে রুদ্রকে বাসায় না দেখে রাহেলা দিলশাত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি ইতোমধ্যেই ঢাকায় হামলার কথা জেনে গেছেন। প্রতিবেশী জমিলা বেগম তাকে বাসায় এসে জানিয়েছেন। তিনি এও তাকে বলেছেন, আপনি যত দ্রুত সম্ভব ছেলেকে নিয়ে ঢাকা থেকে চলে যান। তা না হলে বাঁচতে পারবেন না। আমরা হয়তো ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। আমরা আজই গ্রামে চলে যাচ্ছি। আপনারাও চলে যান।

রাহেলা জমিলা বেগমের কাছ থেকে সব কথা শোনার পর গ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু ছেলে বাসায় ফেরেনি। তাই তিনি তার জন্য দুশ্চিন্তা করছেন। অনেকক্ষণ পর রুদ্র বাসায় ফিরে আসে। তার মাকে সব ঘটনা খুলে বলে। রাহেলা দিলশাত নিজেও যে সব কিছু জেনেছেন তাও ছেলেকে বললেন। তারপর বললেন, চল আমরা গ্রামে চলে যাই! এখানে থাকা আর নিরাপদ না।

রুদ্র দ্বিমত করল না। সে তার মাকে নিয়ে গ্রামের উদ্দেশে রওনা হলো।

 

২.

রুদ্র গ্রামে যাওয়ার পর যুবক ছেলেপেলেরা তার কাছে এলো। যুবকদের একজন বাহাউদ্দিন তাকে উদ্দেশ করে বলল, আপনি শিক্ষিত মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আপনার নেতৃত্বে আমরা একটা মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করতে চাই। আমাদের দলের নাম হবে রুদ্র বাহিনী।

বাহাউদ্দিনের কথাটা ভাবিয়ে তুলল রুদ্রকে। সে যুদ্ধে যাবে! সত্যিই কি সে এই দেশের জন্য যুদ্ধ করবে! মা কি যেতে দেবেন!

রুদ্রকে চুপ থাকতে দেখে রাজ্জাক আলী বলল, ভাইজান কিছু বলেন। আমরা যুদ্ধে যাব। আপনি আমাদের নেতৃত্ব দেবেন।

রুদ্র বলল, তোমরা সবাই যুদ্ধে যাবে?

যুবকদল একসঙ্গে বলে উঠল, জি আমরা যুদ্ধে যাব।

আমাদের তো কোনো ট্রেনিং নাই। যুদ্ধ করতে অস্ত্র লাগে। তাও আমাদের নাই। যুদ্ধ করব কীভাবে?

বাহাউদ্দিন বলল, আমার বড় কাকা আর্মিতে আছিল না!

হুম। 

তার তো অভিজ্ঞতা আছে। উনি আমাদের ট্রেনিং দিতে পারবেন না?

তা পারবেন। উনি কি দেশে আছেন?

হ্যাঁ। বাড়িতেই তো!

উনি না হয় ট্রেনিং দিলেন। অস্ত্র পাবো কোথায়?

আগে তো ট্রেনিং নিই। তারপর দেখা যাক কোথায় অস্ত্র পাই!

বাহাউদ্দিনের কথাটা পছন্দ হয়েছে রুদ্রর। সে বাহাউদ্দিনকে উদ্দেশ করে বলল, চল তাহলে তোর কাকার কাছে যাই। উনি ট্রেনিং দিতে রাজি হলে আমরা দ্রুত ট্রেনিং নিই।

চলেন যাই।

বাহাউদ্দিনের পেছনে পেছনে রুদ্রসহ অন্য যুবকরা এগিয়ে যায়। বাহাউদ্দিন আবদুল হকের ঘরের সামনে গিয়ে ডাকাডাকি করে। কাকা কাকা! কাকা বাড়ি আছেন?

আবদুল হক বাইরে বেরিয়ে এসে যুবকদের সামনে দাঁড়ান। তাকে দেখে রুদ্র সালাম দিয়ে বলল, কাকা কেমন আছেন?

আছি বাবা। ভালো আছি। আরে তুমি রুদ্র না!

জি কাকা।

তুমি দেশে কবে আসছো?

গতকাল কাকা।

তারপর কী ব্যাপার? তোমরা সব একসঙ্গে।

কাকা, আমরা একটা আবদার নিয়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে আবদারটা রাখতে হবে কাকা।

কী আবদার বাবা?

আগে বলেন, আপনি রাখবেন!

রাখার মতো হলে কিংবা আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই রাখব।

কাকা, আপনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন। আপনি যদি আমাদের ট্রেনিং দিতেন! অস্ত্র চালনা শিখতে পারলেই হবে। যুদ্ধ করতে হলে কীভাবে কী করতে হয় তাও যদি শিখাতেন!

আচ্ছা। তোমরা দেশের জন্য লড়বে? যুদ্ধ করব? তোমাদের মুখে এ কথা শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি অবশ্যই তোমাদের প্রশিক্ষণ দেবো। কবে থেকে প্রশিক্ষণ নিতে চাও?

আপনি যেদিন থেকে বলবেন সেদিনই।

আচ্ছা। তাহলে কাল থেকেই।

যুবকরা সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। আবদুল হক চিন্তায় পড়লেন। তিনি অস্ত্র চালনার ট্রেনিং কীভাবে দেবেন? তার কাছে তো কোনো অস্ত্র নেই! তিনি উপায়ান্ত না পেয়ে হিজলা, মুলাদী ও মেহেন্দিগঞ্জ থানার আঞ্চলিক কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাকে তিনি প্রশিক্ষণ সম্পর্কে অবহিত করলেন। কমান্ডার তাকে একটি রাইফেল আর একটি বন্দুক দিতে রাজি হলেন। সেই অস্ত্র দিয়ে এগার যুবককে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। টানা দুই মাস প্রশিক্ষণের পর রুদ্র সবাইকে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। রুদ্র তার মাকে যখন যুদ্ধে যাওয়ার কথা বলল, তখন রাহেলা দিলশাত কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। অল্প বয়সে তিনি স্বামীকে হারিয়েছেন। একমাত্র ছেলে রুদ্রই ছিল তার চলার শক্তি। তার বেঁচে থাকার অবলম্বন। সেই রুদ্র দেশের জন্য লড়াই করবে। এতে তার জীবনও দিতে হতে পারে। দেশের জন্য যদি জীবন দিতে হয় দিক! আমি তাকে বাধা দেব না। কিছুতেই না! রাহেলা দিলশাত রুদ্রকে ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন, তুই যুদ্ধে যাবি বাবা! সত্যিই যুদ্ধে যাবি!

হ্যাঁ মা। সত্যি যুদ্ধে যাব। আমার সঙ্গে আমাদের গ্রামের আরও আট-দশ জন ছেলে যাবে। ওরা আমাদের দলের নাম দিয়েছে রুদ্র-বাহিনী।

রাহেলা দিলশাত ছেলেকে কাছে টেনে কপালে চুমু দিলেন। তারপর বললেন, এই শুভ কাজে আমি তোকে বাধা দেব না বাবা। তুই যা। দেশ রক্ষায় নিজেকে শামিল করবি, এ যে আমার জন্য অনেক বড় গর্বের!

রুদ্র বাহিনীর অন্য সদস্যরাও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মা-বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিল। তারপর তারা হিজলা মুলাদী ও মেহেন্দিগঞ্জের আঞ্চলিক মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কুদ্দুস মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করল। তাকে রুদ্র ট্রেনিংয়ের বিষয়টি অবহিত করে তার কাছ থেকে নেওয়া রাইফেল ও বন্দুক ফেরত দিল। তারপর সে বলল, আমরা ১১ যুবক যুদ্ধে যাব। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র নেই। আবদুল হক বলেছেন, আপনি অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।

রুদ্রর কথা শুনে আঞ্চলিক কমান্ডার কুদ্দুস মোল্লা বললেন, তোমরা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আবদুল হক সাহেবের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছ! উনি নিশ্চয়ই অনেক ভালো একজন প্রশিক্ষক। আমি তোমাদের সবাইকে অস্ত্র দিচ্ছি। তোমরা নেমে পড়ো। দেরি করো না। একটা কথা মনে রেখো, শত্রু কিন্তু আমাদের ভিতরেই। চোখ-কান খোলা রেখো।

রুদ্র বলল, আমরা কোথা থেকে শুরু করতে পারি? আপনার যদি কোনো পরামর্শ থাকে তাহলে আমাদের বলতে পারেন।

তাহলে শোন বলছি। হিজলা থানার কাছে পাক-বাহিনী একটি ক্যাম্প করেছে। ওই ক্যাম্পে যদি আক্রমণ চালাতে পারো তাহলে পুরো এলাকা শত্রুমুক্ত হবে। কিন্তু কাজ খুব সাবধানে করতে হবে।

রুদ্র তার দলের সবার দিকে তাকিয়ে মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল। সবার মুখাবয়বে সম্মতির ছাপ। রুদ্র আর দেরি করল না। সে বলল, আমরা চেষ্টা করি। আশা করি আমরা পারব।

রুদ্র বাহিনী সিদ্ধান্ত নিল, কোনো এক রাতে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা রাতের আঁধারে পাক বাহিনীর ক্যাম্পের চারদিকে অবস্থান নিল। রাত দ্বিপ্রহরের সময় সবাই যখন ঘুমে তখন তারা অতর্কিতে হামলা করল ক্যাম্পে। পাক বাহিনীর সদস্যরা পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করলেও মুহুর্মুহু গুলির মুখে তারা পেরে উঠল না। প্রথম আক্রমণেই বিজয়ী হলো রুদ্র বাহিনী। এতে তাদের সাহস বহুগুণ বেড়ে গেলো। এরপর তারা রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণের পরিকল্পনা করল। তাতেও তারা সফল হলো। এভাবেই তারা একের পর এক যুদ্ধে বিজয়ী হয়। রুদ্র বাহিনীর নামডাক দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আঞ্চলিক কমান্ডার কুদ্দুস মোল্লা তাদের কর্মকান্ড দেখে ভীষণ খুশি। তিনি এবার রুদ্র বাহিনীকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিলেন। তিনি বললেন, পাক বাহিনীর একটি লঞ্চ লতা নদীর মাঝখান নোঙর করা। তারা যে কোনো দিন আমাদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালাবে বলে শুনেছি। তোমরা যদি ওই লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিতে পার তাহলে আমাদের অঞ্চলে আর কোনো পাক বাহিনী থাকবে না। আমাদের এলাকা মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করতে পারব।

 

রুদ্র খুব ভালো করেই জানে পাক বাহিনীর লঞ্চটিতে হামলা চালানো অতো সহজ কাজ নয়। আঞ্চলিক কমান্ডারের অর্ডার তো মানতেই হবে। তবে কবে কখন তারা হামলা চালাবে তা নিয়ে ভাবে সে। অনেক চিন্তাভাবনার পর সে মনে মনে একটা তারিখ ঠিক করে। তারপর সহযোদ্ধাদের কাছে বিষয়টি জানায়। কীভাবে হামলা চালাবে সে সম্পর্কেও একটি ছক আঁকে সে। সহযোদ্ধারা একমত হলেই হামলা চালানো হবে লঞ্চে।

সবাই আলোচনার পর হামলার দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। ৩০ নভেম্বর রাত ১১টা। নদীর পশ্চিম দিক থেকে তারা একযোগে হামলা চালাবে। হামলার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় তারা। অবশেষে আসে সেই রাত। রুদ্র সহযোদ্ধাদের নিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে নদীর পশ্চিমতীর ধরে এগোতে থাকে সামনের দিকে। লঞ্চটির একেবারে কাছাকাছি গিয়ে হামলা শুরু করবে ঠিক সেই মুহূর্তে পেছন দিক থেকে রুদ্র বাহিনীর ওপর হামলা চালায় পাক বাহিনী। প্রথম হামলাতে রুদ্র বাহিনীর তিন-চারজন সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে রুদ্র ও তার সহযোদ্ধারা। কিন্তু পাক বাহিনী সংখ্যায় অনেক বেশি থাকায় রুদ্র বাহিনী পিছু হটে। এক পর্যায়ে পাক বাহিনী চরম আঘাত হানে। সেই আঘাতে রুদ্রর সহযোদ্ধা সবাই নিহত হয়। রুদ্রও আহত হয়ে জঙ্গলের পাশের ডোবাতে পড়ে থাকে। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা মৃত লাশগুলোকে নিয়ে পাক বাহিনী উল্লাস করে। তারপর তারা চলে যায় নিজ গন্তব্যে।

 

 

রুদ্র রাস্তার পাশে ডোবায় পড়ে আছে। ভোরের দিকে ওই রাস্তা দিয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিল একদল মুক্তিযোদ্ধা। হঠাৎ গোঙানির শব্দ পেয়ে মিছিলের কয়েকজন দাঁড়িয়ে পড়ে। গোঙানির শব্দ কোন দিক থেকে আসছে তা বোঝার চেষ্টা করে। পরে তারা দেখে ডোবায় কেউ একজন পড়ে আছে। তারা ছুটে যায় তার কাছে। তাকে দুই-তিনজন তুলে আনে রাস্তার ওপর। দেখেই তারা চিনতে পেরে বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, রুদ্র না! ও এখানে এভাবে পড়ে আছে! তারা রুদ্রকে ভালো করে দেখে। পায়ের দিকে চোখ পড়তেই তারা দেখে, দুই পা রক্তাক্ত। শরীরটা একেবারেই নিস্তেজ, নিস্তব্ধ। আসলে রুদ্র বেঁচে আছে না মরে গেছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কেউ নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখছে। আবার কেউ মুখের কাছে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করছে। 

কয়েকজন যুবক রুদ্রকে যখন ধরাধরি করে হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল; ঠিক সেই মুহূর্তে সে বলে ওঠে, জয় বাংলা!

মুক্তিযোদ্ধারা তার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, জয় বাংলা! জয় বাংলা!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর