শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

হাস্নুহেনার ঘ্রাণ

রফিকুর রশীদ

হাস্নুহেনার ঘ্রাণ

‘হাতাপাতা’ শব্দটি একেবারেই অভিনব। খুব সাধারণ আবার বেশ নান্দনিক। ব্যাপারটার সঙ্গে দৃশ্যের আড়ালে হলেও শরীরী গন্ধের মাখামাখি আছে তা ঠিক, তবু কাগজের পাতায় মুদ্রিত অবস্থায় প্রথম পাঠের সঙ্গে সঙ্গে এই নতুন শব্দটি ভালো লেগে যায় রকিবের। শরীরের বাইরে অন্য কোনো নিকষিত হেম খুঁজবার বালাই নেই তার। কুষ্টিয়া রেলস্টেশনে চুল দাড়ি আচ্ছাদিত এক লালন শিষ্যের কণ্ঠে একবার শুনেছিল- ‘যা নেই দেহভান্ডে, তা নেই বিশ্বব্রহ্মান্ডে, সে সময় দেহতত্ত্বের এই বাাখ্যা বেশ ভারি মনে হয়। কিন্তু পরে মনীষার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক বেশ খানিক নিবিড় হয়ে উঠলে একদিন সে মধ্যযুগের কাব্য থেকে ছোট্ট একটি পদ শোনায়- ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর।’ খুব সহজ দাবি এখানে মিষ্টি উচ্চারণে প্রস্ফুটিত। বাংলা অনার্সের ছাত্রী মনীষা কেমন অবলীলায় উচ্চারণ করে-রাই অঙ্গসঙ্গ লাগি...

ইট-বালি সিমেন্ট-রডের আনুপাতিক হিসাব-নিকাশে মগ্ন ইঞ্জিনিয়ার রকিবের কাছে এখন এসব ধূসর ছায়ায় ঢাকা দূরের ছবি। তার স্ত্রী বুলবুলির নিত্যদিনের অভিযোগ- মন টন বলে কিছু নেই, রকিবের হৃদয়জমিনও নাকি পাথুরে কংক্রিটে ঢাকা পড়েছে। এই ধারার অনুযোগ অভিযোগ শুনতে শুনতে এতটাই কানসওয়া হয়ে গেছে যে, সে আর কোনো জবাব দেয় না। তবে কখনো কখনো মনে মনে হাসে। হাসির উদ্রেক হয় বুলবুলির কণ্ঠে বালখিল্য কথাবার্তা শুনে। মনে মনে ভাবে পাথরে ফুল ফোটাবার ব্রত নিয়ে একদা মাথা কুটেছিল যে মনীষা, সে এখন কানাডাপ্রবাসী স্বামীর ঘর আলো করে দাম্পত্য জীবনযাপন করছে; কোথায় তার নব কিশলয়, কোথায় পুষ্পবীথি! নাহ্ এসব আলো-আঁধারির কথা ঘরের স্ত্রী বুলবুলিকে বলার কোনো মানে হয়!

তবু সেদিন অফিসে এসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে টেবিলে জমে থাকা খবরের কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে ‘হাতাপাতা’ শব্দটি সহসা তার চৈতন্যের দরজায় ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। না, এমন শব্দ সে কোনোদিন শোনেনি বা ছাপার অক্ষরে দেখেওনি। খবরের শব্দ এটা নয়, সাহিত্যের শব্দ। অফিসে ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে তিনটি কাগজ নেওয়া হয়। জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক দুটির সঙ্গে নিয়মিত থাকে শুক্রবারের সাময়িকী, শিল্প-সাহিত্য প্রকাশনা নিয়ে নানা রকম আয়োজন।

শনিবার সকালে অফিসে এসে চায়ের সঙ্গে কাগজ পড়া মানে কোনো রকমে খবরের শিরোনামে চোখ বুলানো মাত্র, শিল্প-সাহিত্যের উঠোনে পা দেবে কখন! তবু সেদিন কেমন করে যেন জনপ্রিয় দৈনিকটির সাময়িকীর পাতায় ছাপা একটি গল্পে চোখ আটকে যায়। প্রথম বাক্যে, রাতের বেলা ঘুমানোর আগে বিছানার বিবরণ পাঠ করতে গিয়ে চোখে ঘোর লেগে যায়। নিজের অজান্তে বেশ কয়েকটি বাক্য অতিক্রম করে যায় রকিব, তারপর নজরে পড়ে এই ‘হাতাপাতা’।

বাব্বা! সামান্য এইটুকু শব্দের মধ্যে কী এমন জাদুমাখা রহস্য যে খুঁজে পায় রকিব, শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হতে না হতে তার নাসারন্ধ্রে আছড়ে পড়ে মনীষার শরীরের গন্ধ। না, সে যে ফরাসি পারফিউম ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল ঠিক সেই গন্ধ নয়। শ্বাসবায়ু জোরে ভেতরে টেনে নিতেই টের পায়-ওই পারফিউমের  স্নিগ্ধ ঘ্রাণেরও আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য এক মদির সৌরভ। ফুলের ঘ্রাণের সঙ্গে যদি তুলনা করতেই হয় তাহলে বলা যায় এটা হাস্নুহেনার ফিকে সুরভির কাছাকাছি। আহা, কতোদিন পরে ওই সৌরভ এসে নাসিকার অর্গলে করাঘাত হানে! না না, রকিবের একটুও ভুল হবার কথা নয়। কে জানে মনীষার হাজব্যান্ড আলমগীর এত দিনে স্ত্রীর বুকের গভীরে মায়াবী পর্দা ঢাকা ওই সৌরভের নাগাল পেয়েছে কি না! গল্প কবিতা কিংবা সাহিত্যের কোনো শাখার প্রতি বিশেষ কোনো অনুরাগ কখনোই ছিল না রকিবের। নেহায়েত মনীষার মন জোগাতে গিয়ে ওর সাহিত্যবিষয়ক সব কথায় হুঁ-হ্যাঁ দিতে দিতে নিজের ভেতরটা যতটুকু নুয়ে এসেছিল, শুধু সেইটুকুই তার সাহিত্যপ্রীতি, তার অধিক নয়। অথচ সেদিন সকালে বাংলা দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর পাতা উল্টিয়ে একটি গল্পের দু-তিনটি প্যারা দিব্যি পড়ে ফেলার পর ‘হাতাপাতা’ শব্দে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

এ কেমন শব্দরে বাবা! অভিধান খুললে এ শব্দের অর্থ পাওয়া যাবে! কিংবা কোনো প্রতিশব্দ? না, অভিধান ঘাঁটবার দরকার হয় না, গল্পকার জানাচ্ছেন- ওটা গল্পের নায়িকার নিজ বিবেচনায় বানানো শব্দ। স্বামী ভদ্রলোক ঘুমের মধ্যেও স্ত্রীর সারা শরীর হাতড়ে ফেরেন। পেটে, পিঠে, বুকে, পাছায়, সবখানে হাত বুলানো চাই। স্ত্রী বাধা দেয় না। বরং গড়িয়ে এসে স্বামীর বুকের ওপর পড়ে। এ প্রায় নিত্যদিনের অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে। স্বামীর এই শরীর হাতড়ানো অভ্যেসটাকইে তার স্ত্রী আদর করে নাম দিয়েছে হাতাপাতা।

কিন্তু এ কি অসম্ভব কান্ড! শব্দের শরীর বেয়ে কোন অচেনা সুদূর থেকে ভেসে আসে নারীর শরীরী সৌরভ! রকিবের গল্প পাঠ আর এগোতে চায় না। কেমন এক বিহ্বলতায় পেয়ে বসে। চোখের পর্দাজুড়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মনীষার মুখ। সেই ভুরু, সেই চিবুক, সেই কাজলটানা চোখ। না, ইচ্ছে করে কাজল পরতে হয় না, প্রকৃতি ওইভাবে সাজিয়েছে তাকে-চোখের পাতায় কাজল আঁকা। কিন্তু কালো কাজলের আড়ালে কোন বিষণœতার মেঘ এমন থমকে দাঁড়িয়ে! এ রকম তো হওয়ার কথা নয়! রকিবের সঙ্গে আলমগীরের তুলনা করে, আগাপাশতলা মিলিয়ে দেখে শুনে তারপর বেশ ধীরে সুস্থেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে মনীষা, আবার কেন চোখের কোনে বিষণ্নতা! আলমগীরকে চিনত না মনীষা। চিনিয়ে দিয়েছে রকিব নিজেই, সহপাঠী বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে; একদা এ নিয়ে আফসোস হতো নিজের বোকামির জন্যে। নিজেকে তিরস্কারও করেছে। পরে মনে হয়েছে এ সবই তার ভুল হিসাব। মনীষা সব জেনেশুনে আটঘাট বেঁধে অঙ্ক কষে তবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বহুবার মনীষার কণ্ঠে শুনেছে ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর’। মধ্যযুগীয় এই পদের মধ্যে বিশেষ কোনো ইঙ্গিত বা আহ্বান ছিল কি না কে জানে! রকিব সেই ‘প্রতি অঙ্গে’র সন্ধান করতে যায়নি কখনো। আলমগীর নিশ্চয় মনীষার ‘প্রতি অঙ্গে’র কান্নার মর্ম বুঝেছে, যথামূল্যও দিয়েছে। তবে তার বিষণ্নতা কিসের! না না, এ হচ্ছে রকিবেরই মানসবিভ্রম, অন্যভাবে বলা যায় বিষণ্নতা বাতিক। মনীষা আছে তার আপন ভুবনে রাজরাজেন্দ্রানী হয়ে। একবার রাতের আকাশে সপ্তর্ষিমন্ডলীর মাঝে গিয়ে অরুন্ধতী হবার সাধ জেগেছিল তার। সপ্তর্ষি মানে তো সাত ঋষির সমাহার, বাঙালি অবাঙালি মিলিয়ে এত দিনে কজন ঋষির যে ধ্যানভঙ্গ ঘটাতে সক্ষম হলো তাই বা কে জানে।

সাহিত্য বিমুখ রকিবের দৃষ্টি সেদিন সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় লাইন স্পেসের ফাঁকে ফাঁকে বিলি কেটে কেটে এগিয়ে চলে, কখনো হোঁচট খায়, থমকে দাঁড়ায়; আবার পাথর সরিয়ে এগিয়ে চলে। অজ্ঞতাও এক রকম পাথর বই কি! রকিবের তো জানাই ছিল না গল্প উপন্যাসে কনজ্যুগাল লাইফ কিংবা ফিজিক্যাল রিলেশন নিয়ে, এমনকি তার বিশ্বস্ততা-অবিশ্বস্ততা নিয়েও এমন খোলামেলা কথাবার্তা লেখা যায়। গল্পের নায়ক এবং নায়িকা কেমন অবলীলায় তাদের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে লুকানো অন্ধকার মুঠো মুঠো মেলে ধরছে-পড়তে পড়তে সে অবাক হয়ে যায়। জীবনের মধু শুধু নয়, এতটা তিক্ত গরলের কথাও কি অতলান্তিক গভীর থেকে তুলে সাহিত্যের পত্রপুটে পরিবেশন করা যায়। গল্পপাঠ শেষ না হতেই কী যে এক ভূত এসে রকিবের কাঁধে চেপে বসে, সহসা পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে বাটন টেপে দ্রুত হাতে- জিরো ওয়ান সেভেন ওয়ান... নাহ্, এন্গেজ্ড টোন, রিনরিনে নারীকণ্ঠের আহ্বান ভেসে আসে- কিছুক্ষণ পর আপনি আবার কল করুন। সুবোধ বালকের মতো রকিব তাই করে, একবার দুবার তিনবার! একই উত্তর পেন্ডুলামের মতো দোল খায়- দুঃখিত, আপনি যে নম্বরে কল করেছেন, সেই নম্বরটি এখন ব্যস্ত আছে।

অপর প্রান্তের ব্যস্ততা ফুরাতে না ফুরাতেই রকিব আরও ব্যস্তকণ্ঠে প্রশ্ন করে,

হ্যালো বুলি! কার সঙ্গে এতক্ষণ এন্গেজ্ড ছিলে বলো তো!

বুলবুলি খুব মজা করে উত্তর দেয়,

সত্যি কথা বলব?

হ্যাঁ, সত্যিই তো বলবে।

মাইন্ড করবে না তো!

তোমাকে তো আমি বলেইছি- সত্যকে আড়াল করাই অন্যায়। তুমি বলো আমি সত্যটাই জানতে চাই।

আমার সেই পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম।

তার মানে সেই আসিফ জাহান?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসিফ। আমার সম্পর্ক তো ওই একজনের সঙ্গেই ছিল।

রকিবের কিছুতেই বিশ্বাস হয় না। বিয়ের পর নানান খুনসুটির মধ্য দিয়ে আসিফ জাহানের নামটা আড়ালেই রয়ে গেছে। ধারণা পর্যন্তই। হাতে কোনো প্রমাণ নেই। ঘাঁটাঘাঁটি করার রুচিও নেই। তবু সেই ধারণার বৃত্ত থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে না, খোঁচা দেয়,

একজনের সঙ্গেই এতক্ষণ!

কী মুশকিল, ছাড়ছিল না যে!

ছাড়ছিল না?

তোমার মতো কথার কাঙাল তো সবাই নয়! অনেকের অনেক রকম কথা থাকে।

আমিও তো সেটাই জানতে চাইছি- ওই অনেকের মধ্যে আর কে কে আছে?

এই তো তোমার দোষ! সত্য খুঁজতে চাও, অথচ সত্য সহ্য করতে পারো না।

হা হা করে হেসে ওঠে রকিব। হাসতেই থাকে। বুলবুলি কুপিত হয়,

হাসির কী হলো এমন!

সহসা হাসির মুখে লাগাম কষে রকিব শুধায়।

সবার সঙ্গে তোমার হাতাপাতা হয়?

কী হয়? চিৎকার করে ওঠে বুলবুলি। রকিব মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেয়, তারপরও বুলবুলির কল আসতেই থাকে বারংবার। অবশেষে সুইচটাই অফ করে দেয় রকিব। ফস করে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরায়। হু হু করে ধোঁয়া ছাড়ে আর ভাবতে বসে- এটা কী হলো! গল্পের ভেতর থেকে ওই শব্দটি এভাবে উঠে এলো কেন?

সেদিন রকিবের বাসায় ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। মে-জুন মাসে কাজের চাপ এই রকমই হয়। দশটা-পাঁচটার অফিস রুটিন কোথায় মুখ লুকায় তার ঠিক নেই। কিসের পাঁচটা, সাতটা আটটা নটা পর্যন্ত পেরিয়ে যায়। রকিব সন্ধ্যা থেকেই শুরু করেছে বুলবুলিকে ফোন করা। ফোনের রিংটোন বেজে বেজে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে ধরছে না। এই যে ফোন না ধরার কত রকম মানে হতে পারে তার ঠিক আছে! দুপুরে বুলবুলিও ফোন করেছিল বেশ কয়েকবার, তখন প্রচ- ব্যস্ততা রকিবের, এক মিনিটের মধ্য ফোন রিসিভ করাও ছিল অসম্ভব প্রায়; সকালবেলার হাতাপাতা প্রসঙ্গ মনে পড়ায় নিজের ভেতরে বিব্রতবোধ জেগে ওঠে আর তক্ষুণি পকেট থেকে ফোন বের করে বুলবুলির নম্বরে কল দেয়। আকাশে তখন প্রবল মেঘগর্জন, বিদ্যুৎ ঝাপটায় চমকে উঠছে রাতের দিগন্ত; বুলবুলি ফোন রিসিভ করতে পারে না। রিংটোনের শব্দ যেন বা প্রকৃতির বিচিত্র শব্দরাজির সঙ্গে মিলেমিশে অপূর্ব সিস্ফনি রচনা করে। দুজনের কেউই পরস্পরের কণ্ঠ শুনতে পায় না।

রকিব যখন বাসায় ফেরে তখন চরাচর অন্ধকারে নিমগ্ন। ঝড়ের তান্ডবে গাছের ডাল-পালা ভেঙে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সন্ধ্যের পর থেকেই। থমথমে মুখে রকিব এসে দাঁড়ায় ফ্ল্যাটের দরজার সামনে। অভ্যেসমাফিক ডোরবেলের নবে আঙুল চলে যায়, আবার নিজের বোকামি টের পেয়ে বিব্রত আঙুল ফিরে আসে। নক করে কাঠের পাল্লায়। ভেতর থেকে সাড়া দিতে একটু সময় লাগে। এইটুকু সময়ের মধ্যেই রকিবের মাথার ভেতরে যেনবা হাতুড়ির ঘাই পড়ে, ডিজিটাল ঘড়ির কাঁটার মতো টিকটিক করে। ধৈর্যের কাঁটা দোল খায়, মধ্যবর্তী সূচকচিহ্ন থেকে হেলে পড়ে, তখনই সে পুনর্বার দরজার পাল্লায় নক করতে উদ্যত হয়, কিন্তু তার পূর্বেই দুম করে খুলে যায় দরজার কপাট। একেবারে সঙ্গে সঙ্গে (যুগপৎভাবেও বলা চলে) অন্ধকারে অপেক্ষমাণ রকিবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুলবুলি, প্রচ-ভাবে জাপটে ধরে, আঁকড়ে ধরে স্বামীকে। টকাস টকাস করে দুই গালে চুম্বনও এঁকে দেয়। তারপরও গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতেই থাকে, ঝুলেই থাকে নিরবলম্ব। এমন আগ্রাসী এবং আক্রমণাত্মক ভালোবাসার ঘায়ে রকিব প্রথমে এতটাই বিপর্যস্ত বোধ করে যে ওই মুহূর্তে তার করণীয় স্থির করে উঠতে পারে না। কাঁধের ঝুলন্ত নারীদেহ নিয়ে ঘরে ঢুকতেই অন্য রকম ভালো লাগায় জুড়িয়ে যায় সারা অন্তর। বিদ্যুৎ নেই, ঘরের মধ্যে জ্বলছে মোমবাতি। মোমের আলো যে এত নরম স্লিগ্ধ কমনীয়, তা যেন কখনো জানা হয়নি। সেই আলো এসে বুলবুলির মুখমন্ডলকে উদ্ভাসিত করে তুলেছে অন্য উজ্জ্বলতায়। খানিক আলোকিত আর খানিক অনালোকিত বুলবুলির এই মুখচ্ছবি যেনবা আগে কখনো দেখেনি সে। কী অপরূপ! চোখ ফেরানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। রকিব এরই মধ্যে ভাবতে চেষ্টা করে, বুলি কি কোনোভাবে হাতাপাতা শব্দের অর্থ জেনে ফেলেছে? দেড় বছরের বিবাহিত জীবনে এরকম শঙ্খলাগা আচরণ কবে দেখেছে সে কথা মনে করার চেষ্টা করে। ওই অবস্থায় তারা শোবার ঘরের খাটের ওপরে গড়িয়ে পড়তেই রকিবের কানের কাছ মুখ এনে বুলবুলি কুটুস করে কামড়ে দেয় কানের লতি, রকিবের কণ্ঠে বলক দিয়ে ওঠে শীৎকারধ্বনি-        

উহু!

বুলবুলির আলাজিহ্বা পর্যন্ত লক লক করে। রকিবের মুখের উপরে উষ্ণ নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দু’বাহুর বন্ধনে বন্দি রকিবকেই বলে সে,

মনীষার কথা এতদিন আড়াল করেছ কেন সোনা!

কী যেন এক ইলেকট্রিক শক রকিবের দেহ থেকে সব রক্ত শুষে নেয়। স্পন্দনহীন কেটে যায় কয়েক সেকেন্ড। অতি দ্রুত নিজেকে সামলে রকিব আবারও উষ্ণ হতে চেষ্টা করে, তার ডান হাতের পাঁচ আঙুল চষে বেড়ায় বুলির বুকের উপত্যকা। বাধা দেবার বদলে বিকট এক বোমা ফাটানো প্রশ্ন শুধায় বুলি,

আচ্ছা সোনা, সত্যি বলো তো- তোমার হাতের মুঠোয় তুমি কি এখন মনীষার শরীরের অনুভূতি পাও?

চড়াইয়ের খাঁড়িতে দাঁড়িয়ে পড়ে রকিবের হাতের পাঁচ আঙুলের লাঙল।

গভীর জলের মাছ শিকারির মতো হুইলের সুতো ঢিল দিতে দিতে বলে, মনীষা সম্পর্কে একদিনেই এত কথা জানলে কী করে?

আহা, তুমি তো কিছুই বলোনি আমাকে! এই তোমার সত্যব্রত!

সারপ্রাইজটুকু জমিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু হাটে হাঁড়ি ভাঙল কে বলো তো!

কেন, তোমার সিটিসেল মোবাইল!

রকিবের এই মোবাইল সেটটি পরিত্যক্তই বলা চলে। চার্জ দেওয়া হয় না সময়মতো, সঙ্গে নিতেও মনে থাকে না সব সময়, তবু দু-একজন পুরনো সঙ্গী সাথী মাঝে মধ্যে ওই নম্বরে খোঁজে বলে ওটাকে একেবারে ত্যাগ করাও হয়ে ওঠেনি। হ্যাঁ, এই নম্বরটির বাইরে অন্য কোনো নম্বর তো মনীষার জানার কথা নয়। সিটিসেল কোম্পানির এক জোড়া ফোন তারা একই সঙ্গে কিনেছিল সাশ্রয়ী রেটে অনবরত কথা বলার জন্য। হায় কথার বলাকা, উড়ে গেছে কত দূরে! আজ বুঝি তার সময় হলো কথা বলার! বুলবুলি সেই কথা সুন্দর করে গুছিয়ে বলে, তোমার মনীষা তো ভারি মজার মানুষ! আমি তোমার স্ত্রী- এ পরিচয় জানার পরও কত সহজে বলতে পারে সে তোমার প্রাক্তন প্রেমিকা! বাব্বা কত কথা যে জমেছিল তার পেটে!

সব তোমাকে বলল, আর তুমি শুনলে কান ভরে? রকিবের চোখে বিস¥য়।

শুধু কান ভরে কেন, শুনেছি প্রাণ ভরে। কত যে প্রশংসা করল তোমার!

বলো কী আমার প্রশংসা তোমার কাছে! মনীষা করেছে?

হ্যাঁ, এখন থেকে সে আমার সাথেই কথা বলবে বলেছে।

সেই জন্যে তুমি আমার ফোন ধরোনি সারাদিন?

সকালে কী একটা কথা শেষ না হতেই ফোন কেটে দিলে যে! রাগ হবে না!

বুলবুলির বক্ষলগ্ন হয়ে রকিব শুধায়- সেই কথাটা এখন বলব?

না। আমি আর কোনো কথা শুনব না।

আসিফ জাহানের কথা বলবে না?

বুলবুলির দৃঢ় প্রত্যয়ী উত্তর- না। এই ‘না’ উচ্চারণের পর সে পুনরায় আগ্রাসী হয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরে রকিবকে। চুম্বনে চুম্বনে উত্তাপ ছড়ানোর সে কী ব্যাকুলতা। রকিবও ভাবে সকাল বেলায় শেখা ‘হাতাপাতা’ শব্দটির অর্থ মুখে বলার চেয়ে কাজে প্রমাণ হওয়াই ভালো। হাতাপাতার আনন্দ-শীৎকারের আড়ালে ঢাকা পড়ুক মনীষা কিংবা আসিফ জাহান। কিন্তু এ কী বিভ্রম! এ কী অধ্যাস! তার রমণক্লান্ত শরীরের তলে এ কি এক তাল নিরেট কাদামাটি, নাকি কানাডা প্রবাসী মনীষার দেহবল্লরী! রকিব যেন কানখাড়া করে এখনো শুনতে পায় দূরাগত মূর্চ্ছনা- ‘প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর...’

অথচ কোথাও এক ফোঁটা হাস্নুহেনার ঘ্রাণ খুঁজে পায় না রকিবের নাসারন্ধ্র।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর