শেকসপিয়রকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। গত চার শ বছর ধরে তাঁকে নিয়ে এত লেখা, এত বলা হয়ে গেছে যে, এখন কিছু বলতে গেলে তা চর্বিত চর্বণ হয়ে যাবে। তবু বিশ্বনাটকের কথা বলতে গেলে যার নাম প্রথম উচ্চারিত হয়, তিনি শেকসপিয়র। উইলিয়াম শেকসপিয়র ১৫৬৪ সালের ২৩ এপ্রিল ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র অর্ধশতাব্দী জীবনকালে তিনি ৩৮টি নাটক, ১৫৪টি সনেটসহ দুটি দীর্ঘ আখ্যায়িকা রচনা করেন। মূলত নাট্যকার হলেও তাঁর পরিচয় বার্ড অব অ্যাডন বা অ্যাডনের চারণ কবি হিসেবে।
নাট্যকারের চেয়ে কবি হিসেবে খ্যাতির কারণ তিনি কাব্যনাট্যকার। অভিনেতা হিসেবেও তিনি নাম করেছিলেন।
শেকসপিয়রের নাটকগুলো পৃথিবীর প্রধান সব ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা ভাষাভাষীদের কাছেও তিনি অপরিচিত নন।
মূলত, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তাঁর অধিকাংশ নাটক রচিত। কিন্তু তাঁর অতুলনীয় শিল্প সৌকর্য ও অমর কাব্যভাষার গুণে প্রতিটি নাটকই স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। শেকসপিয়র কেন ট্র্যাজেডি এবং কমিডি নাটকের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে রইলেন এ নিয়েও গবেষণা কম হয়নি। এ ব্যাপারে গবেষকদের অনুসন্ধানে জানা যায়, শেকসপিয়রের জীবনে যে অস্থিরতা, হতাশা এবং স্বজন বিয়োগের ঘটনা ঘটেছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর নাটকে। শেকসপিয়রের দাম্পত্য জীবন শুরু হয় একজন অসম বয়সি মহিলাকে বিয়ের মাধ্যমে, যার গর্ভে বিয়ের আগেই তাঁর সন্তান অঙ্কুরিত হয়েছিল। শেকসপিয়রের বয়স যখন ১৮ তখন তিনি ২৬ বছর বয়সি অ্যানি হ্যাথাওয়েকে বিয়ে করেন। বিয়ের ছয় মাস পর তাঁদের ঘরে এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়।
এরপর ১৫৮৫ সালে অ্যানি হ্যাথাওয়ে হ্যামলেট নামে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। ১১ বছর বয়সে শেকসপিয়রের পুত্রসন্তানটি মারা গেলে তিনি শোকে মুষড়ে পড়েন।
১৫৮৫ থেকে ১৫৯২ সাল পর্যন্ত সাতটি বছর ছিল শেকসপিয়রের হারানোর বছর, অথচ এই বেদনাহত বছরগুলোতেও তাঁর সৃষ্টিকর্ম থেমে থাকেনি। নাট্যকারের সঙ্গে অভিনেতার খ্যাতিও এ সময় তিনি অর্জন করেন।
শেকসপিয়র নাট্যকার, অভিনেতা এবং কবি অভিধার সঙ্গে সিয়েটার কোম্পানির স্বত্বাধিকারীও ছিলেন। ১৬১৩ সালে তিনি নাট্যজগৎ থেকে স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। আর এরপর তিন বছরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন।
শেকসপিয়রকে নিয়ে গত চার শ বছরে প্রচুর লেখালেখি হলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথা খুব বেশি আলোচিত হয়নি।
তিনি ধর্মবিশ্বাসে ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলেও তাঁর জীবনযাপন এবং পিতা-মাতা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়গুলো অনুল্লেখ্য থেকেছে প্রায় সব আলোচনায়।
এমনকি শেকসপিয়রের নামে যেসব নাটক প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো সব যে তাঁর লেখা নয়, কোনো কোনো আলোচক এ প্রসঙ্গটি টেনে আনলেও এর তথ্যগত সমাধান দেননি।
তবে শেকসপিয়রকে নিয়ে যত সমালোচনার ঝড় উঠুক, আর তাঁর নাটক নিয়ে যত বিতর্কেরই সৃষ্টি হোক না কেন, ভিক্টোরিয়ান যুগে তিনি যেমন পূজনীয় ছিলেন এখনো তেমনি প্রাণবন্ত এবং প্রাসঙ্গিক আছেন। এর কারণ হলো শেকসপিয়রের সাহিত্যকর্মে অসামান্য পর্যবেক্ষণ প্রক্ষেপণের সক্ষমতা। তাঁর নাটক এবং কবিতাগুলো যেন নিজের মধ্যে ধারণ করে পরিবেশন করেছেন। তিনি একই সঙ্গে যেমন অভিনেতা, নাট্যকার এবং ব্যবসায়ী ছিলেন, তাঁর সাহিত্যকর্মেও এসব চরিত্রের সমাবেশ দেখা যায়। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সংমিশ্রণে তিনি নিজেই শুধু কালজয়ী পুরুষ হয়ে ওঠেননি-কালজয়ী সাহিত্যকর্মও সৃষ্টি করে গেছেন।
আমরা এখানে শেকসপিয়রের সমগ্র নাটক নয়, গোটা কয়েক নাটক নিয়ে আলোকপাত করব। এ নাটকগুলো ১৫৯৫ থেকে তাঁর মৃত্যুর আগের বছরগুলোতে লেখা। উল্লেখ্য, শেকসপিয়র ১৬১৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে শেষের দুই বছর তিনি কোনো নাটক রচনা করেননি। অভিনয়ও করেননি।
তিনি ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান। ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা ছিল ইংল্যান্ডের রক্ষণশীল এবং একটি ধর্মীয় আচার পালনে কড়াকড়ি করা গোষ্ঠী। এই সম্প্রদায়ের লোকেরা চার্চে অনুপস্থিত থাকলে জরিমানা করা হতো।
শেকসপিয়রের পিতাকেও জরিমানা করা হয়েছিল। ফলে শেকসপিয়র ক্যাথলিক চার্চের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে প্রেটেস্ট্যান্ট চার্চের অনুসারী হয়ে যান। গবেষকরা মনে করেন, তাঁর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি নিজস্ব চিন্তাধারায় চলতেন। বিশেষ কোনো মতবাদ বা ধর্মের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল না বললেই চলে।
১৬০০ সালে রেজিস্ট্রারিভুক্ত A mid summer nights Dream নাটকটি রচিত হয়েছিল মূলত আমাদের দেশের যাত্রাপালার আদলে। নাটকের দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে জানা যায়, নাটকটি লেখা হয়েছিল বিয়েবাড়িতে আনন্দ অনুষ্ঠানের জন্য।
নাটকটির কাহিনি মনোমুগ্ধকর হলেও এটা শেকসপিয়রের মৌলিক নাটক নয়; কারণ আখ্যানটি তাঁর নিজস্ব নয়। বিভিন্ন লেখকের লেখা থেকে তিনি নিজস্ব আদলে একটি আখ্যান তৈরি করেছেন। শেকসপিয়রের এ নাটকটি প্রথম প্রথম অনেক পণ্ডিত এবং রাজমহলের আমজনতা নিঃসংকোচে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁরা মনে করেছিলেন এতে অশ্লীলতা আছে। পরবর্তীতে তাঁদের এ ধারণা বদলে যায়। পরবর্তী সময় সমালোচকরা এর প্রশংসা করেছেন। শেকসপিয়রের কমিডি বুঝতে ইংল্যান্ডবাসীর এত সময় নেওয়ার কারণ আজও গবেষণার বিষয়।
শেকসপিয়র ‘উইন্টারস টেল’ রচনা করেন ১৬১০-১২ এর মধ্যে।
সিসিলিয়ার রাজা লিওন্টাস এবং রানী হার্মিয়োর মধ্যে অবিশ্বাসের অহেতুক চিন্তা থেকে এ নাটকের বিস্তার। রানী অনৈতিক কোনো কাজ না করেও রাজার চোখে বিশ্বাসঘাতকিনী এবং কুলটা বলে সাব্যস্ত হন। বোহেমিয়ার রাজাকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দায়ী করেন। রানীর কারাবাস হয় এবং কারাগারে রানী একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। মেয়েটির নাম রাখা হয় পার্ডিটা। যাকে জন্মের পরই সমুদ্রতটে ফেলে দেওয়া হয়। কন্যাটিকে মেষশাবকরা প্রতিপালন করে। এরপর শুরু হয় নাটকের নতুন মোড়। শেষে পার্ডিটার রাজা আর রানীর সঙ্গে মিলন হয়। নাটকটিতে পুনর্মিলন, রোমান্স, উচ্ছ্বাস এবং আনন্দ থাকলেও এর কাহিনি বিন্যাস এমনই বিষাদময় যে, বিষাদের ছায়ায় আনন্দ হারিয়ে যায়।
শেকসপিয়রের ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডিক নাটক। এ নাটকে শেষ পর্যন্ত হেনরির করুণ মৃত্যু এবং ফলস্টাফের কারাবরণ নাটকটিকে বিষাদময় করে তোলে।
শেকসপিয়রের সবচেয়ে আলোচিত ট্র্যাজেডি নাটক হচ্ছে হ্যামলেট। এই নাটকটির কাহিনিও শেকসপিয়রের নিজস্ব নয়। নানা সূত্র থেকে সংগৃহীত। ঐতিহাসিক ম্যাক্সের ল্যাটিন ভাষায় রচিত ডেনমার্কের রাজাদের বিবরণ থেকে তিনি এর মূলভাব সংগ্রহ করেছেন। হ্যামলেটের আখ্যানটি Historie of Hamlet Prince of Denmarke - এ যেভাবে পাওয়া যায় তা এরকম-
রাজপুত্র হ্যামলেটের পিতাকে চক্রান্ত করে তার ছোটভাই ক্লডিয়াস। হ্যামলেটের মা গারট্রুডকে বিয়ে করেন তিনি। রানী গারট্রুড স্বামীঘাতক দেবরকে বিয়ে করতে বাধেনি। ক্লডিয়াস হ্যামলেটের রাজ্য থেকে বিতরণ ও বিনাশ করার নানা ষড়যন্ত্র করে কিন্তু সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত হ্যামলেট ক্লডিয়াসকে হত্যা করে এরপর সে নিজেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মারা যায়।
শেকসপিয়র এই কাহিনিটিই তাঁর হ্যামলেট নাটকে গ্রহণ করেছেন, শুধু রানীর চরিত্রটি ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। হ্যামলেটের জননীর চরিত্রে নতুনভাবের আমদানি করে শেকসপিয়র এটাকে সম্পূর্ণ নতুন অবয়ব দিয়েছেন। আর শেকসপিয়র বিশ্বে আলোচিত হয়েছেন তার এই অমর নাটকটির জন্য। অবশ্য শেকসপিয়রের অন্যান্য নাটকও যে তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতির পেছনে অবদান রাখেনি, তা কিন্তু নয়। তবে হ্যামলেটের দ্যুতি ও খ্যাতির কাছে সেগুলো ম্লান। সমালোচকরা বলেছেন মনোজগৎ এবং বহির্জগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতা নয় বরং অদেখা সক্ষমতাই এই নাটকটির প্রতি দর্শককে দুর্বল করে দেয়। কর্তব্য আবেগ দ্বিধার মধ্যে সংশয় এবং নাটকের শেষ পরিণতি মানবজীবনের বাস্তব নিয়তির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই সমালোচকদের ধারণা হ্যামলেটের অন্তর্নিহিত ভাবনা শুধু হ্যামলেটের ভাবনা নয়, এর সঙ্গে নাট্যকারের নিজস্ব ভাবনাও একাকার হয়ে গেছে। এক সুগভীর রহস্যবোধ স্বতন্ত্র জীবনদর্শন এ নাটকটিকে অনন্য করেছে।
শেকসপিয়রের আর একটি প্রথম দিকে লেখা কমিডি হলো ‘লাভস লেবারস লস্ট’। এখানেও রাজা এবং লর্ডদের প্রতিজ্ঞা। নাভারারের রাজা এবং লর্ডগণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তারা তিন বছর বিদ্যা অর্জন করবেন এবং ওই সময় কোনো নারীর মুখ দেখবেন না। এমনকি কোনো নারীর সঙ্গে মুখ ঢেকে কথাও বলতে পারবেন না।
তাদের এই প্রতিজ্ঞা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি। কারণ ফ্রান্সের রাজকুমারী আর তার দুই সখীকে দেখার পর রাজা আর লর্ডগণ তাদের অজান্তেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন। কিন্তু কেউ স্বীকার করতে চাননি যে তারা শপথ ভেঙেছেন। শেষ পর্যন্ত, তারা বুঝতে পারেন এটা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ নয়, ভালোবাসা, ফরাসি রাজকুমারী আর দুই সখী রাজা আর লর্ডদের বশ করে ফেলেছেন। ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা নাটকটি যখন প্রকাশিত হয়, তখন এটি নিয়ে বিতর্ক ওঠে নাটকটি শেকসপিয়রের রচনা কিনা? এর কারণ হলো, ডেকর এবং চেটল চ্যাপমানের শেকসপিয়রের নাটকের ওপর কলম চালানোর ফল।
অবশ্য এ কথাও অনেক সমালোচক বলে থাকেন যে, ‘Troillus and cressida’ শেকসপিয়রের লেখাই নয়, এটা তাঁর নামে চালানো হয়েছে। সমালোচকদের এ দাবির কোনো জোরালো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে ‘Troillus and cressida’র মূল কাহিনি হচ্ছে রাজপুত্র ট্রয়লাস এবং পুরোহিতকন্যা ক্রেসিডার প্রণয় এবং ব্যর্থতা। ক্রেসিডা ট্রয়লাসের ভালোবাসার মূল্য না দিয়ে গ্রিক যুবককে প্রেমিক হিসেবে গ্রহণ করে শুধু ভালোবাসার অমর্যাদা করেনি, বিশ্বাসভঙ্গও করেছে। এই নাটকে কিছু লঘু এবং অনাবশ্যক ঘটনার সমাবেশ ঘটায়, নাটকটি শেকসপিয়রের অন্যান্য নাটকের মতো তীব্র এবং ধারালো হয়নি।