আকাশটা আজ মেঘদূতের মনের মতোই থমথমে। শ্রাবণের এক নিস্তব্ধ দুপুর, অথচ মেঘের নিবিড় ভারে যেন সন্ধ্যা নেমেছে চরাচরে। জানালার বাইরে বৃষ্টির আয়োজন চলছে। ঘরের ভিতরটা আরও অন্ধকার, আরও নিবিড়। অবিন্যস্ত বইয়ের তাকগুলোতে পড়েছে ধুলোর কোমল আস্তরণ, টেবিলে পড়ে থাকা সাদা পাতাগুলো যেন একরাশ শূন্যতা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মেঘদূত, এক সময়ের সাড়া জাগানো কবি, আজ শব্দের কারবার থেকে বহুদূরে এক স্বেচ্ছানির্বাসিত নাবিক। তার কলম এখন আর কবিতা লেখে না, লেখে জীবনের নীরস প্রয়োজন।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দটা শীতল স্রোতের মতো শিরশির করে বয়ে গেল তার শিরায়-উপশিরায়। এই অসময়ে কে আসতে পারে! এই নির্বাসনের জীবনে তো কোনো অভ্যাগত নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দরজা খুলতেই তার পৃথিবীটা যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার বুকের ভিতর শত শত ভাঙা কাচের টুকরো যেন ঝনঝন করে উঠল।
বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অন্বেষা। শ্রাবণের প্রথম বৃষ্টির কণা তার চুলে, কপালে মুক্তোর মতো জমেছে। ভেজা শাড়ির আঁচলটা আলতো করে গায়ে জড়ানো। সেই মায়াবী চোখ, সেই শান্ত মুখ, সময়ের ধুলো যাকে এতটুকুও ম্লান করতে পারেনি। মেঘদূতের মনে হলো, সময় যেন ঘড়ির কাঁটা উল্টো ঘুরিয়ে দিয়েছে। যে মুখটা সে রোজ কল্পনাতে আঁকত, আজ তা বাস্তব হয়ে তার দরজায়!
মেঘদূতের ঠোঁট কাঁপছিল। অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল, “অন্বেষা! তুমি?”
অন্বেষা মৃদু হাসল। সে হাসিতে হাজারও না-বলা কথা ভিড় করে ছিল। ‘কবি সাহেব!’
মেঘদূতের মনে হলো, এই ডাক শোনার জন্য সে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারে। এই ডাকটা শুধু অন্বেষারই ছিল। সে নিজেকে সামলে নিয়ে, একরাশ অভিমান গলায় জড়িয়ে বলল, ‘পথ ভুল করে, আজ ভুল দুয়ারে এলে যে!’ কথাটা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর নিজের কাছেই অচেনা লাগল। তাতে ছিল বিস্ময় আর এক সমুদ্র চাপা কষ্ট।
“তোমার মুখে ‘কবিতা’ ডাক শুনি না অনেকদিন, সেই লোভেই হয়তো আসা!” অন্বেষার উত্তরটা ছিল বাতাসের মতো সহজ, কিন্তু তার গভীরতা ছিল অতলান্ত।
মেঘদূত এক শুকনো, বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল। “হা হা হা। হাসালে ভীষণ! যে বাগানের মালি নিজেই আজ আর মালি নয়, সেখানে ফুলের আশায় আসাটা কি বাতুলতা নয়?”
অন্বেষা ধীর পায়ে ভিতরে প্রবেশ করল। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে তার বুকটা হাহাকার করে উঠল। ঘরটার অযত্ন, বইগুলোর নীরব কান্না তার চোখ এড়াল না। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে মেঘদূতের লেখার টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ধুলোমাখা কলমটার দিকে তাকিয়ে বলল, “কবিতা কি কবির খোঁজে আসতে পারে না!”
এই একটি প্রশ্নে মেঘদূতের ভিতরের সব প্রতিরোধ, সব অভিমানের দেয়াল হুড়মুড় করে ভেঙে গেল। সে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। দুহাতে মুখ ঢেকে বলল, “আসতে পারে! তবে সময় থাকতে সঠিক দরজায় কড়া নাড়তে না পারা, আর ভুল দুয়ারে এসে দাঁড়ানো- দুটোই কখনো সুখের হয় না। দরজার কড়া নাড়ার শব্দ যখন মিলিয়ে যায়, তখন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকাটা কেবলই শূন্যতার মঞ্চায়ন।” মেঘদূত মুখ তুলে অন্বেষার দিকে তাকাল। তার চোখে ছিল একরাশ অনুশোচনা। “এই যে, কথায় কথায় ‘সুখের’ আগমন। বড্ড জানতে ইচ্ছা করে, যে সুখের আশায় পাড়ি দিলে সহস্র মাইলের পথ, সে সুখ কি পেলে!”
প্রশ্নটা ছিল একটা ধারালো ছুরির ফলার মতো। অন্বেষা জানত, মেঘদূত তাকেই দোষারোপ করছে। কিন্তু সে শান্ত রইল। তার কণ্ঠ আরও কোমল, আরও আর্দ্র শোনাল। “সুখের কথা-ই যদি বলি, তবে তোমার স্মৃতি বুকে পুষে হাজারও জনম পার করা কি যায় না! সুখ তো আপেক্ষিক, মেঘদূত। তুমি চেয়েছিলে নিশ্চিত জীবন, আর আমি চেয়েছিলাম তোমাকে। আমাদের চাওয়াটা এক সরলরেখায় মেলেনি।”
মেঘদূতের মনে পড়ল সেই দিনগুলোর কথা। যখন সে ছিল এক উঠতি কবি। তার কবিতায় আগুন ছিল, অন্বেষার চোখে ছিল স্বপ্ন। ভাড়া বাড়ির এক চিলতে ছাদে বসে তারা রাতকে ভোর করত। মেঘদূত কবিতা শোনাত আর অন্বেষা তার চুলে বিলি কেটে দিত। অন্বেষাই ছিল তার কবিতার প্রাণ, তার প্রতিটি শব্দের অনুপ্রেরণা।
কিন্তু জীবন শুধু কবিতায় চলে না। বাস্তবতা কঠিন পাথরের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল। মেঘদূত এক প্রকাশনীর মোটা মাইনের চাকরিতে ঢুকেছিল। যে কলম লিখত প্রেম আর বিপ্লবের কথা, সে কলম লিখতে শুরু করল বাজারের কাটতি হওয়া সস্তা উপন্যাস, বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন। সে নিজেকে বুঝিয়েছিল, অন্বেষার জন্যই এই স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।
একদিন অন্বেষা বলেছিল, “মেঘদূত, তোমার কবিতাগুলো কেমন প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে। তোমার ভিতরের কবি সত্তাটাকে তুমি নিজের হাতে হত্যা করছ!”
মেঘদূত সেদিন চিৎকার করে উঠেছিল, “কবিতা দিয়ে পেট ভরে না, অন্বেষা! এই শহরের বুকে একটা ছাদ লাগে, দুটো ভাত লাগে। আমি তোমার জন্য একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়তে চাই।”
“আমার ভবিষ্যৎ তো তোমাতেই ছিল, তোমার কবিতায় ছিল,” অন্বেষার ভেজা কণ্ঠ সেদিন মেঘদূতের কানে পৌঁছায়নি। ব্যস্ততার অহংকারে সে বধির হয়ে গিয়েছিল।
ধীরে ধীরে তাদের মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল উঠে গেল। মেঘদূত টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে এতটাই যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল যে, সে টেরই পায়নি কখন অন্বেষা নামের কবিতাটা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। যেদিন অন্বেষা এক টুকরো চিঠি লিখে চলে গিয়েছিল সেদিন মেঘদূত প্রথম বুঝেছিল-সে ছাদ পেয়েছে, কিন্তু আকাশটা হারিয়ে ফেলেছে।
আজ এতদিন পর অন্বেষাকে সামনে দেখে তার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করছিল। সে দেখছিল, অন্বেষার চোখে সেই পুরনো মায়া থাকলেও তাতে এখন যোগ হয়েছে এক গভীর প্রশান্তি, যা মেঘদূতের নেই।
মেঘদূত উঠে দাঁড়াল। অন্বেষার কাছাকাছি গিয়ে তার হাতটা ধরতে গিয়েও পারল না। একরাশ দ্বিধা তাকে থামিয়ে দিল। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি জানি, আমি ভুল করেছিলাম, অন্বেষা। আমি সোনা খুঁজতে গিয়ে হীরা হারিয়ে ফেলেছি। আমি কবি ছিলাম, তোমার ভালোবাসায়। আজ আমি শুধু একজন শব্দশ্রমিক।”
তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। সে বহু বছর পর আবার কবিতার ভাষায় কথা বলল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো-
“হারানো পথের ধুলোয় মেশে, হারানো দিনের সুর,
তোমার চোখের কাজলে ভাসে, আমার অচিনপুর।
স্মৃতির পাতায় আঙুল ছোঁয়ালেই, সময় থমকে যায়,
এখন আমার একলা আকাশ, মেঘে মেঘে হারায়,
যে নদীটা মরে গেছে বুকে, তার আর কীসের ভয়?
বলো, অন্বেষা, এই জীবনের কী আর পরিচয়?”
কবিতাটা শুনে অন্বেষার চোখ ছলছল করে উঠল। সে বলল, “তোমার কবিসত্তা এখনো মরেনি, মেঘদূত। সে শুধু ঘুমিয়ে আছে। অভিমান করে আছে।”
মেঘদূত ব্যাকুলভাবে বলল, “তবে তাকে জাগিয়ে দিয়ে যাও, অন্বেষা। একবার, শুধু একবারের জন্য আমার জীবনে ফিরে এসো। আমার এই ভুল দুয়ারকে সঠিক করে দিয়ে যাও। আমি সব ছেড়ে দেব, সব কিছু। শুধু তোমায় আর আমার কবিতাকে নিয়ে বাঁচব।”
তার আকুতিতে ঘরটার নিস্তব্ধতা আরও ভারী হয়ে উঠল। বাইরে তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। অন্বেষা জানালার দিকে তাকাল। কাচের গায়ে বৃষ্টির ধারা, যেন তার মনের ভিতরের কান্না।
সে ঘুরে দাঁড়াল। মেঘদূতের দিকে তাকিয়ে স্নিগ্ধ কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, “কিছু কিছু ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না, মেঘদূত। আর কিছু কিছু পথ একবার হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তুমি যখন তোমার জগৎ গোছাচ্ছিলে, আমি তখন আমার একার জগৎ তৈরি করতে শিখে গেছি। সেখানে তুমি আছো, তবে শুধু স্মৃতি হয়ে। বাস্তবে নয়।”
মেঘদূতের মনে হলো তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। সে অস্ফুটে বলল, ‘তার মানে?’
“আমি এসেছিলাম শুধু দেখতে, আমার কবি কেমন আছে। তার ভিতরের আগুনটা কি পুরোপুরি নিভে গেছে, নাকি এখনো ধিকিধিকি জ্বলে। এসে দেখলাম, ছাইচাপা আগুন এখনো আছে। আমার আসাটা সার্থক।” অন্বেষা দরজার দিকে এগোল।
মেঘদূত মরিয়া হয়ে বলল, “যেয়ো না, অন্বেষা! মিনতি করি... তুমি ছাড়া আমি যে একটা সুতো ছেঁড়া ঘুড়ি। কোথায় যাব, কার আকাশে উড়ব?”
অন্বেষার মুখে এবার এক বিষণ্ন, সুন্দর হাসি ফুটে উঠল। “সুতো ছিঁড়ে গেলে ঘুড়ি ফেরে না, জানে বাতাস শুধু। সে শুধু উড়তে উড়তে হারিয়ে যায়। তুমিও উড়বে, মেঘদূত। তবে এবার নিজের আকাশে। তোমার কবিতাগুলোই হবে তোমার আকাশ।”
সে আর দাঁড়াল না। দরজা খুলে বৃষ্টির মাঝে মিলিয়ে গেল। যাওয়ার আগে শুধু বলে গেল, “অপ্রাপ্তিটাও মাঝে মাঝে খুব সুন্দর হয়, কবি। ওটা থেকেও দারুণ কবিতা জন্মায়।”
মেঘদূত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল, এক পশলা কবিতা হয়ে অন্বেষা তার জীবনে এসেছিল এবং তাকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিয়ে আবার মেঘের দেশে মিলিয়ে গেছে। সে জানত, অন্বেষা আর ফিরবে না। এই অপ্রাপ্তি, এই তীব্র শূন্যতাই এখন তার জীবনের একমাত্র সত্যি।
সে টলতে টলতে তার লেখার টেবিলে ফিরে এলো। ধুলোমাখা কলমটা তুলে নিল। সাদা কাগজের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। এক ফোঁটা জল পড়ল কাগজের ওপর, তারপর আর এক ফোঁটা।
অনেক বছর পর, তার কলমের ডগা থেকে কালির সঙ্গে মিশে বেরিয়ে এলো কয়েকটি লাইন। এবার আর কোনো সস্তা বাজারের জন্য নয়, শুধু তার হারিয়ে যাওয়া অন্বেষার জন্য, তার অনুশোচনার জন্য, তার অপূর্ণ ভালোবাসার জন্য।
“সুতো ছিঁড়ে গেলে ঘুড়ি ফেরে না, জানে বাতাস শুধু,
পোড়া কাগজের ছাই ওড়ে জানি, হয় না তো ফের বধূ।
যে দুয়ারে কড়া নাড়লে না আর, সে দুয়ারে কেন আসা?
অপ্রাপ্তিই হোক শেষ কবিতা, আমার ভালোবাসা।”
বাইরে বৃষ্টি তখনো পড়ছে। ঘরের ভিতর একজন কবি তার শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে কষ্টের কবিতাটি লিখছিল। যে কবিতার প্রতিটি শব্দজুড়ে ছিল এক নারীর ছায়া, যার নাম ‘কবিতা’, কিন্তু আর কখনো হয়তো কবিতা কবির হবে না। ভালোবাসা মাঝে মাঝে এভাবেই ভাঙে আর গড়ে। এক ভাঙা হৃদয় নিয়ে সৃষ্টি হয় অমর কোনো শিল্প।