কে প্রথম দেখেছে সেটা বড় কথা নয়।
এটা যে একটা মস্ত ঘটনা, যাকে বলে ধুন্ধুমার ব্যাপার, সেটা ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারেনি মজিদ।
সাতসকালে অভ্যাসের দোষে সে পায়লাহারা নদীর চরে নেমে পেট খালাসের উদ্যোগ নিয়েছে কেবল, হঠাৎ চোখে পড়ল মাঝ-নদীতে ভাটার টানে ধীরলয়ে ভেসে আসছে একখানা মস্ত গাছের টুকরো।
একটু নিরিখ করলে বুঝি স্পষ্ট হয় ভেসে থাকা ওই গাছের লম্বাটে থুতুনির দুটি চোখ, নাকের ডগা, এইটুকু পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট।
বনেবাদাড়ের নোনাপানির নুনে বাড়ন্ত চোখের দীপ্তিতে ঠিকই সে ঠাউরে নেয় আসল রহস্য।
যে কারণে ভোরের শীতল হাওয়ায় ঢেউ গুনে হাগার বদলে তিড়িং করে ভোঁ দৌড়ে লাফিয়ে ওঠে বেড়িবাঁধের ওপর- ‘ওরে তোমরা কেডা কোম্মে আছো, মোগো গাঙে কুমইর আইচে। এই অ্যাত্তর লম্ফা, রাক্কসের নাহান, হকলডিরেই গিল্লা খাইবেনে কইলাম।’
সাতসকালে মজিদের এমত দিকহারা আহাজারিতে ঘুম ভাঙে ধানসাগর গাঁয়ের পেটেখিদে মানুষের।
এমনি নাচুনে বুড়ি, তায় ঢোলে বাড়ি- আর যদি ঢোলটা থাকে মজিদের মতো একজন জগাখচা জাউলার কাঁধে, তখন তা সহজে থামার কোনো লক্ষণ নেই। বরং ঢোলের ঘা-টা আরও নির্মম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে নোনা হাওয়ার দিগি¦দিক ফিসফিসানিতে।
কমান্ডার সাহেবের শরীর মন্দ।
রাতভর কাশির উৎপাতে ঘুম জাহান্নাম হয়ে যায়।
সকালের দিকে একটু তন্দ্রা এসেছে কেবল, এমন সময় হাওলাদার বাড়ির ময়েজ আর তুজাম্বর তড়বড় করে হামলে পড়ল পুরান বাড়ির চৌচালা ঘরের দরজায়- ‘অ দুদু, দুদু, গাঙে কুমইর আইচে। শিগগির বন্দুক লইয়া ওইডারে খতম করেন। নাইলে সব্বোনাশ অয়ে যাবেনে!’
নদীর কাছে তখন বড় জটলা জমে গেছে। আছড়ে পড়া জনমনিষ্যি ভিড়ে চুপিচুপি নাকছাবি বউঝিরাও এসে দাঁড়িয়েছে এক হাত ঘোমটা টেনে।
তাদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের জোয়ারে শামিল হয়েছে রাজ্যির নাকশিওন হাগুমুতু পুলাপান আর এক দঙ্গল তিনমাথা বুড়োহাবড়ার দল।
মজিদ বকের মতো লম্বা পা ফেলে ফেলে গম্বুজলম্বু মাথা তুলে আঙুল উঁচিয়ে কুমিরটাকে দেখাল ঈদের চাঁদ দেখার মতো প্রবল উত্তেজনায়।
ভাটির টানে ওটা একটু সরে গেছে মূল স্রোত থেকে অদূরে। সকালের প্রথম রোদে নাকের চূড়াটা সহসা চিকচিকিয়ে উঠল।
এখন কী করা উচিত এ নিয়ে পরামর্শের শেষ নেই। আলোচনার তুফান লাফিয়ে উঠছে ছলাৎ ছলাৎ করে।
হাওলাদার, জমাদ্দার, মৃধা, খলিফা, গাজী, রাঢ়ী, শরীফ, মণ্ডল-সব মাথা জড় হয়ে রীতিমতো জনসভা বানিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু হাত উঁচিয়ে সেøাগান দেওয়া বাকি।
কমান্ডার বদরাগী মানুষ।
কাশুটে শরীরখানা ধনুকের মতো একটু নুয়ে বাঁকানো।
নদী কিনারে পৌঁছতেই মজমাটা প্রাণ পায় এতক্ষণে।
তাদের ছন্নছাড়া আজগুবি কথার বারুদে পানি ঢেলে দিয়ে সরু চোখে গর্জে ওঠেন কমান্ডার- ‘কই গেলিরে জলরাক্ষস? মোর লগে কুতুবগিরি! আয়, দেখি তোর কত্তো বড় সাহস...?’
এ ধরনের সাহসী কথাবার্তায় সবাই কুলকুলিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে একে অন্যের গায়।
সকালের ঝিলিক তোলা রোদে বন্দুকের নলের দিকে তাকিয়ে তারা আশ্চর্য এক শিহরণ অনুভব করে।
কমান্ডারের হাতের কঠিন টিপ নিয়ে এবার একটু গুঞ্জন ওঠে ভিড়ের ঘমার্ত বাতাসে। পাকিস্তান আমলে সুন্দরবনের হিরন পয়েন্টে পাগলা বাঘ মারার একখানা সত্যমিথ্যা গল্প চাউর হয়ে আছে এই নোনা তল্লাটে। সেই গল্পখানা পুনরায় পাখা গজানোর আগে একটু পর কী ভয়ানক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে এটা ভেবে অনেকের বুক ধুকুস করে উঠল।
কমান্ডার পিঠেসরা গাছের কাছে এক হাঁটুতে ভর দিয়ে বন্দুকের নিপুণ নিশানা বাগিয়ে দোনলা বন্দুকের ট্রিগারে চাপ দিলেন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে।
সকালের নিস্তব্ধতা ভেঙে আকাশ-বাতাস চৌচির করে রেমিংটন বুলেটের প্রচণ্ড আওয়াজ উঠল গু-ড়ু-ম...
চরের ছৈলা গাছ থেকে সোঁ করে উড়ে গেল ভয়ার্ত টিয়ার দল। কিছু শালিক আর কুঁজো বক ভয় পেয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে পাখা ঝাপ্টে উড়ে যায় মাতালের মতো।
ভিড়টা এতক্ষণে সম্বিত ফিরে পায়।
সবাই চোখ সরু করে নিরিখে তৎপর হয়
রক্তাক্ত ঘোলা স্রোতে তোলপাড় ওঠা বিপুল তাণ্ডবের কর্কশ ঘূর্ণিতে।