শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

শাবি থেকে নাসা জয়

শাবি থেকে নাসা জয়

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী সম্প্রতি ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে’ বেস্ট ইউজ অব ডাটা ক্যাটাগরিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। সেই সঙ্গে তারা আমেরিকায় নাসার কার্যালয় ঘুরে দেখার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। বিশ্বের ৭৯টি দেশের বাছাইকৃত ২৭২৯টি দলের সঙ্গে লড়াই করে এ জয় ছিনিয়ে আনেন চার শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের এ অর্জন প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে অবদান রাখবে বলেও মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। শাবির চার তরুণের দীর্ঘ পথচলার গল্প শোনাচ্ছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের শাবি প্রতিনিধি জুবায়ের মাহমুদ।

 

গল্প হলো শুরু

মাহদী ও মঈনুল দুই বন্ধু। দুজনেই পড়াশোনা করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগে। প্রথমবর্ষে দুজনেরই রোবটিক্সের প্রতি আগ্রহ ছিল, তবে আগ্রহটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে গিয়েছিল গেমিং, অ্যানিমেশন ও অ্যাপস তৈরির প্রতি। তাদের পরিচয় হয় সেই বিভাগের তরুণ শিক্ষক বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে। মাহদী ও মঈনুল শিক্ষক বিশ্বপ্রিয়ের সহযোগিতায় তখন তৈরি করেন ‘সাস্ট ভার্চুয়াল ট্যুর’ নামের একটি অ্যাপস। এ অ্যাপসের সাহায্যে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে কেউ শাবিপ্রবিতে না এসেও বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা নিতে পারে। পরবতী সময়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন রাফি ও সাব্বির নামের আরও দুই তরুণ। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হচ্ছে একটি কম্পিউটার প্রযুক্তি; যার মাধ্যমে কম্পিউটারের ভিতরে নিজের মনমতো এক ভার্চুয়াল জগৎ তৈরি করা যায়।

টিম ‘সাস্ট অলিক’

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে কাজ করার প্রয়াসে মাহদী, মাঈনুল, রাফি ও সাব্বির গড়ে তোলেন একটি টিম। টিমের নাম ‘সাস্ট অলিক’। এসএম রাফি আদনান হচ্ছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী, ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী কাজী মঈনুল ইসলাম, একই বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী আবু সাবিক মাহদী ও একই বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী সাব্বির হাসান। সম্প্রতি ‘সাস্ট অলিক’ ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’র বেস্ট ইউজ অব ডাটা ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। 

নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) পৃথিবী ও মহাকাশবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা ৪৮ ঘণ্টার একটি আন্তর্জাতিক হ্যাকাথন (প্রতিযোগিতা)। এটি মূলত ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’ নামে পরিচিত। এ প্রতিযোগিতায় ছয়টি ক্যাটাগরি রয়েছে। ছয়টি ক্যাটাগরিতে সারা বিশ্ব থেকে ২৫টি দলকে ফাইনালিস্ট হিসেবে বাছাই করা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে একটি দল বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। তবে এই ২৫টি দল আবার বিশে^র প্রায় দুই শতাধিক শহরে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বাছাইয়ের ধাপ অতিক্রম করে আসে। ২০১৮ সালের ১৯ থেকে ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সাস্ট অলিক। তারা বিশ্বের ৭৯টি দেশের বাছাইকৃত ২৭২৯টি দলের সঙ্গে লড়াই করে চ্যাম্পিয়ন হয়।

সাস্ট ভিআর থেকে লুনার ভিআর

‘সাস্ট ভার্চুয়াল ট্যুর’ তৈরির পর কীভাবে ‘লুনার ভিআর’র যাত্রা শুরু হলো সেই গল্পটা আমাদের বলেন সাস্ট অলিকের মেন্টর শাবিপ্রবির সিএসই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিশ্বপ্রিয় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘আমাদের শুরুটা অনেক ছোট ছিল। একটা স্বপ্ন ছিল যে সাস্টের জন্য একটা ভিআর অ্যাপ তৈরি করা; যেখানে কেউ সাস্টে না এসেও এখানকার অভিজ্ঞতা বাইরে থেকে নিতে পারবে। সেটা ছিল আমাদের সেকেন্ড মেজরের অ্যাপ। আমাদের শাবিপ্রবিতে যে কোনো বিষয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা একটা সেকেন্ড মেজরের সুযোগ পায়। সেখানে মাইনুল এবং মাহদী কাজ করেন। ওদের নিয়ে আমরা সাস্ট ভার্চুয়াল ট্যুর নামে একটি অ্যাপ তৈরি করি। এভাবেই আমাদের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির কাজটা শুরু হয়। পরে রাফি এবং সাব্বির আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। পর্যায়ক্রমে ‘লুনার ভিআর’ নামের একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যাপ আমরা তৈরি করি। নাসার অনেক ডাটা আছে যা সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারে না। তাই নাসা প্রদত্ত বিভিন্ন ডাটা ব্যবহার করে এই অ্যাপটি তৈরি করা হয়েছে। আমরা অপটিমাল ওয়েতে এ অ্যাপে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডাটা ব্যবহার করায় ‘নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’র বেস্ট ইউজ অব ডাটা ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হই।’

লুনার ভিআর : পৃথিবীতে বসে চাঁদে ভ্রমণ

‘লুনার ভিআর’ একটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যাপ। এই অ্যাপ ব্যবহার করে যে কেউ চাঁদে না গিয়েও চাঁদে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে পারবে। অ্যাপটির মাধ্যমে নাসা অ্যাপোলো ১১ মিশন-এর ল্যান্ডিং এরিয়া ভ্রমণ, চাঁদ থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা এবং চাঁদকে একটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভার্চুয়ালভাবে আবর্তন করা যাবে। এছাড়া অ্যাপের মাধ্যমে একটা ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ দেখা যায় যেন যে কেউ বুঝতে পারে যে চাঁদে গেলে ব্যাপারটা এমন বা জিনিসটা এমন। চাঁদের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে যে কিছু পরিবর্তন হয়; কালার দেখে তা বুঝতে পারা যায়Ñ সেটাও অ্যাপের একটি ফিচারের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। অ্যাপে লুনা নামে একটি ভয়েস অ্যাসিসটেন্ট আছে যা ইংরেজিতে কথা বলে এবং ভিউয়ারকে গাইড করে।

বিশ্বজয়ী চার তরুণের ভাবনা

প্রতিযোগিতা সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এসএম রাফি আদনান বলেন, ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো আমরা নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়েছিলাম। তবে সে সময় ফলাফল এতটা ভালো হয়নি। এবারের কম্পিটিশনে যখন যাই; তখন আমরা সাস্ট ভার্চুয়াল অ্যাপ নিয়ে কাজ করছিলাম। অপরদিকে আমাদের নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে প্রবলেম ছিল মার্স বা মুনের একটা হোস্টিং লেভেলের রিয়েলিটি এনভারমেন্ট তৈরি করা। যেহেতু আমরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে আগে থেকেই কাজ করছিলাম, তাই আমাদের কাছে প্রবলেমটা সহজ মনে হয়েছিল।

ভবিষ্যতে তিনি গেইম ডেভেলপিং সেক্টরে কাজ করতে আশাবাদী। নবীনদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এ প্রতিযোগিতা সম্পর্কে দেশের অনেকেই জানে না বিধায় আমাদের সংখ্যাটা প্রত্যাশার চেয়ে কম। যেহেতু আমরা এর আগেও একবার অংশ নিয়েছিলাম তাই ব্যাপারটা সহজ হয়েছে। আমাদের দেশে অনেক প্রতিভা আছে; যা আগামী দিনে বের হয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করি।’ কাজী মঈনুল ইসলাম ‘লুনার ভিআর’ কেন ব্যতিক্রম তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আমাদের অ্যাপটি ভিন্ন এ জন্য যে, আমরা নাসা প্রদত্ত ডাটাগুলো ব্যবহার করেছি। ফলে প্রকৃতপক্ষ চাঁদটা দেখতে কেমন তার অনেকটা বাস্তব অনুভূতি পাওয়া যায় এর মাধ্যমে। সাস্ট অলিকের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সাব্বির হাসান বলেন, খুব স্বল্প খরচেই মোবাইল আর অ্যাপের মাধ্যমে আমরা চাঁদের অনুভ‚তিটা নিতে পারছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা বই থেকে যা শিখছে এবং রাতের আকাশে যে চাঁদ দেখে, তা খুব সহজেই এই অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারবে। বইয়ের শিক্ষাটাকেই আমরা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যাপের মাধ্যমে বাস্তবে শিক্ষার্থীদের দেখাতে পারছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর