শনিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নওগাঁর নৃত্যশিল্পীর ইউনেস্কো জয়

বাবুল আখতার রানা

নওগাঁর নৃত্যশিল্পীর ইউনেস্কো জয়

নৃত্য নিকেতন নওগাঁর কর্মধারাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিলেন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা চেনা বৃত্তের বাইরে থাকতে ভালোবাসেন। জীবনে সার্থকতা খোঁজার চাইতে, জীবনকে উপভোগ করতে চান তারা। নওগাঁর মোরশেদা বেগম শিল্পী তাদেরই একজন। সুদূর মফস্বল শহরে বসে জীবনভর নৃত্যচর্চা করে এই শিল্পী লাভ করেছেন অসামান্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। অর্জন করেছেন ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক নৃত্য কাউন্সিলের সদস্য পদ। একই সঙ্গে তার নৃত্য সংগঠন নৃত্য নিকেতন পেয়েছে এই স্বীকৃতি। নওগাঁ ডিসি অফিসে অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজের ফাঁকে গত দুই দশকে গড়ে তুলেছেন আন্তর্জাতিক মানের একটি নাচের দল। সেই নাচের দল নওগাঁর গন্ডি ছাড়িয়ে সারা দেশের নানা প্রান্তে নৃত্য পরিবেশন করে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে। যার প্রতিভার বিভা পৌঁছে গেছে ইউনেস্কোতে অথচ তাদের চেনে না রাজধানীর অভিজাত মহলের শিল্পীরা।

ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এলো যেভাবে : নৃত্যশিল্পী, নির্দেশক ও তার পরিচালিত নৃত্য একাডেমি নৃত্য নিকেতনের সভাপতি মোরশেদা বেগম শিল্পী জানালেন, চলতি বছরের আগস্টের ৭ তারিখে প্রথম ইউনেস্কোর সদর দফতর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমরা কোনো রকম যোগাযোগ করিনি কিংবা কোনো ধরনের আবেদনের বিষয় ছিল না। তারা প্রথমে আমাদের ফেসবুক পেইজে যোগাযোগ করেন। ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টের অ্যালকিস রাফটিস সরাসরি যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, আমাদের যদি বিদেশে নাচ পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তাহলে আমরা যাব কি না? আমরা যেতে রাজি হলে তিনি আমাদের সংগঠনের এবং আমার বিস্তারিত তথ্য জানতে চান। সেসব পাঠানোর পর তারা ফোনে যোগাযোগ করেন। এরপর ৩০ আগস্ট আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় আমি মোরশেদা বেগম শিল্পী এবং আমার সংগঠন নৃত্য নিকেতন, নওগাঁকে এই আন্তর্জাতিক ড্যান্স কাউন্সিলের সদস্য করা হয়েছে। আমি এবং আমার দল আলাদা সদস্য পদ লাভ করেছে। একই সময়ে বাংলাদেশের আরও দুজন এ সদস্য পদ লাভ করেছে তারা হলেন ঢাকার তুরঙ্গমী স্কুল অব ড্যান্সের পূজা সেনগুপ্তা ও ধানমন্ডির বাসিন্দা শর্মিষ্ঠা সোনালিকা সরকার। এত বড় অর্জনের পর নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে গিয়ে যখন নিজের আর আমার দলের নাম দেখলাম তখন কী যে আনন্দ পেলাম। এত আনন্দ মনে হয় জীবনে পাইনি। মোরশেদা বেগম শিল্পীর এ

স্বীকৃতিপ্রাপ্তি প্রসঙ্গে নওগাঁর ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আবৃত্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুদ্দৌলা রাব্বী বলেন, নৃত্য নিকেতনের বিশেষত্ব হচ্ছে সংগঠনটি শুধু নৃত্যের মাধ্যমে সৌন্দর্য পরিবেশনে সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষকে নানা বিষয়ে সচেতন হতে উদ্যোগী হয়েছে।

শিল্পী ও তার নৃত্য নিকেতন : বাংলাদেশে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে পেশাদারি ভিত্তিতে নৃত্যচর্চা ও বাংলা সাহিত্যকে অবলম্বন করে বাংলাদেশের নিজস্ব সমসাময়িক নৃত্যধারা তৈরির লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে নৃত্য নিকেতন নওগাঁ প্রতিষ্ঠা করেন মোরশেদা বেগম শিল্পী। স্থানীয় নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন ও জাতীয় অনুষ্ঠানমালাতে নিয়মিত অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা। প্রথমে ছিল নাচ শেখানোর বিদ্যালয়। পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাছাই করা ছেলেমেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন নাচের দল। এরপর থেকে বিভাগীয় জাতীয় প্রতিটি নৃত্য প্রতিযোগিতায় নওগাঁর নৃত্যশিল্পীরা পুরস্কার পেতে লাগলেন। এর ফাঁকে ফাঁকে আমি নিজের প্রস্তুতিও নিতে থাকি। দেশের সেরা নৃত্যশিল্পীদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সাজু আহমেদ, দীপা খন্দকার, বেলায়েত হোসেন খান, শিবলী মোহাম্মদ। তাদের কাছে শিখেছি কিন্তু কখনোই ঢাকামুখী সংগঠন গড়তে চাইনি। নওগাঁ শহরকে নিজের ঘাঁটি রেখে সারা দেশে নৃত্য প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। আমরা যখন স্টেজে নৃত্য পরিবেশন করি সবাই খুব অবাক হয়। কেননা, মফস্বলের দল হিসেবে সবাই প্রথমে কিছুটা অবহেলার দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু আমি ও আমার দলের ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবেশনা দিয়ে মানুষের সম্মান জিতে এনেছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্মানও অর্জন করলাম।

আরও যত সাফল্য : জাতীয় মৌসুমি প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক নৃত্য বিভাগে পর পর সাতবার বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার, জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতা ২০১৩-তে নৃত্য নিকেতনের শিল্পী জারিন তাসলিম লোক নৃত্য ‘ক’ বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক অর্জন করে। ২০১৫-তে লোক নৃত্য ‘ক’ ও ‘খ’ বিভাগে নৃত্য নিকেতনের শিল্পী মালিহা মাসফিরাত মেধা এবং নিশির চন্দ্র মহন্ত দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে রৌপ্য পদক লাভ করে। এ ছাড়া নূর-ই-ইশরাত শশী প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহে সাধারণ নৃত্য প্রতিযোগিতায় ১৮২ জন প্রতিযোগীর মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করে। ২০১৮ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে কলি রানী মন্ডল, মোবাশ্বিরা কামাল অর্ণিল ও নিশির চন্দ্র মহন্ত নৃত্যে সারাদেশের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করে নওগাঁ জেলার জন্য বয়ে এনেছে গৌরব। এ ছাড়াও ৬৩টি জেলা সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ নৃত্যশিল্পী সংস্থা’ আয়োজিত নৃত্য প্রতিযোগিতায় নৃত্য নিকেতন, নওগাঁ লোক নৃত্য (দলীয়)-তে ‘গ’ বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে। তাদের এ সাফল্য সারা দেশের মতো আমাদের নওগাঁ জেলার জন্য মর্যাদা বয়ে এনেছে।

শিল্পীর শিল্প ভুবন : ছোটবেলা থেকেই ঠিক আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো ছিলেন না শিল্পী। একটু গেছো মেয়ে বলতে যা বোঝায় অনেকটা যেন তাই। সারা দিন সাইকেল নিয়ে দাবড়ে বেড়াতেন। এর পাশাপাশি নাচ শিখতেন মুমিনুল হক ভুটির কাছে। পরে নওগাঁ গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা ফরিদা আখতার রুনুর কাছেও নিয়েছেন প্রাথমিক পাঠ। এরপর ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় নাচে রাষ্ট্রপতি পদক পান। এরপর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নওগাঁ ডিসি অফিসের চাকরির চাপ সবকিছুর পরেও নাচকে ছাড়েননি। নাচের পেছনে তার সেই নিষ্ঠাই যেন আজ দশগুণ পুরস্কার হয়ে ফিরে এসেছে তার জীবনে। মোরশেদা বেগম শিল্পী বলেন, এ স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে আমাকে বাংলাদেশে নৃত্য গবেষণা ও উন্নয়নে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

সর্বশেষ খবর