শনিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
তারুণ্য

শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখান জহির

প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পড়ালেখা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন ছিল অধরা...

শনিবারের সকাল ডেস্ক

শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন দেখান জহির

জহিরুল ইসলাম। তবে সবাই তাকে জহির নামেই ডাকতে ভালোবাসেন। ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য খরচের জোগান দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসেন তাদের থাকা, খাওয়া, পড়াশোনার খরচ সব বহন করেন। তার  সহযোগিতায় কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা থেকে অনেকেই এখন উচ্চশিক্ষা নিতে আগ্রহী হয়েছেন। অনেকেই উচ্চশিক্ষায় জীবন গড়েছেন তার পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায়। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের টিউশনি করান বিনা মূল্যে। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করছেন। ছেলেবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন কুমিল্লা  জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার রায়কোট উত্তর ইউনিয়নের দাসনাইপাড়া গ্রামে। নিজ এলাকার মাহিনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাকা বোর্ডে নবম স্থান অর্জন করেছিলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পড়ালেখা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন ছিল অধরা। তারপরও পিছপা হননি তিনি। ২০১৪-১৫  সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বর্তমানে শুধু স্বপ্ন দেখতে নয়, সবাইকে স্বপ্ন দেখাতেও ভালোবাসেন জহির। ছাত্ররাজনীতি করছেন। ইউনিয়ন ছাত্রলীগের ছাত্রবৃত্তি সম্পাদক। এখন আছেন বিজয় একাত্তর হলে। তিনি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও ঢাবি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে গরিব ও মেধাবী

শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। গত ২৮ ডিসেম্বর নাঙ্গলকোট উপজেলার ৫০ জন মেধাবী শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে শিক্ষা সফরে নিয়ে আসেন। এর আগে ২০১৭ সালেও একই স্থানে ৩৫ শিক্ষার্থীকে শিক্ষা সফরে নিয়ে আসেন। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন জহির। বন্ধের সময় বাড়িতে  বেড়াতে গেলে এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্লাস নিতেন ও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখাতে মোটিভেশনাল প্রোগ্রামের আয়োজন করেন। প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থীর মাঝে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি বিতরণ করেন। ছেলেবেলা থেকেই দেশপ্রেমী একজন শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন তিনি। স্কুলের নতুন ভবন তৈরি করার জন্য একমাত্র শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলা হয়। ভাষা শহীদদের চরণে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এটি ছিল শিক্ষার্থীদের একমাত্র স্মৃতি। তাই নিজ উদ্যোগে ২০১৬ ও ’১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগের দিন শিক্ষার্থীদের জন্য শহীদ মিনার  তৈরি করেন। পরের দিন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

নিজ জন্মস্থানের প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই তার মনে। শুধু নিজের জন্যই নয়, ভাবেন সাধারণ মানুষের কথাও। সাংগঠনিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের গুণাবলিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন জহির। এলাকার শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে তৈরি হয় ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব রায়কোট ইউনিয়ন (উসারু)। সে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়া নাঙ্গলকোট উপজেলার শিক্ষার্থীদের আঞ্চলিক সংগঠন ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব নাঙ্গলকোট’ (ডিউসান)-এর বর্তমান সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, মাদক ও ইভ টিজিং বিরোধী সাইকেল র‌্যালি ও মানববন্ধন এবং জনসচেতনতার লক্ষ্যে বিভিন্ন লিফলেট বিতরণ করেন। এছাড়া দুটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করতেও সক্ষম হয়েছেন। শীতে অসহায় শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন। সম্প্রতি জহির তার এলাকায় একটি পাঠাগার গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এসব কিছুর পিছনে যাদের উৎসাহ বা অবদান তা সম্পূর্ণ বন্ধু-বান্ধব, স্কুলের শিক্ষক এবং পরিবারের। সমাজকে আলোকিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো প্রসারের জন্য কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। ২০১৪ সালে সবাইকে নিয়ে একটি দল গঠন করেন। যাদের মধ্যে ১২ জনই পড়ে চান্স পেয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এভাবেই উচ্চশিক্ষার প্রসারে কাজ করে চলেছেন তিনি। একটি মেয়েকে বাসা থেকে পড়াতে চাচ্ছিল না। কিন্তু তিনি বুঝিয়ে বাসা থেকে কুমিল্লা নিয়ে আসেন। তার ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। প্রথমবার মেয়েটি চান্স না পেলেও পরের বার ঠিকই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে এখন উচ্চশিক্ষ অর্জন করছে। তার সহযোগিতায় দেশের নানা প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ১০০ জন এখন পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থীর কাছে তিনি সহযোগিতার হাত নিয়ে পৌঁছেছেন।

জহিরের বাবা তাজুল ইসলাম হকার ছিলেন। কিন্তু দোকান পুড়ে যায় হেফাজতের আন্দোলনের সময়। বাবা মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করতেন, তার ৬ হাজার টাকাই ছেলেকে দিয়ে দিতেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল জহিরের পথচলা। পথচলা চলছেই... সঙ্গী হয়েছে অনেক মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কুমিল্লা সরাসরি ‘বিশ্ববিদ্যালয় বাস’ চালুর চেষ্টা করছেন তিনি। এখন শুধু বাসের জন্য অপেক্ষা।

সর্বশেষ খবর