সোমবার, ১৫ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

টেলিভিশন কি থাকবে?

ফরিদুর রেজা সাগর

টেলিভিশন কি থাকবে?

১৯৩৬ সালে বিবিসি প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। তার ২৮ বছর পর ঢাকার অধিবাসীরা প্রথম টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার স্বাদ পায়। বলা বাহুল্য, এ উপমহাদেশে প্রথম টেলিভিশন দেখার সৌভাগ্য হয় ঢাকার দর্শকদের।

১৯৬৪ সালে প্রথম ঢাকায় টেলিভিশন কেন্দ্র বসে। এর ৩৫ বছর পর এ ঢাকা শহরেই সূচনা হলো ডিজিটাল স্যাটেলাইট টেলিভিশনের। এখন ২০২১। মানুষ বলছে, টেলিভিশনের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। দর্শক টেলিভিশন দেখার আগ্রহ হারাচ্ছে।

কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? বরং ড্রইংরুমের কোনায় শোভাবর্ধনকারী একটি টেলিভিশনের সামনে পুরো পরিবারের লোক বসত অনুষ্ঠান দেখার জন্য। টেলিভিশন পরিবারের সঙ্গী এবং বন্ধু। এখন দিন পাল্টেছে। পরিবারের সব বয়সের সদস্যরা যে যার মতো টেলিভিশন দেখার চেষ্টা করে। কেউ নাটক, কেউ খেলা, কেউ গান, আরও কত রকম অনুষ্ঠান।

রূপ পাল্টেছে টেলিভিশন সেটেরও। কেউ পছন্দ করে ১০০ ইঞ্চি টেলিভিশনের পর্দা। আবার কেউ কেউ হাতের ছয় ইঞ্চি ফোনের কাচের পর্দা। কেউ দেখতে পছন্দ করে টেলিভিশনের নিয়মিত অনুষ্ঠান। কিংবা কেউ ওটিটি প্ল্যাটফরম বা ইউটিউবে পছন্দের নির্ধারিত অনুষ্ঠান।

কিন্তু এক দিনে এ বিবর্তন আসেনি। এ রুচি তৈরি হয়নি। আস্তে আস্তে এই যে রুচির বদল, এই যে বিবর্তন টেলিভিশনকে কেন্দ্র করে সেই স্মৃতি ধরে রেখে আমার এই লেখার চেষ্টা। এই লেখাকে কোনোভাবেই কেউ যেন আমার স্মৃতি লেখার বাইরে কিছু মনে না করেন। আর আমার এই স্মৃতিকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে গত ৫৫ বছর যারা এই দেশের টেলিভিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের অনেকেই।

তাদের অপরিসীম পরিশ্রমের জন্যই আজ বাংলা টেলিভিশন সগৌরবে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

টেলিভিশন এবং পত্রিকা এ দুটোর একটি মেলবন্ধন শুরু হয়েছিল চ্যানেল আইয়ের হাত ধরে। আমাদের দেশে এই যে অসংখ্য পত্রিকা বিশেষ করে ঢাকার জাতীয় দৈনিক পত্রিকা নিয়ে চ্যানেল আই ২০০২ সালের শুরুতেই একটি অনুষ্ঠানের আইডিয়া করে। সংবাদপত্র নিয়ে অনুষ্ঠানটি শুরু হয় চ্যানেল আইতে। দেশের জাতীয় সংবাদপত্রের মূল মূল শিরোনাম এবং সেদিনের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ নিয়ে ছিল অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ।

চ্যানেল আইয়ের এ অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয় মধ্যরাতে। ‘গ্রামীণফোন আজকের সংবাদপত্র’ নামের এ অনুষ্ঠানটি প্রতিরাতেই প্রচারিত হয়। সংবাদপত্র যে টেলিভিশনের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরস্পরের পরিপূরক তার একটি বড় প্রমাণ এ অনুষ্ঠান। পাঠক সকালবেলা যে পত্রিকা পড়ে, চ্যানেল আই মধ্যরাতে সে পত্রিকাগুলোই দর্শকদের দেখিয়ে দেয়। শুধু পত্রিকার সংবাদগুলো দেখানো নয়, সম্পাদক পদমর্যাদার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সেদিনের সংবাদ নিয়ে আলোচনা করেন।

মতিউর রহমান চৌধুরী এবং আমি একবার একসঙ্গে দুবাই যাচ্ছিলাম। মাটি থেকে ৩৫ হাজার ফুট উঁচুতে এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। মতিউর রহমান চৌধুরী দেশে ফিরেই সেই পরিকল্পনা মোতাবেক চ্যানেল আইতে অনুষ্ঠানটির উপস্থাপনা শুরু করেন।

দৈনিক পত্রিকা নিয়ে চ্যানেল আই অবশ্য অনেক আগে থেকেই নানারকম অনুষ্ঠান তৈরির চেষ্টা করছিল। যখন সিঙ্গাপুর থেকে অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো, তখন চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ চিন্তা করেছিলেন বাংলা টাইপসহ একটা কম্পিউটার নিয়ে বাংলায় খবর স্ক্রল করা যায় কিনা। তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ যখন এসএনজি ব্যবহারের অনুমতি পেলেন প্রতিদিন রাতে পনের মিনিটের সংবাদভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান চ্যানেল আইতে প্রচার করা হতো। এই অনুষ্ঠান স্পন্সর করার জন্য বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় কাজী শাহেদ আহামদের কথা। তিনি ‘আজকের কাগজ’-এর নামে এই অনুষ্ঠানটি স্পন্সর করতেন। হাসান কামরুল রাকিব এসএনজি থেকে প্রতিদিন রাতে যেভাবে স্যাটেলাইটে এ অনুষ্ঠান প্রেরণ করতেন সেটাই এখন একটি গবেষণার বিষয় হতে পারে।

পরবর্তীতে বাংলাদেশের অনেক টেলিভিশন চ্যানেলই সেই অনুষ্ঠানের ধরন এবং ধারণা নিয়ে নানান অনুষ্ঠান প্রচার করে আসছে।

আমার মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন খুব উদার মানুষ। তিনি আমাদের মুক্তমনে বড় করেছেন। ছোটবেলায় গল্পের বই পড়া ও টেলিভিশন দেখা এবং পত্রিকা পড়ার ব্যাপারে কোনো বাধা দেননি। আর সাংস্কৃতিক সুবাতাস বইতো আমাদের পরিবারে। বাবা ফজলুল হক ছিলেন দেশের প্রথম ‘সিনেমা’ পত্রিকার সম্পাদক। প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্রের পরিচালক। সিনেমার নাম ‘প্রেসিডেন্ট’।

আমার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস সেই ছোটবেলা থেকে। আমাদের বাসায় তিন-চারটা পত্রিকা সবসময় রাখা হতো। তখন প্রকাশিত হতো দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক পূর্বদেশ। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তাম কচিকাঁচার আসর, সাত ভাই চম্পা, চাঁদের হাট। ছোটদের পাতাগুলো সেই আমলে খুব সুন্দর আয়োজনে সমৃদ্ধ ছিল। কিশোর বেলায় আমি পত্রিকায় লেখালেখিতে হাত দিই। ইত্তেফাক, পূর্বদেশ, কিশোর বাংলা পত্রিকায় আমি ছোটদের পাতায় লেখালেখি করতাম। বড় হয়েও আমার এই চর্চা অব্যাহত ছিল। আমার বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই তখন এসব পত্রিকার পাতায় লিখত। তারা এখন লেখক হিসেবে স্বনামেই পরিচিত।

দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস এখনো আমার তীব্রভাবে আছে। ১৯৮৪ সালে কণার সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। বিয়ের পরে একটা স্মৃতি খুব উজ্জ্বলভাবে মনে আছে। আমাদের বাসায় তখন পাঁচ-ছয়টা পত্রিকা রাখা হতো। ঘুম থেকে উঠেই আমি পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দিতাম। কণা ভেবেই পেত না, একজন মানুষ কেন এতগুলো পত্রিকা পড়বে? তার এই কৌতূহল বহুদিন ছিল।

এখন পত্রিকায় বিনোদন পাতা হয়তো প্রথমেই পড়ি। তারপর ক্রিকেট ও রাজনৈতিক ভাষ্য। কিন্তু হত্যা খুন গুম এসব সংবাদ একেবারেই পড়তে পারি না।

এখন অবশ্য ১২-১৪টা পত্রিকা একসঙ্গে পড়ি। একেক পত্রিকার একে রকম চরিত্র। দেশের বাইরে থাকলে অনলাইন সংস্করণ পড়ি। কিন্তু পত্রিকা পড়ায় কোনো দিন বিচ্ছেদ ঘটেনি। যদি কোনো ছুটিতে পত্রিকা বন্ধ থাকে, পরদিন কী যে যন্ত্রণা হয়। সারা দিন ছটফট করি। ভাবতে থাকি- কোন একটা কাজ যেন সারা দিন করা হয়নি। এখন নানা ধরনের পত্রিকা প্রকাশিত হয়। একেক পত্রিকা একেক রকম। সব পত্রিকা আমি একই রকম আনন্দ নিয়ে পড়ি।

এখন পত্রিকার অনেক রকম ডিজিটাল ভার্সন। এ ছাড়া ট্যাবলয়েড সাইজ কিংবা আট পৃষ্ঠার সংস্করণ ইদানীং জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিন সেই পত্রিকা যা এক পলকে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। অনেক সময় বাংলাদেশ প্রতিদিন আমি রাত ১২টায় প্রেস কপি পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠি।

পত্রিকায় প্রেস কপি পড়া নিয়ে আমার একটি স্মৃতিকথা মনে পড়ছে এই মুহূর্তে- আমরা তখন বাংলামোটরে প্রপার্টি এনক্লেভে থাকি। ইমপ্রেস গ্রুপ তখন আজকের কাগজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আজকের কাগজের অফিস ছিল ধানমন্ডির জিগাতলায়। পত্রিকা ছাপা হতো এফডিসির পাশেই হলিডে প্রিন্টার্সে। আজকের কাগজ প্রেস কপি পড়ার জন্য আমি জেগে থাকতাম। আমার একটা লোককে নিয়োগ দিয়েছিলাম প্রেস থেকে একটা কপি তখনই আমার বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। পত্রিকাটি যখন হাতে পেতাম তখনো পত্রিকাটি থাকত গরম গরম। ভাঁজ খুলে পত্রিকার শিরোনামগুলো পড়ে নিতাম। তারপর জরুরি খবর। এরপর ঘুমাতে যেতাম। এ অভ্যাস এখনো আমার আছে। চ্যানেল আইতে প্রতিদিন প্রচারিত রাত ১২টার ‘আজকের সংবাদপত্র’-এ পত্রিকাগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। তারপরই পত্রিকা আমি বাসায় নিয়ে যাই। প্রথম পৃষ্ঠাতেই নিয়মিত ও এক্সক্লুসিভ খবরগুলো পাওয়া যায়। বিনোদন, খেলাধুলা ও সম্পাদকীয় পাতাগুলোই অন্য ধরনের।

সংক্ষেপিত নিউজ তৈরিতে খুব যত্নবান এই পত্রিকাটা। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ প্রতি সকালে আবারও না পড়লে আমার দিন সুন্দর হয় না। আজকাল প্রায়ই শুনি পত্রিকা নাকি থাকবে না। টেলিভিশন নাকি থাকবে না। সব নাকি ডিজিটাল ফর্মে রূপান্তরিত হবে। আমরা কিন্তু পত্রিকা পড়ার যুগের প্রতিনিধি। তাই পত্রিকা পড়ার স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবনটা কাটাতে চাই। সম্পাদক নঈম নিজামকে ধন্যবাদ। একদল উজ্জ্বল কর্মী নিয়ে তারা সফলতার স্বর্ণদুয়ারে পৌঁছে গেছে। এখন দৈনিক পত্রিকা খুব চ্যালেঞ্জিং। ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপকেও ধন্যবাদ। তারা যেখানেই হাত দেয় সেটাই সোনা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ প্রতিদিন আমার দৈনন্দিন সঙ্গী। চিরজীবী হোক বাংলাদেশ প্রতিদিন।

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর