মঙ্গলবার, ১৬ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

টিভিতে মেসি-রোনালদোদের দেখে আফসোস লাগে

শেখ মো. আসলাম

টিভিতে মেসি-রোনালদোদের দেখে আফসোস লাগে

কেউ কেউ আমার কথায় বড্ড কষ্ট পান। বলেন, তুমি দেশের ফুটবল নিয়ে বড্ড বেশি সমালোচনা কর। কষ্টটা আমার এখানেই। যে ফুটবল আমাকে সবকিছু দিয়েছে, এক নামেই সবাই চেনেন, এখনো রাস্তাঘাটে দেখা পেলেই ভক্তরা জড়িয়ে ধরেন, সেই ফুটবলেরই সমালোচনা করতে হচ্ছে। মনে যে কত কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলি তা বোঝাতে পারব না। আমরা যখন খেলতাম তখনো ফুটবলের মান যে গর্ব করার মতো ছিল তা বলব না। কিন্তু একটা অবস্থান ছিল। আর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়ার মতো। কে কী ভাববেন জানি না দেশের মন্ত্রীদের নাম জানত না, অথচ ফুটবলারদের নাম ছিল সবার মুখস্থ। দূর থেকে দেখলেই বলে দিত ওই যে আসলাম, কায়সার হামিদ, মুন্না, সাব্বিররা আসছে।

আমাদের আগে হাফিজ, সালাউদ্দিন, এনায়েত, নওশের, নান্নু, চুন্নু, টুটুল ও মঞ্জু ভাইরা ছিলেন সুপার স্টার। তাঁরা খেলা ছাড়ার পর দেশে কি ফুটবলারদের শূন্যতা ছিল? তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরি আমাদের বলা হতো। আমার জন্ম তো ঢাকায় না। খুলনার ছেলে। এখানে টুর্নামেন্ট ও লিগ খেলেছি। আমার খেলা দেখেই কর্মকর্তারা আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এমন উদাহরণ অনেকের বেলায়ই দেওয়া যাবে, যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসে লিগ খেলে সু-প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তখন ফুটবলারদের স্বপ্ন ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলার। মোহামেডান, আবাহনী বা ব্রাদার্স ইউনিয়নের জার্সি পরে মাঠে নামবে আর দর্শকরা নৈপুণ্য দেখে করতালি দেবে।

শুধু বলে লাথি মারলেই ফুটবলার হওয়া যায় না, জেদ ও একটা লক্ষ্য থাকতে হবে।

আমি যখন ঢাকায় ফুটবল খেলা শুরু করি তখন আমার পজিশন ছিল রক্ষণভাগ। আস্থার পরিচয়ও দিয়েছি। কিন্তু ফুটবল গোলের খেলা। যারা গোল করেন তাদেরকে ঘিরেই বেশি উৎসবটা হয়। আমারও ইচ্ছা জাগল পজিশন বদলে সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেলব। কোচ রহিম ভাইকে আমার ইচ্ছার কথা জানালাম। এখানে বলা দরকার, ফুটবলার হিসেবে পরিচিত হওয়ার পেছনে যে কজন কোচের অবদান রয়েছে সেখানে রহিম ভাই ছিলেন অন্যতম কারিগর।

রহিম ভাই প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে বললেন, ঠিক আছে আসলাম, তুমি ২/১টা ম্যাচ সেন্টার ফরোয়ার্ডে খেল। খেললাম, আমার গোল করার দক্ষতা, রানিং ও হেড দেখে তিনি এতটা মুগ্ধ হলেন যে, সেন্টার ফরোয়ার্ডই আমার স্থায়ী পজিশন হয়ে গেল। ভিক্টোরিয়া, বিজেএমসি, মোহামেডান, আবাহনীতে খেলেছি। গোলও পেয়েছি। তবে আবাহনীর নামটি আমার হৃদয়ে সোনালি অক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। এ দলে খেলেই আমি তারকা খ্যাতি পেয়েছি। জাতীয় দলে খেলেছি। টানা চারবারসহ আবাহনীতে খেলে পাঁচবার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছি। ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে শত শত গোল করেছি। যা দেখে ভক্তরা আমাকে বলত বাংলাদেশের পেলে।

হয়তো ভাববেন, নিজের সুনাম নিজেই করলাম। না, আমি এগুলো বললাম এ কারণে যে- জেদ, লক্ষ্য ও পরিশ্রম করলে যতই বাধা আসুক না কেন সফল হওয়া যায়। বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, রুমি, কানন, মহসিন, তাঁরাও তো হুট করে তারকা বনে যাননি। অধ্যবসায়ই তাদের সম্মানজনক আসনে বসিয়েছে। দেখেন আমি আগেই স্বীকার করেছি, আমরা যখন খেলতাম তখনো গর্ব করার মতো মান ছিল না। আশির দশকে ফিফার সভাপতি জোয়াও হ্যাভেল্যাঞ্জ এসে বলে গিয়েছিলেন, তোমাদের এখানে যে মানসম্পন্ন খেলোয়াড় আছে, এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপে খেলবে।

হায়রে বিশ্বকাপ! এখন তো আমাদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেমিফাইনাল খেলাটাই স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। কেন এই হাল? এর জন্য কি ফুটবলাররা দায়ী? অবশ্যই না, ফুটবল ফেডারেশনের অদক্ষতায় ফুটবল এমন পথে হাঁটছে। আমাদের সময়ও ফেডারেশন সক্রিয় ছিল তা বলা যাবে না। হারুনুর রশীদ, শেখ আকমল হোসেন ভাইদের মতো দক্ষ সংগঠক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে পরিবর্তন আনতে পারেননি। তবে তাঁদের সময় জেলায় জেলায় নিয়মিত লিগ হতো।

আমরা চাচ্ছিলাম ফুটবলের দুঃসময়ে এমন একজন সভাপতি হোক, যিনি ফুটবলের সবকিছু বোঝেন ও জানেন। আমরা অধিকাংশ সাবেক ফুটবলার চাচ্ছিলাম বাফুফে সভাপতি পদে কাজী সালাউদ্দিন ভাই বসুক। ২০০৮ সালে তাঁকে শুধু সমর্থনই দিইনি, তাঁর প্যানেলে নির্বাচন করেছি। ভেবেছিলাম সালাউদ্দিন ভাই ফুটবলের আসল সমস্যাটা বুঝতে পারবেন। তৃণমূল থেকে প্রতিভার সন্ধানে নামবেন, স্কুল, কলেজ টুর্নামেন্টসহ ঢাকার বাইরে নিয়মিত লিগ গড়াবে। চোখ রাখবেন সবদিকে। তিনি শুধু ফুটবলার নন, দেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম সুপার স্টার। জাতীয় দলের অধিনায়ক ও কোচ ছিলেন।

এমন যোগ্য লোক অভিভাবক হবেন কে না চায়। আমরা অনেক কিছুই আশা করেছিলাম। তাঁর নেতৃত্বে কিছুই হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা ক্রীড়াপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই স্নেহের পাত্র সালাউদ্দিন ভাই। হাসিনা আপার মুখ থেকে আমি শুনেছি ‘দেখ সালাউদ্দিন, বঙ্গবন্ধু নিজে ফুটবল খেলতেন। এটা বাঙালির প্রাণের খেলা। একে জাগাতে হবে। এর জন্য যা যা সহযোগিতা দরকার আমি করব।’ আফসোস প্রধানমন্ত্রীর এমন আশ্বাসের পরও সালাউদ্দিন ভাই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন না। সালাউদ্দিন ভাই টানা চারবার সভাপতি হলেন, এতদিনেও তিনি বুঝতে পারলেন না ফুটবলে কী করলে উন্নয়ন ঘটবে।

সমালোচনা করি মনের দুঃখে। আমার রক্তেও যে মিশে গেছে ফুটবল। কেউ হয়তো বলতে পারেন আপনিও তো দীর্ঘদিন বাফুফের কমিটিতে ছিলেন। এ দায় তো আপনারও। অবশ্যই দায় এড়াতে পারব না। কেন যে পারলাম না এ নিয়ে বিতর্ক তুলতে চাই না। তবে সালাউদ্দিন ভাইয়ের কাছে অনুরোধ থাকবে, সবাইকে নিয়ে কাজ করুন। এতে আপনি যেমন উপকৃত হবেন, ফুটবলেরও লাভ হবে।

ওই যে, একটা কথা বলেছি না, ফুটবলাররা দায়ী নন, মনের কষ্টে অনেক সমালোচনা করেছি। কখনো ফুটবলারদের নিয়ে কিছু বলিনি। তবে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, তারা তো নিয়মিত টিভি, ফেসবুক ও ইউটিউবে মেসি, রোনালদো, নেইমার, এমবাপ্পে, সুয়ারেজদের মতো বিশ্ববিখ্যাত ফুটবলাদের খেলা দেখছেন। দেখেও তো অনেক কিছু শেখার আছে। তাদের কি কখনো আগ্রহ জাগে না, টিভিতে মেসি, রোনালদোদের খেলা যতই দেখছি আফসোস বাড়ছে। আমাদের সময় টিভিতে ইউরো লিগ সরাসরি দেখানো হতো না। তখন নিজে নিজে কিছু শেখার চেষ্টা করতাম। কোচ ছাড়াও নিজের অনেক কিছু শেখার আছে। যার বড় উদাহরণ দুই কিংবদন্তি পেলে ও ম্যারাডোনা।

লেখক : ক্রীড়াবিদ।

সর্বশেষ খবর