বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে। প্রথমবারের মতো ক্রিকেটাররা রঙিন জার্সি পরে খেলতে নামেন। ৯২-এর বিশ্বকাপ থেকেই ওয়ানডেতে লাল বলের পরিবর্তে চালু হয় সাদা বল। আর বিশ্বকাপে নাটকীয়ভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় ইমরান খানের পাকিস্তান। ওই আসরে মোটেও ফেবারিটের তালিকায় ছিল না ইমরান খানের দলের নাম। গ্রুপ পর্বের গন্ডিই পার হওয়ার কথা ছিল না পাকিস্তানের। ভাগ্যের জোরে কোনোরকমে টেনেটুনে নকআউট নিশ্চিত করে। সেই দলটাই কিনা ক্যারিশমেটিক চ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেট বিশ্বকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে মেলবোর্নে শিরোপা আনন্দে মেতে ওঠে পাকিস্তান।
► ৭৪ রানে অলআউট পাকিস্তান
গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৭৪ রানেই অলআউট হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান। ওই ম্যাচে ইংলিশদের জন্য প্রায় নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিল। গ্রাহাম গুচের ইংল্যান্ড ব্যাট করতে নেমে ৮ ওভারেই ২৪ রান করে, এরপরই শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। নিশ্চিত হেরে যাওয়া ম্যাচ থেকেও ১ পয়েন্ট পেয়ে যায় পাকিস্তান। ভাগ্যের জোরে পাওয়া ওই ১ পয়েন্টই পাকিস্তানকে নকআউটে নিয়ে যায়।
► নতুন দল দক্ষিণ আফ্রিকা
৯২-এর বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। বর্ণ বৈষ্ণম্যের কারণে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলটি ছিল শিরোপার অন্যতম দাবিদার। গ্রুপ পর্বের ৮ ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতে জিতে তারা সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছিল। শেষ চারের লড়াইয়ে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল প্রোটিয়াদের।
► ইনজামের গ্রেট ইনিংস
সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়টাই ছিল পাকিস্তানের টার্নিং পয়েন্ট। ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ৭ উইকেটে ২৬২ রান করে কিউইরা। লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে মিডল অর্ডারে ধীরগতির ব্যাটিংয়ের জন্য ম্যাচ থেকে যেন ক্রমশ ছিটকে যাচ্ছিল পাকিস্তান। এমন সময় তরুণ ইনজামাম ব্যাট হাতে নেমে মাত্র ৩৭ বলে খেলেন ৬০ রানের সাইক্লোন ইনিংস। নাটকীয়ভাবে জিতে প্রথমবারের মতো ফাইনাল উঠে যায় পাকিস্তান। ম্যাচ সেরা হন ইনজামাম।
► নায়ক ওয়াসিম আকরাম
পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ের সবচেয়ে বড় নায়ক ছিলেন ওয়াসিম আকরাম। ওভারের ছয় বলে ছয় রকম ডেলিভারি দিয়ে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করতে পাক পেসার ছিলেন ওস্তাদ। ওই আসরে ১৮টি উইকেট নিয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার বোলার হয়েছিলেন। তবে ফাইনালের জন্য পাকিস্তানি সমর্থকরা আলাদাভাবে মনে রাখবেন। ব্যাট হাতে ১৮ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস এবং বল হাতে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হন।
► ‘অ্যাক্রোবেটিক’ জন্টি রোডস
ক্রিকেটে ফিল্ডিং যে একটা শিল্প তা ৯২-এর বিশ্বকাপেই বুঝিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডার জন্টি রোডস। পাকিস্তানের ব্যাটসম্যান ইনজেমামকে পয়েন্ট থেকে উড়ে গিয়ে যেভাবে রান আউট করেছেন তা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। পুরো টুর্নামেন্টেই চোখ ধাঁধানো ফিল্ডিং করেন রোডস। এরপর তার নাম হয়ে যায় ‘অ্যাক্রোবেটিক’ জন্টি রোডস।
► ‘ভয়ঙ্কর’ নিউজিল্যান্ডের বিদায়
এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দল ছিল নিউজিল্যান্ড। আয়োজক দলটি শিরোপার অন্যতম দাবিদার ছিল। মার্টিন ক্রো, রাদারফোর্ড, গ্রেটব্যাচ, রাইট, জোনসের মতো তারকায় ভরপুর ছিল দলটি। গ্রুপ পর্বে তারা ৮ ম্যাচের মধ্যে নয় ম্যাচেই দুর্দান্ত জয় তুলে নেয়। কেবল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হেরে যায় ৭ উইকেটে। সেমিফাইনালেও সেই পাকিস্তানের বাধা আর পার হতে পারেনি।
► মার্টিন ক্রোর ইনজুরি
৯২-এর বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় ঘটনার একটি ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের অধিনায়ক মার্টিন ক্রোর ইনজুরি। কিউই দলপতি যতক্ষণ মাঠে ছিলেন তখন ম্যাচ নিউজিল্যান্ডের হাতের মুঠোতেই ছিল। ক্রো ইনজুরি আক্রান্ত হওয়ার পরই ম্যাচের রং বদলে যেতে শুরু করে। ইনজামামের সাইক্লোন ব্যাটিংয়ে হেরে যায় ফেবারিটরা।
► ফাইনাল
ইংল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান। প্রথমে ব্যাট করে ৬ উইকেটে ২৪৯ রান করে পাকিস্তান। ৭২ রান করেন অধিনায়ক ইমরান, ৫৮ রান করেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। ৩৫ বলে ৪২ ইনজেমাম, ১৮ বলে ৩৩ করেন ওয়াসিম আকরাম। ২৫০ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ২২৭ রানে অলআউট ইংল্যান্ড। ৬২ রান করেন ফেয়ারব্রাদার। ৪৯ রানে ৩ উইকেট নেন ওয়াসিম আকরাম। ৪১ রানে তিন উইকেট নেন মুস্তাক আহমেদ। আকিব জাভেদ ১০ ওভারে ২৭ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট।
চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান দল
১. ইমরান খান (অধিনায়ক), ২. আমির সোহেল, ৩. আকিব জাভেদ, ৪. ইজাজ আহমেদ, ৫. ইনজামাম-উল-হক, ৬. ইকবাল সিকান্দার, ৭. জাভেদ মিয়াঁদাদ, ৮. মঈন খান (উইকেটরক্ষক), ৯. মুস্তাক আহমেদ, ১০. রমিজ রাজা, ১১. সেলিম মালিক, ১২. ওয়াসিম আকরাম, ১৩. ওয়াসিম হায়দার, ১৪. জাহিদ ফজল।
ইমরানের হাতে ট্রফি
ফ র ম্যা ট
সম্পূর্ণ নতুন ফরম্যাটে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত। সম্পূর্ণ রাউন্ড রবিন লিগ। অংশগ্রহণকারী নয় দলই গ্রুপ পর্বে একে অপরের বিরুদ্ধে খেলে। তারপর পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ চার দল সেমিফাইনালে ওঠে। সেমিফাইনালে বিজয়ী দুই দল ফাইনাল খেলে। ৫০ ওভারের ওয়ানডে। প্রথমবারের মতো রঙিন পোশাক পরে খেলতে নামেন ক্রিকেটাররা। বলের রং ছিল সাদা।
এক নজরে
► চ্যাম্পিয়ন : পাকিস্তান
► রানার্সআপ : ইংল্যান্ড
► অংশগ্রহনকারী দল : ৯টি
► মোট ম্যাচ : ২৯টি
► ম্যান অব দ্য ফাইনাল : ওয়াসিম আকরাম
► সিরিজ সেরা : মার্টিন ক্রো
► দলীয় সর্বোচ্চ : শ্রীলঙ্কার ৩১৬/৪, জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে, নিউ প্লাইমাউথ, নিউজিল্যান্ড।
► ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ (মোট): ৪৫৬, মার্টিন ক্রো, নিউজিল্যান্ড।
► সর্বোচ্চ স্কোর: ১১৯*, রমিজ রাজা, পাকিস্তান।
► সর্বোচ্চ পার্টনারশীপ : ১৭৫*, ডেমমন্ড হাইন্ডস ও ব্রায়ান লারা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
► সর্বাধিক উইকেট: ১৮টি, ওয়াসিম আকরাম, পাকিস্তান।
► সেরা বোলিং: ৪/১১, মেরিক প্রিঙ্গল, দক্ষিণ আফ্রিকা।
► সর্বাধিক ডিসমিশাল : ১৫টি, ডেভিড রিচার্ডসন।