‘গোল্লাছুট’ -নামটা শুনলে হয়তো সবারই স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে চিরায়ত বাংলার এক ছবি! কয়েক দশক আগেও এটি ছিল গ্রাম-বাংলার জনপ্রিয় খেলা। খেলতো শহরের ছেলে-মেয়েরাও। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে ডিজিটাইজেশনের প্রভাবে এখন বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যের খেলা গোল্লাছুট।
স্কুল থেকে ফিরে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা দল বেধে মাঠে চলে যেত। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে দিত গোল্লাছুট খেলে। এখনকার মতো তখন ঘরে ঘরে টিভি ছিল না, ইন্টারনেট-স্মার্টফোন তো নয়ই। তাছাড়া এই খেলায় কোনো ইনভেস্টমেন্ট ছিল না বলেও গ্রামের ছেলে-মেয়েরা এই খেলাকেই সবার আগে বেছে নিত। এমনকি শহরের শিশু-কিশোরদের মধ্যেও গোল্লাছুট বেশ জনপ্রিয় ছিল ।
কিন্তু কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই খেলা। শিশু-কিশোরদের হাতে স্মার্টফোন চলে আসায় এবং ইন্টারনেট সহজবোধ্য হওয়ায় ঘরেই সময় কাটাচ্ছে শিশু-কিশোররা। এখন সবার মনে-মগজে ঢুকে গেছে ভিডিও গেমস কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
গোল্লাছুটের মতো গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যাওয়ায় ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটারে আসক্ত হয়ে পড়েছে তরুণ সমাজ। দিনের বেশির ভাগ সময় শিশু-কিশোররা ট্যাব, কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত থাকছে। বিশেষজ্ঞদের মতে গ্রামীণ খেলা হারিয়ে যাচ্ছে বলে, একদিকে যেমন শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে নিজের অজান্তেই মাদক, জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে সহজেই জড়িয়ে পড়ছে তরুণরা।
শহরের শিশু-কিশোরদের অনেকে এখন হয়তো গোল্লাছুটের নামও জানে না। গ্রামের বাবা-মায়েরাও তাদের ছেলে-মেয়েদের গোল্লাছুটের মতো খেলায় অংশ নিতে দেন না। পেছনে কারণ-গোল্লাছুট খেলে কি লাভ! তার চেয়ে বরং ক্রিকেট, ফুটবলের মতো খেলা নিয়ে মেতে থাকবে ভবিষ্যতে পেশা হিসেবে নিতে পারবে। তা ছাড়া নাম, ডাক, যশ, খ্যাতির বিষয়টি তো মাথায় আছেই।
একটা সময় স্কুল, কলেজ কিংবা মাদরাসার মাঠেও টিফিনের বিরতিতে ছেলে-মেয়েরা গোল্লাছুট নিয়ে মেতে উঠতো। এখন শহর তো দূরের কথা, প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল-কলেজেও এই খেলা যায় না। আর এসব খেলাধুলার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশেও ব্যাঘাত ঘটছে।
গোল্লাছুটের মতো খেলাধুলা গ্রামীণ জনপদ থেকে হারিয়ে যাওয়ায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের এক বড় অংশই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। যেভাবে বিলুপ্তি ঘটছে হয়তো অচিরেই গোল্লাছুট স্থান পাবে কেবল জাদুঘরে। তরুণ প্রজন্মের কাছে তখন গোল্লাছুট হয়ে থাকবে রূপকথা!
গোল্লাছুটের গুরুত্ব
গোল্লাছুটের মতো জনপ্রিয় গ্রামীণ অংশ নেওয়ার কারণে আগের ছেলে-মেয়েদের ফিটনেস অনেক ভালো থাকত। কারণ গ্রামীণ খেলায় ছেলে কিংবা মেয়ে নিজের অজান্তেই প্রচন্ড গতিতে দৌঁড়াচ্ছে, কখনো লাফ দিচ্ছে, আরও নানারকম কসরত করতে হচ্ছে। এটি বহুমাত্রিক ফিটনেসের কাজ করছে। তাই ছোটবেলায় যারা এমন গ্রামীণ খেলায় অংশ নিয়েছে তারা বড় হয়ে যেকোনো ক্রীড়ায় অনায়াসে অংশগ্রহণ করতে পারছে। সে ক্রিকেটারও হতে পারবে, ফুটবলারও হতে পারবে কিংবা হকি, যেকোনো খেলায় অংশ নেওয়ার মতো ফিটনেস তার ছোটবেলা থেকেই তৈরি হচ্ছে।
যে শিশু ছোটবেলা থেকেই শুধুমাত্র ক্রিকেট খেলছে, সে কিন্তু বড় হয়ে অন্য খেলায় ততটা পারদর্শী হতে পারবে না। অন্যান্য খেলার বেলাতেও তাই। সে কারণে গোল্লাছুটের মতো খেলাগুলো শিশুর ফিটনেসের জন্যই দরকার ছিল।
খেলার নিয়ম
গ্রামের পরিত্যক্ত জমি, খোলা মাঠ বা বাগানে গোল্লাছুট খেলা হয়। দুই পক্ষ বা দল থাকে। প্রতিটি দলে ৫ কিংবা তার বেশি সদস্য থাকবে। প্রথমে একটি ছোট্ট গর্ত করে সেখানে একটি কাঠি পুঁতে রাখা হয়। আর কাঠির চারপাশে ছোট একটি গোল্লা আঁকা হয়। একটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সীমানা। পঁচিশ-ত্রিশ হাত বা আরও কিছুটা দূরে গাছ বা ইট-পাথরকে বাইরের সীমানারূপে হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কখনো জমির আইলকে বাইরের সীমানা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গোল্লা রক্ষার জন্য একজনকে রাখা হয়। তাকে ঘিরে অন্যরা চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সুযোগ বুঝে তারা দৌঁড়ে গিয়ে বাইরের সীমানা স্পর্শ করে আসে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা তৎপর থাকেন স্পর্শ করার জন্য। যাকে স্পর্শ করবে সে বাদ। আর যে যে বাইরের সীমানা স্পর্শ করে সে গোল্লা থেকে লাফ দিয়ে সামনের দিকে এগোতে হয়। এভাবে বাইরে সীমানায় পৌঁছে গেলেই জয়। আর একে একে সবাইকে স্পর্শ করে বাদ করে দিতে পারলে প্রতিপক্ষ খেলার সুযোগ পায়। গোল্লা থেকে ছুটতে হয় বলেই খেলার নাম গোল্লাছুট।