বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার তিনি। সুইপারের ভূমিকায়ও অনন্য। প্রতিপক্ষের ডি বক্সের উপর হামলে পড়ার সময় মনে হয় একজন পাকা স্ট্রাইকার। আবার নিজেদের ডি বক্সের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন হিমালয়ের দৃঢ়তা নিয়ে। প্রতিপক্ষের সব আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রাখেন গোলবার। টোটাল ফুটবল পূর্ণ রূপে বিকশিত হয়েছিল জার্মান কিংবদন্তি লোথার ম্যাথিউসের মধ্যেই। ১৯৯০ বিশ্বকাপ জয়ী জার্মান অধিনায়ক।
ম্যারাডোনা তার 'আই অ্যাম দিয়েগো' বইতে লিখেছেন, লোথার ম্যাথিউস ছিল আমার সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ। তার পরিচয়ের জন্য এটুকু বলাই যথেষ্ট। ১৯৯০ বিশ্বকাপটা আর্জেন্টিনাতেই যাওয়ার কথা ছিল। দিয়েগো ম্যারাডোনা জ্বরে ফুটবলবিশ্ব তখন থর থর করে কাঁপছে। বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা দল নিয়ে গিয়েছিলেন শিরোপা জয়ের জন্যই। ফাইনাল পর্যন্ত আলবেসিলেস্তরা আধিপত্য দেখিয়েছিল ঠিকই। তবে ফাইনালে গিয়ে লোথার ম্যাথিউসের দলটার কাছে পূর্ণ রূপে ধরাশায়ী হয় আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনার জাদুর ঝুলিতে থাকা কোনো জাদুই সেদিন জার্মানদের মোহগ্রস্ত করতে পারেনি। ম্যাথিউসদের ২৫ আক্রমণের বিপরীতে আর্জেন্টাইনদের আক্রমণ ছিল মাত্র একটি! ১৯৯০ ফাইনালের আগে ফরাসি কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনি বলেছিলেন, জার্মানদের এই দলটাই বিশ্বকাপ জিতবে। তার কথা সত্যি হয়েছিল। আর এই ফাইনালে লোথার ম্যাথিউস তার উদারতার প্রমাণ দিয়েছিলেন।
জার্মানরা ধারাবাহিক আক্রমণে গেলেও গোলের দেখা পায়নি। অবশেষে ম্যাচের ৮৫ মিনিটে একটা বিতর্কিত পেনাল্টি পায় পশ্চিম জার্মানি। আর্জেন্টিনার অভিযোগ ছিল, ভয়লার সামান্য ট্যাকলেই পেনাল্টির জন্য মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েছিলেন। পেনাল্টি শট নেওয়ার কথা ছিল অধিনায়ক ম্যাথিউসের। কিন্তু পায়ে সামান্য আঘাত থাকায় বন্ধু আন্দ্রেস ব্রেহমেকে পেনাল্টির দায়িত্ব দেন তিনি। গোল করে অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন ব্রেহমে। পরে ম্যাথিউস বলেছিলেন, আমি জানতাম ব্রেহমে আমাদের সম্মান রক্ষা করবে। লোথার ম্যাথিউসের গৌরব অন্যখানে। তিনি টানা ২১ বছর জার্মানির জার্সি গায়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলেছেন। ৩৮ বছর বয়সে জার্মানির বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন। জার্মানির জার্সি গায়ে সর্বোচ্চ ১৫০টা ম্যাচ খেলেছেন। তবে ম্যাথিউসের গৌরব এ সবের চেয়েও বড় কিছু। একজন আউটফিল্ডার হিসেবে তিনিই একমাত্র ফুটবলার যার ডায়েরিতে পাঁচটা বিশ্বকাপের স্মৃতি আছে। ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০, ১৯৯৪ ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপে খেলেছেন তিনি। পাঁচটা বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা আছে আর মাত্র একজনের। মেঙ্কিান গোলরক্ষক অ্যান্টোনিও কারভায়াল ১৯৫০, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৬৬ বিশ্বকাপ খেলেছেন। লোথার ম্যাথিউসের রেকর্ড বুকে আছে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার গৌরব পালকও। তিনি ২৫টা ম্যাচ খেলেছেন বিশ্বকাপের মাঠে। লোথার ম্যাথিউস ফুটবলকে বিদায় জানান ২০০০ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার পর। ২০০১-১১ পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন দলে কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ বুলগেরিয়া জাতীয় দলের কোচ ছিলেন তিনি ২০১০-১১ পর্যন্ত। বর্তমানে তিনি হাঙ্গেরিতে বসবাস করছেন। এখানে তার বান্ধবী আনাসতাসিয়া গত এপ্রিলে মিলান নামের এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এর আগে চারবার ম্যাথিউস বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন। ১৯৮১ সালে সিলভিয়াকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। সিলভিয়ার গর্ভে জন্ম হয়েছে ম্যাথিউসের আলিসা ও ভায়োলা নামের দুই কন্যা সন্তানের। সুইস টিভি প্রেজেন্টার ললিতা মোরেনাকে ম্যাথিউস বিয়ে করেন ১৯৯৪ সালে। এরপর সার্বিয়ান সমাজসেবক মারিয়ানা কসটিচকে বিয়ে করেন ম্যাথিউস ২০০৩ সালে। সর্বশেষ ইউক্রেনেরে ২১ বছর বয়সী মডেল ক্রিস্টিনা লিলিয়ানাকে ২০০৮ সালে বিয়ে করেন তিনি। সেই বিয়েও ২০১০ সালে ভেঙে যায়। বর্তমানে বান্ধবী আনাসতাসিয়া ও পুত্র সন্তান মিলানকে নিয়ে ৫৩ বছর বয়সী ম্যাথিউস নির্বিঘ্নে দিন কাটাচ্ছেন হাঙ্গেরিতে।