মোনেম মুন্না, জুম্মন লুসাই ও পুশকিন, ক্রীড়াঙ্গনে তিন পরিচিত মুখ। একে অপরের সম্পর্ক এতই মধুর ছিল যে ক্রীড়াঙ্গনে তাদের পরিচয় ছিল ত্রিরত্ন বলেই। তিন বন্ধুই একে একে চলে গেলেন 'না ফেরার দেশে'। প্রথমে মুন্না, তারপর পুশকিন আর গতকাল চলে গেলেন বাংলাদেশের হকির অন্যতম সফল তারকা জুম্মন লুসাই। শুক্রবার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলে জুম্মনকে সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা কোনো লুকোচুরি না করে সবাইকে জানিয়ে দিলেন ওর শরীরের যে হাল তাতে যে কোনো সময় বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারে। এ দুঃসংবাদটি শোনার জন্য সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকারও অনুরোধ রাখেন তারা। যে জুম্মন হকিতে এত কিছু দিয়ে গেছেন তাকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও চালিয়েছিলেন ক্রীড়াঙ্গনে তার ঘনিষ্ঠজনরা। শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যিালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল উন্নত চিকিৎসার আশায়। না কোনো কিছুতেই লাভ হলো না। রবিবার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়ে দিলেন জুম্মন আর নেই। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায় ঘটল। নেমে আসে শোকের ছায়া।
বাংলাদেশের হকিকে জনপ্রিয় করার পেছনে যদি পাঁচজন খেলোয়াড়ের নাম উল্লেখ করতে হয় তাহলে জুম্মুনও ঠাঁই পাবেন অনায়াসে। শুধু হকি বললে ভুল হবে ক্রীড়াঙ্গন জুড়েই ছিল জুম্মনের জনপ্রিয়তা। আবাহনী হকিতো বটেই ফুটবল ও ক্রিকেটে দল গঠনের পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতেন। হকি ছাড়লেও ক্রীড়াঙ্গন বা আবাহনীর মায়া ছাড়তে পারেননি কখনো। বাংলাদেশের হকিতে লুসাইয়ের পরিবারের অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সত্তর দশকে হকির জনপ্রিয় খেলোয়াড় রামা লুসাই ছিলেন জুম্মনের ঘনিষ্ঠ আত্দীয়। সেই রামা খেলা ছেড়ে দিয়ে এখন ভারতে অবস্থান করলেও জুম্মন তার পিতৃভূমি সিলেটে বেশি দিন থাকতেন না। অন্য ভাইয়েরা সিলেটকে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বেছে নিলেও জুম্মন অল্প ক'দিন থেকেই ছুটে আসতেন আবাহনী ক্লাবে। জুম্মন খেলোয়াড়ি জীবনে খ্যাতি বা যশ পেয়েছিলেন আবাহনী থেকেই। পুলিশ দিয়ে হকির ক্যারিয়ার শুরু করলেও ক্রীড়াঙ্গনে জুম্মনের পরিচয় এসেছিল আবাহনী থেকে। তিন বন্ধু মুন্না, জুম্মন, পুশকিন ছিলেন আবাহনীর প্রাণ।
১৯৭৮ সালে পুলিশ এসসি থেকে জুম্মন প্রথম বিভাগ লিগ খেলা শুরু করেন। এরপরই যোগ দেন আবাহনীতে। খুব অল্প বয়সে দিলি্লতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে জুম্মনের সুযোগ ঘটে। তবে ক্রীড়াঙ্গনে তার পরিচয় ঘটে ১৯৮৫ সালে। ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেবার এশিয়া কাপ হকিতে জুম্মনের নৈপুণ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। তার অসাধারণ হ্যাটট্রিকে বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে ইরানকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে। আন্তর্জাতিক হকিতে এটিই ছিল বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়ের প্রথম হ্যাটট্রিক। জুম্মন যে কত উঁচুমানের খেলোয়াড় ছিলেন তার প্রমাণ মিলে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্ব একাদশে সুযোগ পেয়ে। ১৯৯৪ সালে ঢাকা লিগে মোহামেডানের পক্ষে খেলে যান হকির ম্যারাডোনা বলেখ্যাত শাহবাজ আহমেদ। জুম্মনের স্টিকওয়ার্ক দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে, সাংবাদিকদের বলেছিলেন আমার কাছে ১০ জন বিশ্ববিখ্যাত হকির খেলোয়াড়ের নাম জানতে চাইলে আমি জুম্মনের নামও বলব। ১৯৯৯ সালে জুম্মন অবসর নিলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হকির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন। অনেক খেলোয়াড়ই ফেডারেশনের বড় বড় দায়িত্ব পেয়েছেন। জুম্মনকে কখনো না দেখা গেলেও তিনি বলতেন হকিকে সেবা করতে ফেডারেশনে বসার দরকার নেই। ভালোবাসলেই হকিকে সেবা করা যায়। নানা কারণে ক্রীড়াঙ্গনে অনেকে সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু জুম্মন এক্ষেত্রে ছিলেন ব্যতিক্রম। সবাই তার প্রশংসা করে গেছেন। হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক খাজা রহমত উল্লাহ বললেন, আমি যে কি হারালাম ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। হকিতে এতদূর আসতে পারতাম না যদি জুম্মন সহযোগিতা না করতেন। সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজেদ এ এ আদেল বললেন, জীবনে যে ক'জন স্বচ্ছ লোক দেখেছি তার মধ্যে জুম্মন অন্যতম। আমি মোহামেডান জুম্মন আবাহনীতে খেলত। কখনো মাঠে দু'জনার মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়নি। জুম্মনের মৃত্যুতে হকি হারালো একজন যোগ্য অভিভাবককে।