বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক প্রেক্ষাপট দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, আর এই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হলো প্রযুক্তি। ৩জি ও ৪জি আমাদের যোগাযোগ ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বিপ্লব এনেছিল, আর এখন ৫জি সেই বিপ্লবকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্স রিসার্চের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালে বৈশ্বিক ৫জি এন্টারপ্রাইজ বাজারের আকার ছিল ৪.৯২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩৪ সালের মধ্যে প্রায় ৮২.৬৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এই প্রবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ৫জির গতি, নির্ভরযোগ্য সংযোগ এবং ব্যবসায়িক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষমতা।
পঞ্চম প্রজন্মে ওয়্যারলেস (৫জি) কী?
৫জি হলো পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি। এটি আগের ৩জি এবং ৪জির সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে উন্নত গতি, নির্ভরযোগ্যতা এবং সংযোগ প্রদান করে। ৩জি ছিল মূলত ভয়েস এবং ডেটার জন্য এবং ৪জি-তে ছিল দ্রুত মোবাইল ইন্টারনেট ও ভিডিও স্ট্রিমিং সক্ষমতা। তবে ৫জি এগুলোর চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক ডিজিটাল জনসংখ্যার প্রায় ৯৬% মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করত। এই বর্ধিত চাহিদা মেটাতে ৫জি তৈরি করা হয়েছে। এটি দ্রুত ডেটা স্থানান্তর, উচ্চতর ব্যান্ডউইথ, কম ল্যাটেন্সি এবং আরও বেশি ডিভাইসকে সংযুক্ত করতে সক্ষম।
৫জি কেন আলাদা
৫জি ৩জি ও ৪জির সীমাবদ্ধতাকে পেছনে ফেলে আরও উন্নত গতি, কম ল্যাটেন্সি এবং বৃহত্তর সংযোগ সক্ষমতা প্রদান করে। এটি প্রতি সেকেন্ডে ২০ গিগাবাইট পর্যন্ত ডেটা স্থানান্তর করতে সক্ষম, যেখানে রেসপন্স টাইম নেমে আসে এক মিলিসেকেন্ডেরও নিচে। একই সঙ্গে এটি লাখ লাখ ডিভাইস একসঙ্গে সংযুক্ত রাখতে পারে, যা ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) ও স্মার্ট সিস্টেমগুলোর জন্য অপরিহার্য।
এটি কেন ব্যবসায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫জি গ্রহণের মূল কারণগুলো হলো উন্নত সংযোগ, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, গ্রাহক অভিজ্ঞতা উন্নয়ন এবং নতুন রাজস্ব সুযোগ তৈরি করবে। কর্মদক্ষতার দিক থেকে এটি রিমোট ওয়ার্ককে আরও নিরবচ্ছিন্ন করে তোলে এবং স্মার্ট অটোমেশনের মাধ্যমে উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনাকে সহজ করে। গ্রাহক অভিজ্ঞতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে ৫জি ব্যবহার করে এআর ও ভিআর-এর মাধ্যমে ইমারসিভ অভিজ্ঞতা দেওয়া সম্ভব, যা পণ্যের ডেমো কিংবা প্রশিক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি খরচ কমানো ও নতুন রাজস্ব মডেল তৈরির সুযোগও তৈরি হয়।
৫জির কী কী সুবিধা রয়েছে
প্রথমত, গতি ও দক্ষতার দিক থেকে ৫জি ৪জির তুলনায় ১০ গুণ দ্রুত, ফলে ডেটানির্ভর ব্যবসাগুলো তাৎক্ষণিক তথ্য প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, নির্ভরযোগ্য সংযোগ ব্যবসাকে ভিডিও কনফারেন্সিং বা রিয়েল টাইম অ্যাপ্লিকেশনে নিরবচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা দেয়। তৃতীয়ত, যে কোনো জায়গা থেকে রিমোট কাজের সুবিধা কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নমনীয়তা তৈরি করে। চতুর্থত, আইওটি ও একাধিক ডিভাইস একসঙ্গে পরিচালনা করার ক্ষমতা স্মার্ট অফিস ও অটোমেশনকে সম্ভব করে। এ ছাড়া উন্নত ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যৎ প্রবণতা অনুমান এবং গ্রাহকদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বাড়ায়।
ছোট ব্যবসায়েও ৫জি কার্যকর
অনেকে মনে করেন ৫জি শুধু বড় করপোরেশনের জন্য, কিন্তু বাস্তবে ছোট ব্যবসাগুলোও ৫জি ব্যবহার করে ব্যয়বহুল তারযুক্ত সংযোগের বিকল্প হিসেবে সাশ্রয়ী সমাধান পেতে পারে। একই সঙ্গে এটি সীমিত সম্পদ ব্যবহার করেও উচ্চ দক্ষতায় কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
৫জি প্রযুক্তি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ
প্রথমত, ৫জি গ্রহণ করতে নতুন হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্ক আপগ্রেডে বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপী কভারেজ বাড়লেও এখনো অনেক অঞ্চলে ৫জি সহজলভ্য নয়। তৃতীয়ত, বিপুল সংখ্যক সংযুক্ত ডিভাইস নিরাপত্তাজনিত ঝূঁকি বাড়ায়। তবে উন্নত এনক্রিপশন ও নেটওয়ার্ক স্লাইসিং এসব ঝুঁকি মোকাবিলা করতে সহায়তা করছে। চতুর্থত, বিভিন্ন দেশে নতুন আইন ও নিয়ম আসতে পারে, যা ব্যবসাগুলোকে মানতে হবে।
৫জি ব্যবসায়িক সুযোগ বৃদ্ধি করে
স্বাস্থ্যসেবায় টেলিহেলথকে আরও কার্যকর করছে এবং দূর থেকে রোগী পর্যবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায় পেমেন্ট ও ব্যক্তিগত গ্রাহক অভিজ্ঞতা নিশ্চিত হচ্ছে। উৎপাদন খাতে ৫জি স্মার্ট ফ্যাক্টরি তৈরিতে সাহায্য করছে, যেখানে সেন্সরের মাধ্যমে মান নিয়ন্ত্রণ ও ইনভেন্টরি পর্যবেক্ষণ হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে রিমোট ও হাইব্রিড শিক্ষাকে সহজ করছে। অর্থনৈতিক পরিষেবায় দ্রুত ও নিরাপদ লেনদেন সম্ভব করছে। বিনোদন খাতে এটি অনলাইন গেমিং ও লাইভ ইভেন্টে নতুন অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। পরিবহন খাতে স্ব-চালিত যানবাহন এবং স্মার্ট ট্র্যাফিক সিস্টেমকে আরও উন্নত করছে।
৫জি শুধু একটি নেটওয়ার্ক নয়, ব্যবসায়িক দক্ষতা, যোগাযোগ, গ্রাহক সন্তুষ্টি এবং ভবিষ্যৎ-প্রস্তুতির ভিত্তি। উত্তর আমেরিকায় ২০২৯ সালের মধ্যে ৫জি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪৩২ মিলিয়নের বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই যে প্রতিষ্ঠানগুলো আজ থেকে ৫জিতে বিনিয়োগ শুরু করবে, তারা আগামী দিনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ