করোনায় মৃতদেহ দাফন বা সৎকারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সক্রিয় রয়েছে দেশের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে শেষ বিদায় জানাতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছেন কোয়ান্টামের দেড় হাজার স্বেচ্ছাসেবী
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ৭ জুলাই রাতে এক নারী মারা যান। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁর স্বামী ওয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন। কিন্তু ওই নারীর মৃত্যুর পর তাঁর স্বামীকে আর পাওয়া যায়নি। তিনি ফোনও ধরেননি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর লাশ রেখে স্বামী পালিয়ে যান। করোনা ওয়ার্ডের এক নার্স বলেন, মৃত্যুর আগপর্যন্ত আসমার স্বামী ওয়ার্ডের বাইরে অবস্থান করছিলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তাঁর স্বামীকে কয়েকবার ফোন করা হয়। তিনি আসবেন বলে আর আসেননি। একপর্যায়ে স্বামীর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আসমার লাশ দাফনের জন্য পরে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনকে ডাকা হয়।
একজন মানুষ সারা জীবন তার সমাজ-সংসারের জন্য যে ত্যাগ, শ্রম ও মেধা ব্যয় করেন তার শেষ বিদায়টা সম্মানজনক হওয়া উচিত। গত বছর দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে স্বজনদের মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার অনেক অমানবিক ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সাম্প্রতিক সংক্রমণ ও মৃত্যু তখনকার তুলনায় অনেক বেশি। এখন প্রতিদিন গড়ে ২০০ জন করোনায় এবং উপসর্গ নিয়ে আরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এতসব লাশের দাফন ও সৎকার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন সংগঠন ঝুঁকি নিয়ে এসব লাশ দাফন-সৎকারে কাজ করছে।
করোনায় মৃতদেহ দাফন বা সৎকারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সক্রিয় রয়েছে দেশের অন্যতম স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে শেষ বিদায় জানাতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছেন কোয়ান্টামের দেড় হাজার স্বেচ্ছাসেবী। রাজধানীসহ সারা দেশেই মমতার পরশে শেষ বিদায়ে চলছে তাদের নিরলস মানবিক এ সেবা কার্যক্রম।
২০২০ সালে করোনার শুরু থেকে গত ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৪ হাজার ৮৪৪টি মরদেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কর্মীরা। এর মধ্যে মুসলিম ৪ হাজার ২৩৬টি, সনাতন ৫৪৮টি, বৌদ্ধধর্মের ২৪টি এবং খ্রিস্টান ধর্মের ৩৬টি মরদেহ রয়েছে। ২০২১ সালের ৭ মাসে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় এ সংখ্যা ১ হাজার ৯৪৮টি। এর মধ্যে মুসলিম ১ হাজার ৮২১, সনাতন ১১০, বৌদ্ধ ৩ এবং খ্রিস্টান ধর্মের রয়েছে ১৪টি মরদেহ।
রাজধানীর কাকরাইলে কোয়ান্টাম দাফন কার্যক্রমের ইনচার্জ খন্দকার সজিবুল ইসলাম জানান, ২০২০ সালের এপ্রিলে করোনার শুরু থেকেই করোনা বা করোনা উপসর্গে মরদেহের শেষকৃত্যে অংশ নিচ্ছে কোয়ান্টাম। স্বপরিকল্পনা, স্বঅর্থায়ন আর স্বেচ্ছাসেবকদের স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে এ দাফন সেবা। রাজধানীতে কোয়ান্টাম দাফন সেবায় জড়িত রয়েছেন দুই শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক। সারা দেশে স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা প্রায় ১৫০০। বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সী স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকায় রয়েছেন আলাদা নারী স্বেচ্ছাসেবক দল। মুসলিম ছাড়াও অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য রয়েছে স্ব স্ব ধর্মের পৃথক দল।
স্বাস্থ্যবিধি ও ধর্মীয় রীতি মেনে চলছে কোয়ান্টামের এ সেবা। হাসপাতাল ছাড়াও কাকরাইলে নিজস্ব গোসলখানায় ভাইরাসমুক্ত করে শেষ সজ্জায় সাজিয়ে কবরস্থান বা সমাধি পর্যন্ত চলছে কোয়ান্টামের এ সেবা। খন্দকার সজিবুল ইসলাম জানান, মৃতের সংখ্যা বাড়লেও গত বছরের তুলনায় এ বছরের চিত্র অতটা অমানবিক নয়। গত বছর আপনজনদের দাফন বা সৎকারে এগিয়ে না আসা, লাশ ফেলে পালিয়ে যাওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এ বছর আপনজনদের অনেকেই পাশে থাকছেন। অংশ নিচ্ছেন জানাজায়। নিজেরাই দায়িত্ব নিচ্ছেন দাফনের। তিনি বলেন, এখনো লকডাউনের মধ্যেও ফোন পাওয়া মাত্রই কর্মীরা ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতাল, বাসা, কবরস্থান কিংবা শশ্মানে। সদস্য ও শুভাকাক্সক্ষীদের দান-অনুদানে চলছে আমাদের এই সেবা কার্যক্রম। কোয়ান্টামের এই মানবিক সেবা কার্যক্রমে যে কেউ চাইলে আর্থিকভাবে শরিক হতে পারেন।
করোনা দাফনে সবচেয়ে বেশি প্রচারে থাকা আল মারকাজুল ইসলামীর কভিড-১৯ টিমের ম্যানেজার মোহাম্মদ হানজালা গতকাল বলেন, আমরা মূলত ঢাকায় দুটো টিমে ১৭ জন স্বেচ্ছসেবী কাজ করছি। এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার মৃতদেহ দাফনে অংশ নিয়েছেন তাঁরা। শুরুতে আমরা দাফনেও অংশ নিতাম। এখন শুধু মৃতদেহ গোসলের কার্যক্রম চলছে। গতকাল পর্যন্ত আমরা ৫ হাজার ৪৮১টি লাশের গোসল করিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা শুধু ঢাকায়ই কাজ করছি। তবে গত বছরের শেষদিকে ইউএনডিপির সহায়তায় ৭ সিটি ও ৩ জেলায় ট্রেনিং কার্যক্রম চালিয়েছি। সেখানে কিছু স্বেচ্ছাসেবী তৈরি হয়েছে। তারা নিজেদের মতো কাজ করছে।
করোনায় লাশ দাফনে আল রশিদ ফাউন্ডেশনের রয়েছে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক দল। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বলেন, করোনায় লাশ দাফনের জন্য ২৪ ঘণ্টা আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা প্রস্তুত। রয়েছেন তিনজন নারীসহ ৩০ সদস্যের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আলেম ও স্বেচ্ছাসেবক দল। এ পর্যন্ত তাঁরা প্রায় ৩০০ লাশ দাফন করেছেন। এ ছাড়া জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি করোনায় মৃতদেহ দাফনে সক্রিয় রয়েছেন। গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে সংস্থাগুলো কাজ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকারের নির্দেশনা মেনে নিজেরা সুরক্ষিত থেকে লাশ দাফন-সৎকার করছেন।
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        