একটা সময় রাজধানীতে সড়কের মোড়ে মোড়ে ছিল সংবাদপত্র স্টল। স্থায়ী এসব স্টল থেকে পথচারীরা পত্রিকা কিনতেন। একই সঙ্গে ভাসমান হকাররা পত্রিকা নিয়ে বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন আর সেই চিত্র দেখা যায় না। মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের নাম করে এসব স্টল উচ্ছেদ করা হয়েছে। এতে পত্রিকা বিক্রেতারা পড়ছেন সমস্যায়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ পত্রিকাবিমুখ হচ্ছেন।
সংবাদপত্র হকার্স সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকায় পত্রিকা বিক্রির জন্য প্রায় ২০০টি স্থানে ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেখানে সংবাদপত্র বিক্রি হতো। ঢাকায় গত কয়েক বছর আগেও ৮০টি স্থায়ী পত্রিকা স্টল ছিল। মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, ফুটওভার ব্রিজসহ সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে ৫৬টি স্টল এরই মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে। আর বাকি ২৪টি স্টলে কোনো রকম চলছে পত্রিকা বিক্রি। সেগুলোও বিভিন্ন অজুহাতে উচ্ছেদ করতে চায় বিভিন্ন সংস্থা। ফুটপাত থেকে পত্রিকার হকারদের উচ্ছেদের পর মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন ভাসমান পত্রিকা স্টলের বিক্রেতারা।
লক্ষ্মীবাজারে পত্রিকা বিক্রি করেন সাইদ। তিনি বলেন, আমরা আগে তিন ভাই এ কাজে যুক্ত থাকলেও এখন শুধু আমিই আছি। বাকি দুজনের একজন চাকরি করে, অন্যজন অটোরিকশা চালায়। আমি ফুটপাতে পত্রিকা বিক্রি করে কোনো রকম টিকে আছি। এর মধ্যে রয়েছে ফুটপাতে হয়রানি। বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশন থেকে উচ্ছেদ অভিযান চলে।
এ বিষয়ে ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান বলেন, কিছুদিন আগেও ঢাকা শহরে ৮০টি পত্রিকা স্টল ছিল। বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে ৫৬টি স্টল ভেঙে ফেলা হয়েছে। এখন ২৪টি রয়েছে। এগুলো উচ্ছেদ করার হুমকি দিয়ে আসছে। তিনি বলেন, স্টল উচ্ছেদের ফলে হকাররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পত্রিকা বিক্রি কমে গেছে। এতে দৈনিক পত্রিকাগুলোরও ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি দাবি করেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় অন্তত ২০০টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হোক। একই সঙ্গে মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন স্থাপনায় বঙ্গবন্ধু বা শেখ রাসেল কর্নার নামে পত্রিকা স্টল বরাদ্দ দেওয়া হোক। যাতে মানুষ পত্রিকা পড়তে পারেন।
রামপুরা ব্রিজের পাশে পত্রিকা বিক্রি করেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, আগে স্টল ছিল। এখন রাস্তায় বসে বিক্রি করি। রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট করতে হয়। এ ছাড়া স্থায়ী দোকান না থাকায় ভাসমান হকারদেরও পরিচালনা করা যায় না।
বনানী ও গুলশান এলাকায় একাধিক স্থায়ী দোকান ছিল। এখন গুলশান ২ নম্বরের পাশে একটি স্থায়ী স্টল রয়েছে। স্টলে কথা হয় বিক্রেতা জামাল উদ্দিন সবুজের সঙ্গে। তিনি বলেন, গুলশান ও বনানীতে আগে বেশ কয়েকটি পত্রিকা স্টল ছিল। এখন আর নেই। সিটি করপোরেশন স্টলগুলো উচ্ছেদ করেছে। শুধু এই স্টলটি এখন আছে।
এদিকে আগে পত্রিকার স্টল ছিল এমন অনেক জায়গা ঘুরে দেখা গেছে- এখন আর ওইসব এলাকায় পত্রিকার কোনো স্টল নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে একটি দোকান ছিল পত্রিকার। এখন ওই এলাকায় আর কোনো দোকান নেই। জাতীয় জাদুঘরের বিপরীত পাশে বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের নিচতলায় ওষুধের দোকানের সামনে কয়েকজন হকার অস্থায়ীভাবে পত্রিকা বিক্রি করছেন এখন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে স্টল ছিল, এখন পুলিশ বক্স। এ ছাড়া গুলিস্তান, পল্টন, তেজগাঁও, গুলশান-১ এলাকা ঘুরে কোনো স্টল দেখা যায়নি।
হকার্স সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, পত্রিকার স্থায়ী দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক হকার কাজ হারিয়েছেন। ওইসব দোকান থেকে ভাসমান হকাররা পত্রিকা নিয়ে বিক্রি করতেন।
এ বিষয়ে পত্র-পত্রিকা বিতরণকারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, বর্তমানে সংবাদপত্র বিতরণ ব্যবস্থা ধ্বংসের পথে। অনেক পত্রিকা স্টল এখন নেই। আমরা সেখান থেকে পত্রিকা বিতরণ ব্যবস্থাকে আরও গতিশীল করতে বিভিন্ন স্থানে ছিন্নমূল হকারের মাধ্যমে পত্রিকা বিক্রি শুরু করি। এতেও বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সিটি করপোরেশন বাধা দিচ্ছে। ভাসমান পত্রিকা স্টল রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব সংস্থার সহযোগিতা কামনা করছি।
সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ সংবাদপত্র শিল্প কল্যাণ ফেডারেশনের সভাপতি মো. বেলাল হোসাইন মন্টু বলেন, শহর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বর্তমানে কোনো পত্রিকা স্টল নেই। তাই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পত্রিকা স্টল নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে স্টল নির্মাণে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি; যাতে মানুষ নির্বিঘ্নে পত্রিকা পড়তে পারেন।